০২:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম নারী জাগরণে আরেক পথিকৃত

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার স্নেহের পরশ পাওয়া অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডভোকেট বাংলাদেশে নারী জাগরণে আরেক পথিকৃত। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় যিনি পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলন, রাজনীতি, বাংলার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে সক্রিয় থেকে অসামান্য অবদান রেখেছেন। প্রচার বিমুখ এই মহিয়সী নারী দেশ, দেশের নারী সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থেকে কাজ করে চলেছেন নীরবে নিভৃতে।

অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডভোকেট, যিনি বর্তমানে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। যিনি ১৯৬৬ সালে ‘বাঙ্গালীর মুক্তিসনদ’ বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯ এর গন-অভ্যূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রলীগের একজন নেত্রী হিসেবে অসামান্য অবদান রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় একজন সক্রিয় সংগঠক ও নেত্রী হিসেবে তৎকালীন পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ), স্বাধীন বাংলাদেশে গণ পরিষদের সদস্য (এমসিএ) এবং ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন মমতাজ বেগম।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করতেন মমতাজ বেগমকে। মমতাজ বেগম বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার স্নেহের পরশ পেয়েছেন তাদের আমৃত্যু। এ বিষয়ে বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি নিয়ে আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করব। অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডভোকেট ১২ই মার্চ ২০০৯ থেকে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব কাছে থেকে রাজনীতি করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। মমতাজ বেগম সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে চেয়ারম্যান (অবৈতনিক) এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তৎকালীন কুমিল্লার কসবা সদরের এক সম্ভ্রান্ত্য মুসলিম পরিবারের সদস্য আব্দুল গণি ভূঁঞা ও জাহানারা খানমের কন্যা মমতাজ বেগম। তার বাবাও কসবা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। মমতাজ বেগমের স্বামী এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। যিনি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। তার স্বামী অধ্যক্ষ, ধানমন্ডি ল’কলেজ, সদস্য ও চেয়ারম্যান, এক্সিকিউটিভ কমিটি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহামন, বাংলাদেশ আওয়াী লীগের উপদেস্টা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। বর্তমানে সৈয়দ রেজাউর রহামন ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান কৌসুঁলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মমতাজ বেগম কুমিল্লা সরকারী মহিলা কলেজের প্রাক্তন ভিপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেত্রী এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অন্যতম নেত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পেশায় অধ্যাপনা করেছেন। উপাধ্যক্ষ হিসেবে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ খেকে অবসরে যান। বর্তমানে আইন পেশায়ও নিয়োজিত রয়েছেন মমতাজ বেগম। রাজনীতি ও সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডে তিনি নারী জাগরণে আরেক দৃষ্টান্ত। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫৮ সামরিক শাসন বিরোধী এবং ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন তিনি।

৬-দফা, ১১ দফা আন্দোলন, ও ৬৯এর গণ অভ্যূত্থানসহ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুরর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সৈয়দ সাজেদা চৌধুরীর বাড়ি মরিচা হাউজে মহিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক পরিচর্যার ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরে কসবায় নিজ বাড়িতে তাঁর ভাই, বাবা ও ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা সিগন্যাল কোরের মেজর বাহারকে একটি বাহিনী গঠন করতে সহযোগিতা করেন। তাঁর কসবাস্থ বাড়ি হয়েই জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানি আগরতলা পৌছান। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় ভারতের আগরতলা সার্কিট হাউজে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মমতাজ বেগম।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলীয় বিএলএফ (মুজিব বাহিনী)-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) পূর্বাঞ্চলীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন মমতাজ বেগম। কর্নেল এম.এ. রব, চীফ অব ষ্টাফের সহযোগিতায় শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে আগরতলায় বিএসএফের হেডকোর্য়াটারে হালকা অস্ত্র ব্যবহার ও যুদ্ধ পরিচালনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন মমতাজ বেগম। বিএলএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের সংগে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি আদান প্রদান করার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আগরতলার বিশালগড়ে বিএলএফের ভাড়া বাড়ীতে শেখ ফজলুল হক মনি ও মমতাজ বেগম তাঁর বাবা-মা’সহ থাকতেন।

