০১:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

ফ্লাইওভারের নিচে ওদের ঠিকানা

রাজপথই ওদের ঘর। পথেই কাজ, পথেই খাওয়া, পথেই ঘুম। সকালে ঘুম ভাঙে ঠিকই, তবে জীবন থেকে আঁধার দূর হয় না। সকালের সূর্য হাসি ছড়ায় না পথশিশুদের জীবনে।
ওদের সকাল মানেই ‘ক্ষুধার বাস্তবতা’। এ কারণে প্রতিদিন সকালে কাজের সন্ধানে বের হতে হয় ওদের। কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। দিনভর কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চায়। ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। কিন্তু ঘর না-থাকায় অনিরাপদ রাস্তা, ফুটপাত, পরিত্যক্ত নোংরা কোনো ঘর হয়ে ওঠে ওদের বিশ্রামের জায়গা। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশ ওদের ঘুমাতে দেয় না। তবুও এভাবেই কাটে প্রতি রাত। প্রতিনিয়ত এমন অপর্যাপ্ত ঘুম পথশিশুদের ঠেলে দিচ্ছে নানারকম শারীরিক-মানসিক ঝুঁকিতে।

পথ ও শিশু, এই দুই শব্দের সন্ধিতে সৃষ্টি হয়েছে ‘পথশিশু’ নামে নতুন একটি শব্দ। রাষ্ট্রীয় নাগরিকের খতিয়ানেও পথশিশু বলতে কোনো শব্দ নেই। সমাজ গবেষকদের মতে, এ ধরনের কোনো প্রপঞ্চ থাকাও উচিত না। তবু সমাজে ওদের পরিচয় ‘পথশিশু’। পথশিশু শব্দটি সেসব শিশুদের নির্দেশ করে, যাদের কাছে রাস্তাই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক বাসস্থান। মৌলিক প্রয়োজন নির্বাহের একমাত্র উৎসও সেই রাস্তা। দায়িত্বশীল কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কর্তৃক সুরক্ষিত-পরিচালিত নয় এমন শিশুরাই ‘পথশিশু’।

ঢাকার পথে খোঁজ মিলবে এমন অগণিত পথশিশুর। এসব শিশু সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। সেসব জীবনের গল্পগুলোও অমসৃণ। ওরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে অনাদরে ও অবহেলায় দিন কাটায়। ওদের ঠিকানা নেই, বসবাসের ঘর নেই, স্কুলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, শিক্ষা লাভের সুযোগ নেই। এমনকি স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে একটু খাওয়া-ঘুমের ব্যবস্থাও নেই।

ঢাকার বিভিন্ন ফুট ওভার ব্রিজে ঘুমিয়ে থাকে পথশিশুরা

পথে ঘুমানো একাধিক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওদের জীবন দুর্বিষহ। দিনে ওরা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বোতল, প্লাস্টিকের টুকরো, ভাঙারি সংগ্রহ ও বিক্রি করে। দিনভর কুড়িয়ে সময় কাটে। দিনের বেলায় কষ্ট অনুভবের সময় থাকে না। তবে, রাতের ঘুমই সবচেয়ে বেশি কষ্টের। শীত কিংবা বৃষ্টিতে বড় বেশি কষ্ট হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, আষাঢ়ের বৃষ্টি, মাঘের শীত, চৈত্রের ভ্যাপসা গরম সব কিছু সঙ্গী করেই পথেই ঘুমায় পথশিশুরা। পাশাপাশি ধুলোয় ধূসর পরিবেশ আর গাড়ির শব্দ তো আছেই। রাস্তার কুকুর-বিড়ালরা এসব শিশুর ঘুমের সঙ্গী হয়। বালিশ, কাঁথা, তোষক ও চাদর কিছুই নেই। ছেঁড়া পোস্টার, মালামালের বস্তা, কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া পাটিতে কয়েকজন মিলে ঘুমায়। সাধারণত শহরের রাস্তার ফুটপাত, খোলা আকাশ, পার্ক, রেলস্টেশন, ওয়াকওয়ে, ফ্লাইওভারের নিচে, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনিতে ওরা রাত কাটায়। আজ এখানে, তো কাল ওখানে।

