০১:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

আর্জেন্টিনা এবং ইজরায়েলের এতো বন্ধুত্ব কেন?

গত বছরের অক্টোবর মাসে হামাস যখন ইসরায়েলে আক্রমণ করছিল, সে সময় আর্জেন্টিনার ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফার ভোট দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর্জেন্টিনার রাজনীতিবিদ ও প্রার্থীরা খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করেন।

মধ্যবামপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আলবার্তো ফার্নান্দেজ থেকে শুরু করে উগ্র ডানপন্থী হাভিয়ার মিলেই (বর্তমান প্রেসিডেন্ট)—সবাই ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়ে হামাসকে নিন্দা করলেন। তাঁদের কেউই গাজা, ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের কথা উল্লেখ করলেন না।

বামপন্থী প্রার্থী মেরিয়াম ব্রেগম্যান অবশ্য নিরীহ মানুষের প্রাণহানির ঘটনার দুঃখ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের বিতর্ককালে তিনি বর্তমান সংঘাতের জন্য ইসরায়েলের দখলদারি ও বর্ণবাদকে দায়ী করেন।

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনই ছিল প্রভাববিস্তারী। নতুন প্রেসিডেন্ট মিলেইয়ের প্রশাসন সরাসরি ইসরায়েলপন্থী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। যদিও কিছু আরব গণমাধ্যম ভুলভাবে উপস্থাপন করছে যে লাতিন আমেরিকার সব দেশই ফিলিস্তিনের প্রতি সংবেদনশীল।

গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে আলজাজিরা ফিলিস্তিনের প্রতি লাতিন আমেরিকার ব্যাপক সমর্থনের দৃষ্টান্ত হিসাবে মহাদেশটির সরকারগুলোর বিবৃতি তুলে ধরেছিল। দ্য নিউ আরব–এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ‘লাতিন আমেরিকা কেন ফিলিস্তিনের প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে অঞ্চলটির ক্রমাগত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, বামপন্থী আন্দোলন ও আরব দেশগুলো থেকে যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যাকে কারণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এর বিপরীতে ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ ফার্নান্দো ব্রাঙ্কোলি দেখিয়েছেন রাজনৈতিক মতাদর্শ, অভিবাসী রাজনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো কীভাবে ইসরায়েলপন্থী ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে।

আর্জেন্টিনা-ইসরায়েল সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে অভিবাসী রাজনীতি, বিশেষ করে ইসরায়েলি লবি দেশটির পররাষ্ট্রনীতি বদলে দিতে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে, এমন তথ্য-প্রমাণ খুব একটা নেই।

দীর্ঘদিন ধরেই আর্জেন্টিনা একটা নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রেখে আসছিল। তারা যে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—দুই রাষ্ট্র সমাধান চায়, এই নীতি ছিল তারই প্রতিফলন। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত ১৮১ (২) নম্বর প্রস্তাবটি ভোটদানে বিরত থাকে। এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি দুই রাষ্ট্রে ভাগ করার কথা বলা হয়েছিল।

জাতিসংঘের ৩৩৭৯ নম্বর প্রস্তাবটিতেও ভোটদানে বিরত ছিল আর্জেন্টিনা। এই প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘জায়নবাদ বর্ণবাদ ও বর্ণবাদী বৈষম্যের একটি রূপ।’ ২০১০ সালে জাতিসংঘে উত্থাপিত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রস্তাবে আর্জেন্টিনার সমর্থনটা ছিল অভিবাসী রাজনীতি থেকে পৃথক একটি বিষয়। স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির ফলাফল ছিল সেটি। এ ছাড়া ইহুদি সম্প্রদায় আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। তারা নানা দলে বিভক্ত।

আর্জেন্টাইন সমাজের সঙ্গে ইহুদিদের মিশে যাওয়া এবং এই সম্প্রদায়ের মধ্যকার ভিন্নতা—এই দুই কারণে ইসরায়েলপন্থী এজেন্ডা বাস্তবায়নে দেশটির ইহুদিদের একত্র হওয়ার ক্ষমতা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে অভিবাসী রাজনীতির চেয়ে মতাদর্শিক সখ্য ও নিরাপত্তাসহায়তা অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

-জদর জলিত, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে আর্জেন্টাইন সাংবাদিক ও গবেষক, মিউলইস্ট আই থেকে নেওয়া।

জনপ্রিয়

মুরাদনগরের সাবেক ৫বারের এমপি কায়কোবাদের অপেক্ষায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ

আর্জেন্টিনা এবং ইজরায়েলের এতো বন্ধুত্ব কেন?