গুরুত্বপূর্ন ও গোপনীয় সভা ও যোগাযোগ সব এ বাড়ি হতেই হত। জেনারেল এমএজি ওসমানী ও সেনা কর্মকর্তারা ওই বাড়িতেই যোগাযোগ করতেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় খবরাখবর এখানেই পাঠানো হত। বিএলএফের প্রয়োজনীয় সব অর্থ মমতাজ বেগমে কাছেই রক্ষিত থাকত। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তর থেকে নির্যাতিত মহিলাদের সহযোগিতার জন্য এখানে খবর পাঠানো হতো। প্রয়াত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের স্ত্রী শ্রীমতি গৌরি ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় তাদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নারী পূর্নবাসন রোর্ড প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত এ কাজ চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কসবা এলাকায় শরণার্থীদের মধ্যে যারা ক্যাম্পে থাকেননি তাদের রেশনের ব্যবস্থা করেন এবং বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে উদ্বুদ্ধকরণে অংশ নেন মমতাজ বেগম। ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য(এমসিএ) হিসেবে মমতাজ বেগম বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় সহযোগিতা ও স্বাক্ষর করেন।

১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সদিচ্ছা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত মহিলাদের পূনর্বাসনের জন্য বিচারপতি কে এম সোবাহানের নেতৃত্বে ‘নারী পূনর্বাসন বোর্ড’ গঠিত হলে মমতাজ বেগম ঐ বোর্ডের সদস্য পরিচালক হন এবং তখনই বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের পূর্নবাসনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মমতাজ বেগম কসবা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও নারী পূর্নবাসন বোর্ড, কসবা’র প্রতিষ্ঠাতা।

মমতাজ বেগম ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ মহিলা ফ্রন্ট এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৮সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ এর যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হন। মমতাজ বেগম জাতীয় আইনজীবী সমিতির প্রাক্তন সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রাক্তন সহ-সভাপতি বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) এসোসিয়েশন। মমতাজ বেগম ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সদস্য, লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে সহ-সভানেত্রী হিসেবে নারী ও সমাজের অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামে নিয়োজিত।

১৯৯৬ সাল থেকে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহসভানেত্রী নির্বাচিত হন। মুক্তিযোদ্ধ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ এর সদস্য। মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ এর সদস্য, পরিবার পরিকল্পনা সমিতি বাংলাদেশ এর আজীবন সদস্য, রেডক্রস সোসাইটি বাংলাদেশ এর আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট-এর আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শণ বিভাগ এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য মমতাজ বেগম অধ্যাপক সমিতির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দিন আহাম্মদ এর নেতৃত্বে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন এর আঞ্চলিক কনফারেন্সে (সিডনি, অস্ট্রেলিয়া) যোগদান করেন, ১৯৭৪ সালে বুলগেরিয়ার রাজধানী,সোফিয়াতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে, যোগদান করেন। মমতাজ বেগম ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যভুক্তির রজত জয়ন্তকী অনুষ্ঠানে যোগদান।

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইরাক, সৌদিআরব, ইংল্যান্ড, প্যালেস্টাইনসহ বিভিন্ন ধেশ ভ্রমণ করেন। ২০০২ সালে পবিত্র হজ্জ্ব পালন করেন তিনি। মমতাজ বেগম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, নারী প্রগতি সংঘ, নৌ কমান্ডো এসোসিয়েশন ও নারীকন্ঠ থেকে সম্মাণনা লাভ করেন। মহিয়সী নারী মমতাজ বেগমের জীবনের দীর্ঘ সংগ্রাম, অভিজ্ঞতা ও নানা অর্জন বর্তমান প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় দৃস্টান্ত হবে। আমরা তার জীবনের বিভিন্ন দিক এবং বঙ্গবদ্ধু ও বঙ্গমাতার সঙ্গে তার নানা অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন পাঠকের জন্য তুলে ধরব। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাওয়া মমতাজ বেগমের ভাতা দিয়ে কসবা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস পরিচালিত হয়।

ট্যাগ :

মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম নারী জাগরণে আরেক পথিকৃত

প্রকাশিত : ০৭:৪৮:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার স্নেহের পরশ পাওয়া অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডভোকেট বাংলাদেশে নারী জাগরণে আরেক পথিকৃত। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় যিনি পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলন, রাজনীতি, বাংলার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে সক্রিয় থেকে অসামান্য অবদান রেখেছেন। প্রচার বিমুখ এই মহিয়সী নারী দেশ, দেশের নারী সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থেকে কাজ করে চলেছেন নীরবে নিভৃতে।

অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডভোকেট, যিনি বর্তমানে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। যিনি ১৯৬৬ সালে ‘বাঙ্গালীর মুক্তিসনদ’ বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯ এর গন-অভ্যূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রলীগের একজন নেত্রী হিসেবে অসামান্য অবদান রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় একজন সক্রিয় সংগঠক ও নেত্রী হিসেবে তৎকালীন পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ), স্বাধীন বাংলাদেশে গণ পরিষদের সদস্য (এমসিএ) এবং ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন মমতাজ বেগম।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করতেন মমতাজ বেগমকে। মমতাজ বেগম বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার স্নেহের পরশ পেয়েছেন তাদের আমৃত্যু। এ বিষয়ে বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি নিয়ে আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করব। অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডভোকেট ১২ই মার্চ ২০০৯ থেকে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব কাছে থেকে রাজনীতি করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। মমতাজ বেগম সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে চেয়ারম্যান (অবৈতনিক) এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তৎকালীন কুমিল্লার কসবা সদরের এক সম্ভ্রান্ত্য মুসলিম পরিবারের সদস্য আব্দুল গণি ভূঁঞা ও জাহানারা খানমের কন্যা মমতাজ বেগম। তার বাবাও কসবা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। মমতাজ বেগমের স্বামী এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। যিনি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। তার স্বামী অধ্যক্ষ, ধানমন্ডি ল’কলেজ, সদস্য ও চেয়ারম্যান, এক্সিকিউটিভ কমিটি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহামন, বাংলাদেশ আওয়াী লীগের উপদেস্টা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। বর্তমানে সৈয়দ রেজাউর রহামন ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান কৌসুঁলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মমতাজ বেগম কুমিল্লা সরকারী মহিলা কলেজের প্রাক্তন ভিপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেত্রী এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অন্যতম নেত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পেশায় অধ্যাপনা করেছেন। উপাধ্যক্ষ হিসেবে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ খেকে অবসরে যান। বর্তমানে আইন পেশায়ও নিয়োজিত রয়েছেন মমতাজ বেগম। রাজনীতি ও সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডে তিনি নারী জাগরণে আরেক দৃষ্টান্ত। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫৮ সামরিক শাসন বিরোধী এবং ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন তিনি।

৬-দফা, ১১ দফা আন্দোলন, ও ৬৯এর গণ অভ্যূত্থানসহ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুরর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সৈয়দ সাজেদা চৌধুরীর বাড়ি মরিচা হাউজে মহিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক পরিচর্যার ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরে কসবায় নিজ বাড়িতে তাঁর ভাই, বাবা ও ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা সিগন্যাল কোরের মেজর বাহারকে একটি বাহিনী গঠন করতে সহযোগিতা করেন। তাঁর কসবাস্থ বাড়ি হয়েই জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানি আগরতলা পৌছান। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় ভারতের আগরতলা সার্কিট হাউজে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মমতাজ বেগম।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলীয় বিএলএফ (মুজিব বাহিনী)-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) পূর্বাঞ্চলীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন মমতাজ বেগম। কর্নেল এম.এ. রব, চীফ অব ষ্টাফের সহযোগিতায় শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে আগরতলায় বিএসএফের হেডকোর্য়াটারে হালকা অস্ত্র ব্যবহার ও যুদ্ধ পরিচালনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন মমতাজ বেগম। বিএলএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের সংগে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি আদান প্রদান করার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আগরতলার বিশালগড়ে বিএলএফের ভাড়া বাড়ীতে শেখ ফজলুল হক মনি ও মমতাজ বেগম তাঁর বাবা-মা’সহ থাকতেন।