তবে এভাবে তো ঘুম হয় না। হবেই বা কী করে? রাস্তা তো ঘুমের জায়গা না। কিন্তু উপায় তো নেই। নিয়তি ওদের রাস্তায়ই ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। তাই ঘুমহীন রাতকেই ওরা সঙ্গী করে। রাতের রাস্তাকে ওরা মানিয়ে নেয়। পথশিশুদের পথে নামার প্রথম দিকে এই ঘুমহীনতাই তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক বিষয় হয়ে ওঠে। তারা উপায় খুঁজতে থাকে, কী করে ভালো ঘুমানো যায়। পরবর্তীতে তারা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

সকাল ৭টা। ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনে দক্ষিণ পাশের প্লাটফর্মে দেখা মেলে ঘুমন্ত অসংখ্য পথশিশুর। ওরা সবাই অচেতনের মতো ঘুমাচ্ছিল। সকাল ৮টার দিকে স্টেশনের নিরাপত্তা রক্ষীরা এসে ওদের জাগানোর চেষ্টা করেন, তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিরাপত্তা রক্ষীদের দাবি, স্বাভাবিকভাবে ডাকলে ওদের ঘুম ভাঙে না, তাই লাঠি ব্যবহার করেন। এভাবে নিরাপত্তা রক্ষী ও পুলিশ সদস্যদের লাঠির আঘাতে প্রতিদিন এখানকার পথশিশুদের ঘুম ভাঙে।

বিমানবন্দর স্টেশনে দায়িত্বরত রেলওয়ে পুলিশের সিপাহী রুহুল আমিন বলেন, এভাবে স্টেশনজুড়ে এখানে-সেখানে মানুষ ঘুমিয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু। এতে স্টেশনের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়। পাশাপাশি পরিবেশও নষ্ট হয়। এ ছাড়াও স্টেশনে বিদেশিসহ নানা শ্রেণির যাত্রী আসে। এভাবে শুয়ে থাকলে যাত্রীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে আমরা ওদের তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হই।

দিনভর কাজ শেষে ক্লান্তদেহে রাস্তায় যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ে পথশিশুরা

স্টেশনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মী সোহাগ মিয়া জানালেন, রেলস্টেশনে রাত কাটানো শিশুদের অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত। বিশেষ করে ওরা ড্যান্ডিতে আসক্ত। তাই ওরা যেখানে-সেখানে হুট করে শুয়ে পড়ে, অচেতনের মতো ঘুমিয়ে যায়। এরা যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে। নেশা করে ঘুমানোর ফলে কাপড় পরা অবস্থায় এরা ঘুমের মধ্যে মলমূত্র ত্যাগ করে। এতে প্লাটফর্মে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়েই ওদের তাড়াতে হয়।

স্টেশনে সদ্য ঘুমভাঙা এক পথশিশু ঈসা (ছদ্মনাম)। ঘুম ভাঙলেও যেন ঘুম জড়িয়ে ছিল দুই চোখে। ঈসা ক্ষুধার্ত ছিল, কিছু খাবারের আকুতি ছিল তার। খেতে খেতে বেশ অনেক কথা জানায় শিশুটি। ঘুম প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে ঈসা বলে, স্টেশনের মধ্যে ঘুমালে এক-দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমানো যায় না। স্টেশনের বাইরে ওভার ব্রিজের ওপরে ঘুমালে একটু বেশি ঘুমানো যায়। তবে, সেখানে অনেকেই ঘুমায়, তাই জায়গা পাওয়া কঠিন। আবার ওভার ব্রিজে ঘুমালে খুব সকালে মানুষ হাঁটাচলা শুরু করলেই পুলিশ এসে মেরে ওদের তাড়িয়ে দেয়।

জানা যায়, বিমানবন্দর রেল স্টেশনে নিয়ম অনুযায়ী রাত ১২টার দিকে, রাত ২টার দিকে একবার, ভোর ৪-৫টার দিকে আরেকবার নিরাপত্তা কর্মীরা পালাক্রমে পরিদর্শনে আসেন। তখন এলোমেলো ঘুমিয়ে থাকা লোকজন, ভিক্ষুক বা কোনো পথশিশু থাকলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর নিরাপত্তা রক্ষীরা এলেই ঘুমচোখে পালাতে হয়। পরে নিরাপত্তা রক্ষীরা একটু সরলেই আবার তারা এলোমেলো, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু ঘুমের আকুতিতে, এ যেন চোর পুলিশ খেলা।