প্রকাশিত : ০২:০৫:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জুলাই ২০২৪

গত বছরের অক্টোবর মাসে হামাস যখন ইসরায়েলে আক্রমণ করছিল, সে সময় আর্জেন্টিনার ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফার ভোট দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর্জেন্টিনার রাজনীতিবিদ ও প্রার্থীরা খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করেন।

মধ্যবামপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আলবার্তো ফার্নান্দেজ থেকে শুরু করে উগ্র ডানপন্থী হাভিয়ার মিলেই (বর্তমান প্রেসিডেন্ট)—সবাই ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়ে হামাসকে নিন্দা করলেন। তাঁদের কেউই গাজা, ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের কথা উল্লেখ করলেন না।

বামপন্থী প্রার্থী মেরিয়াম ব্রেগম্যান অবশ্য নিরীহ মানুষের প্রাণহানির ঘটনার দুঃখ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের বিতর্ককালে তিনি বর্তমান সংঘাতের জন্য ইসরায়েলের দখলদারি ও বর্ণবাদকে দায়ী করেন।

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনই ছিল প্রভাববিস্তারী। নতুন প্রেসিডেন্ট মিলেইয়ের প্রশাসন সরাসরি ইসরায়েলপন্থী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। যদিও কিছু আরব গণমাধ্যম ভুলভাবে উপস্থাপন করছে যে লাতিন আমেরিকার সব দেশই ফিলিস্তিনের প্রতি সংবেদনশীল।

গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে আলজাজিরা ফিলিস্তিনের প্রতি লাতিন আমেরিকার ব্যাপক সমর্থনের দৃষ্টান্ত হিসাবে মহাদেশটির সরকারগুলোর বিবৃতি তুলে ধরেছিল। দ্য নিউ আরব–এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ‘লাতিন আমেরিকা কেন ফিলিস্তিনের প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে অঞ্চলটির ক্রমাগত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, বামপন্থী আন্দোলন ও আরব দেশগুলো থেকে যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যাকে কারণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এর বিপরীতে ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ ফার্নান্দো ব্রাঙ্কোলি দেখিয়েছেন রাজনৈতিক মতাদর্শ, অভিবাসী রাজনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো কীভাবে ইসরায়েলপন্থী ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে।

আর্জেন্টিনা-ইসরায়েল সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে অভিবাসী রাজনীতি, বিশেষ করে ইসরায়েলি লবি দেশটির পররাষ্ট্রনীতি বদলে দিতে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে, এমন তথ্য-প্রমাণ খুব একটা নেই।

দীর্ঘদিন ধরেই আর্জেন্টিনা একটা নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রেখে আসছিল। তারা যে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—দুই রাষ্ট্র সমাধান চায়, এই নীতি ছিল তারই প্রতিফলন। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত ১৮১ (২) নম্বর প্রস্তাবটি ভোটদানে বিরত থাকে। এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি দুই রাষ্ট্রে ভাগ করার কথা বলা হয়েছিল।

জাতিসংঘের ৩৩৭৯ নম্বর প্রস্তাবটিতেও ভোটদানে বিরত ছিল আর্জেন্টিনা। এই প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘জায়নবাদ বর্ণবাদ ও বর্ণবাদী বৈষম্যের একটি রূপ।’ ২০১০ সালে জাতিসংঘে উত্থাপিত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রস্তাবে আর্জেন্টিনার সমর্থনটা ছিল অভিবাসী রাজনীতি থেকে পৃথক একটি বিষয়। স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির ফলাফল ছিল সেটি। এ ছাড়া ইহুদি সম্প্রদায় আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। তারা নানা দলে বিভক্ত।

আর্জেন্টাইন সমাজের সঙ্গে ইহুদিদের মিশে যাওয়া এবং এই সম্প্রদায়ের মধ্যকার ভিন্নতা—এই দুই কারণে ইসরায়েলপন্থী এজেন্ডা বাস্তবায়নে দেশটির ইহুদিদের একত্র হওয়ার ক্ষমতা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে অভিবাসী রাজনীতির চেয়ে মতাদর্শিক সখ্য ও নিরাপত্তাসহায়তা অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

-জদর জলিত, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে আর্জেন্টাইন সাংবাদিক ও গবেষক, মিউলইস্ট আই থেকে নেওয়া।