গুরুত্বপূর্ন ও গোপনীয় সভা ও যোগাযোগ সব এ বাড়ি হতেই হত। জেনারেল এমএজি ওসমানী ও সেনা কর্মকর্তারা ওই বাড়িতেই যোগাযোগ করতেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় খবরাখবর এখানেই পাঠানো হত। বিএলএফের প্রয়োজনীয় সব অর্থ মমতাজ বেগমে কাছেই রক্ষিত থাকত। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তর থেকে নির্যাতিত মহিলাদের সহযোগিতার জন্য এখানে খবর পাঠানো হতো। প্রয়াত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের স্ত্রী শ্রীমতি গৌরি ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় তাদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নারী পূর্নবাসন রোর্ড প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত এ কাজ চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কসবা এলাকায় শরণার্থীদের মধ্যে যারা ক্যাম্পে থাকেননি তাদের রেশনের ব্যবস্থা করেন এবং বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে উদ্বুদ্ধকরণে অংশ নেন মমতাজ বেগম। ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য(এমসিএ) হিসেবে মমতাজ বেগম বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় সহযোগিতা ও স্বাক্ষর করেন।

১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সদিচ্ছা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত মহিলাদের পূনর্বাসনের জন্য বিচারপতি কে এম সোবাহানের নেতৃত্বে ‘নারী পূনর্বাসন বোর্ড’ গঠিত হলে মমতাজ বেগম ঐ বোর্ডের সদস্য পরিচালক হন এবং তখনই বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের পূর্নবাসনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মমতাজ বেগম কসবা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও নারী পূর্নবাসন বোর্ড, কসবা’র প্রতিষ্ঠাতা।

মমতাজ বেগম ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ মহিলা ফ্রন্ট এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৮সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ এর যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হন। মমতাজ বেগম জাতীয় আইনজীবী সমিতির প্রাক্তন সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রাক্তন সহ-সভাপতি বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) এসোসিয়েশন। মমতাজ বেগম ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সদস্য, লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে সহ-সভানেত্রী হিসেবে নারী ও সমাজের অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামে নিয়োজিত।

১৯৯৬ সাল থেকে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহসভানেত্রী নির্বাচিত হন। মুক্তিযোদ্ধ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ এর সদস্য। মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ এর সদস্য, পরিবার পরিকল্পনা সমিতি বাংলাদেশ এর আজীবন সদস্য, রেডক্রস সোসাইটি বাংলাদেশ এর আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট-এর আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শণ বিভাগ এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য মমতাজ বেগম অধ্যাপক সমিতির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দিন আহাম্মদ এর নেতৃত্বে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন এর আঞ্চলিক কনফারেন্সে (সিডনি, অস্ট্রেলিয়া) যোগদান করেন, ১৯৭৪ সালে বুলগেরিয়ার রাজধানী,সোফিয়াতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে, যোগদান করেন। মমতাজ বেগম ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যভুক্তির রজত জয়ন্তকী অনুষ্ঠানে যোগদান।

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইরাক, সৌদিআরব, ইংল্যান্ড, প্যালেস্টাইনসহ বিভিন্ন ধেশ ভ্রমণ করেন। ২০০২ সালে পবিত্র হজ্জ্ব পালন করেন তিনি। মমতাজ বেগম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, নারী প্রগতি সংঘ, নৌ কমান্ডো এসোসিয়েশন ও নারীকন্ঠ থেকে সম্মাণনা লাভ করেন। মহিয়সী নারী মমতাজ বেগমের জীবনের দীর্ঘ সংগ্রাম, অভিজ্ঞতা ও নানা অর্জন বর্তমান প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় দৃস্টান্ত হবে। আমরা তার জীবনের বিভিন্ন দিক এবং বঙ্গবদ্ধু ও বঙ্গমাতার সঙ্গে তার নানা অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন পাঠকের জন্য তুলে ধরব। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাওয়া মমতাজ বেগমের ভাতা দিয়ে কসবা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস পরিচালিত হয়।