এত গেল কেবল একটি স্টেশনের পরিস্থিতি। রাজধানীতে অগণিত পথশিশু থাকলেও কোথাও তাদের একটু স্বাচ্ছন্দে ঘুমের জায়গা মেলে না। স্টেশনে মানুষের যাতায়াত, রাস্তায় গাড়ির চলাচল, পার্কে নিরাপত্তা বিঘ্নিতসহ সব জায়গা থেকে কোনো না কোনো কারণে বিতাড়িত হয় পথশিশুরা। ওদের ঘুমের জায়গা পাওয়া কষ্টসাধ্য। এমন জটিল জীবনযাত্রার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে পথশিশুরা।

চাদর-বালিশ-কাঁথাবিহীন হয় পথশিশুর বিছানা

সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) ২০১৬ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে, রাস্তায় থাকা শিশুদের মধ্যে ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো জায়গা-বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ শিশু খোলা স্থানে মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলেও তাদের দেখাশোনার কেউ থাকে না, ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায় না। পথশিশুদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত। রাস্তায় থাকা ৮৪ শতাংশ শিশুর শীতবস্ত্র নেই, জীবন ধারণের প্রয়োজনে ৮০ শতাংশ শিশু কাজ করে, ২০ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়, ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু সার্বিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে ঘুম একটি বাধ্যগত অংশ। প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্ন ঘুম যে কোনো মানুষের মেধা কার্যকর রাখে। প্রয়োজনীয় ঘুম মানুষের শরীর সুস্থ রাখে। ঘুম শারীরিক অঙ্গগুলোকে ভেতর থেকে সুস্থ রাখে। আর সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে ব্লাড প্রেসার, সুগার বেড়ে যেতে পারে। ঘুমের অভাবে মাথাব্যথা ও চোখের হাজারো সমস্যা দেখা যায়। নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে, একজন মানুষ ক্রমাগত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হবেন। যার কারণে একটি সুন্দর জীবনও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, যাদের বয়স ৬ থেকে ৯, তাদের কমপক্ষে ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। আর যাদের বয়স ১০ থেকে ১৭, তাদের প্রয়োজন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। প্রয়োজনীয় এই ঘুম থেকেই বঞ্চিত পথশিশুরা। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ছোট্ট বয়সেই ওরা ধারণ করে নানা রকম শারীরিক-মানসিক রোগ। আর সেসব রোগের ওষুধ বা চিকিৎসাও মেলে না। ফলে, শরীরের সঙ্গে নিজের রোগকেও সঙ্গী বানিয়ে নিতে বাধ্য হয় ওরা।

অনিয়মিত ঘুমের বিষয়ে কথা হলে ঢাকা আজগর আলী হাসপাতালে কর্মরত বক্ষব্যাধী বিশেষজ্ঞ ডা. রাজীব কুমার শাহ বলেন, মস্তিষ্কে ওরেক্সিন নামে একটি নিউরোট্রান্সমিটার আছে, যা মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ওরেক্সিন উৎপাদনের গতি মন্থর হয়ে যায়। ঘুম শরীরের ক্ষতিপূরণ ও শক্তি সঞ্চয়ের একটি পন্থা। তাই ঘুম কম হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়।

পথশিশুদের ঘুমহীন জীবনের বিষয়ে কথা হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা সামসাদ বলেন, শরীরের প্রতিটি টিস্যুকে নতুন করে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে ঘুম। যে কোনো বয়সের মানুষের জন্যই প্রয়োজনীয় ঘুম অত্যাবশ্যক। শিশুদের জন্য এটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে পথশিশুরা যেভাবে জীবন কাটায়, তা বিপজ্জনক। এমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা শুধু শারীরিক নয় মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। এমনকি দীর্ঘদিন নির্ঘুম থাকায় মস্তিস্ক বিকৃত হয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে। এর পরিণতি ভয়াবহ। এ সমস্যার সমাধান একটাই, তা হচ্ছে- পুনর্বাসন।

ঢাকার পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জুম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এস টি শাহীন বলেন, পথশিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ নানা প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত। পথশিশুদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষায় প্রথমেই শিশুদের শেল্টার হোমের আওতায় আনা জরুরি। যদিও ঢাকার কিছু কিছু এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি শেল্টার হোম আছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যদি ঢাকায় এলাকাভিত্তিক আরো কিছু শিশুবান্ধব শেল্টার হোম নির্মাণ করা যায় তবে শিশুদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।

তিনি আরো বলেন, তাদের জীবনের উন্নতির জন্য একটি পরিকল্পনা দরকার। নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সরকার যে যার মতো কাজ করছে। এদের সমন্বয় দরকার। এতে পরিকল্পিত কাজ হবে, এবং প্রতিটি শিশুর খুব কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব

জনপ্রিয়

মুরাদনগরের সাবেক ৫বারের এমপি কায়কোবাদের অপেক্ষায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ

ফ্লাইওভারের নিচে ওদের ঠিকানা

প্রকাশিত : ০১:২৯:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ অগাস্ট ২০২২

রাজপথই ওদের ঘর। পথেই কাজ, পথেই খাওয়া, পথেই ঘুম। সকালে ঘুম ভাঙে ঠিকই, তবে জীবন থেকে আঁধার দূর হয় না। সকালের সূর্য হাসি ছড়ায় না পথশিশুদের জীবনে।
ওদের সকাল মানেই ‘ক্ষুধার বাস্তবতা’। এ কারণে প্রতিদিন সকালে কাজের সন্ধানে বের হতে হয় ওদের। কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। দিনভর কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চায়। ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। কিন্তু ঘর না-থাকায় অনিরাপদ রাস্তা, ফুটপাত, পরিত্যক্ত নোংরা কোনো ঘর হয়ে ওঠে ওদের বিশ্রামের জায়গা। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশ ওদের ঘুমাতে দেয় না। তবুও এভাবেই কাটে প্রতি রাত। প্রতিনিয়ত এমন অপর্যাপ্ত ঘুম পথশিশুদের ঠেলে দিচ্ছে নানারকম শারীরিক-মানসিক ঝুঁকিতে।

পথ ও শিশু, এই দুই শব্দের সন্ধিতে সৃষ্টি হয়েছে ‘পথশিশু’ নামে নতুন একটি শব্দ। রাষ্ট্রীয় নাগরিকের খতিয়ানেও পথশিশু বলতে কোনো শব্দ নেই। সমাজ গবেষকদের মতে, এ ধরনের কোনো প্রপঞ্চ থাকাও উচিত না। তবু সমাজে ওদের পরিচয় ‘পথশিশু’। পথশিশু শব্দটি সেসব শিশুদের নির্দেশ করে, যাদের কাছে রাস্তাই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক বাসস্থান। মৌলিক প্রয়োজন নির্বাহের একমাত্র উৎসও সেই রাস্তা। দায়িত্বশীল কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কর্তৃক সুরক্ষিত-পরিচালিত নয় এমন শিশুরাই ‘পথশিশু’।

ঢাকার পথে খোঁজ মিলবে এমন অগণিত পথশিশুর। এসব শিশু সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। সেসব জীবনের গল্পগুলোও অমসৃণ। ওরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে অনাদরে ও অবহেলায় দিন কাটায়। ওদের ঠিকানা নেই, বসবাসের ঘর নেই, স্কুলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, শিক্ষা লাভের সুযোগ নেই। এমনকি স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে একটু খাওয়া-ঘুমের ব্যবস্থাও নেই।

ঢাকার বিভিন্ন ফুট ওভার ব্রিজে ঘুমিয়ে থাকে পথশিশুরা

পথে ঘুমানো একাধিক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওদের জীবন দুর্বিষহ। দিনে ওরা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বোতল, প্লাস্টিকের টুকরো, ভাঙারি সংগ্রহ ও বিক্রি করে। দিনভর কুড়িয়ে সময় কাটে। দিনের বেলায় কষ্ট অনুভবের সময় থাকে না। তবে, রাতের ঘুমই সবচেয়ে বেশি কষ্টের। শীত কিংবা বৃষ্টিতে বড় বেশি কষ্ট হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, আষাঢ়ের বৃষ্টি, মাঘের শীত, চৈত্রের ভ্যাপসা গরম সব কিছু সঙ্গী করেই পথেই ঘুমায় পথশিশুরা। পাশাপাশি ধুলোয় ধূসর পরিবেশ আর গাড়ির শব্দ তো আছেই। রাস্তার কুকুর-বিড়ালরা এসব শিশুর ঘুমের সঙ্গী হয়। বালিশ, কাঁথা, তোষক ও চাদর কিছুই নেই। ছেঁড়া পোস্টার, মালামালের বস্তা, কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া পাটিতে কয়েকজন মিলে ঘুমায়। সাধারণত শহরের রাস্তার ফুটপাত, খোলা আকাশ, পার্ক, রেলস্টেশন, ওয়াকওয়ে, ফ্লাইওভারের নিচে, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনিতে ওরা রাত কাটায়। আজ এখানে, তো কাল ওখানে।

তবে এভাবে তো ঘুম হয় না। হবেই বা কী করে? রাস্তা তো ঘুমের জায়গা না। কিন্তু উপায় তো নেই। নিয়তি ওদের রাস্তায়ই ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। তাই ঘুমহীন রাতকেই ওরা সঙ্গী করে। রাতের রাস্তাকে ওরা মানিয়ে নেয়। পথশিশুদের পথে নামার প্রথম দিকে এই ঘুমহীনতাই তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক বিষয় হয়ে ওঠে। তারা উপায় খুঁজতে থাকে, কী করে ভালো ঘুমানো যায়। পরবর্তীতে তারা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

সকাল ৭টা। ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনে দক্ষিণ পাশের প্লাটফর্মে দেখা মেলে ঘুমন্ত অসংখ্য পথশিশুর। ওরা সবাই অচেতনের মতো ঘুমাচ্ছিল। সকাল ৮টার দিকে স্টেশনের নিরাপত্তা রক্ষীরা এসে ওদের জাগানোর চেষ্টা করেন, তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিরাপত্তা রক্ষীদের দাবি, স্বাভাবিকভাবে ডাকলে ওদের ঘুম ভাঙে না, তাই লাঠি ব্যবহার করেন। এভাবে নিরাপত্তা রক্ষী ও পুলিশ সদস্যদের লাঠির আঘাতে প্রতিদিন এখানকার পথশিশুদের ঘুম ভাঙে।

বিমানবন্দর স্টেশনে দায়িত্বরত রেলওয়ে পুলিশের সিপাহী রুহুল আমিন বলেন, এভাবে স্টেশনজুড়ে এখানে-সেখানে মানুষ ঘুমিয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু। এতে স্টেশনের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়। পাশাপাশি পরিবেশও নষ্ট হয়। এ ছাড়াও স্টেশনে বিদেশিসহ নানা শ্রেণির যাত্রী আসে। এভাবে শুয়ে থাকলে যাত্রীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে আমরা ওদের তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হই।

দিনভর কাজ শেষে ক্লান্তদেহে রাস্তায় যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ে পথশিশুরা

স্টেশনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মী সোহাগ মিয়া জানালেন, রেলস্টেশনে রাত কাটানো শিশুদের অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত। বিশেষ করে ওরা ড্যান্ডিতে আসক্ত। তাই ওরা যেখানে-সেখানে হুট করে শুয়ে পড়ে, অচেতনের মতো ঘুমিয়ে যায়। এরা যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে। নেশা করে ঘুমানোর ফলে কাপড় পরা অবস্থায় এরা ঘুমের মধ্যে মলমূত্র ত্যাগ করে। এতে প্লাটফর্মে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়েই ওদের তাড়াতে হয়।

স্টেশনে সদ্য ঘুমভাঙা এক পথশিশু ঈসা (ছদ্মনাম)। ঘুম ভাঙলেও যেন ঘুম জড়িয়ে ছিল দুই চোখে। ঈসা ক্ষুধার্ত ছিল, কিছু খাবারের আকুতি ছিল তার। খেতে খেতে বেশ অনেক কথা জানায় শিশুটি। ঘুম প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে ঈসা বলে, স্টেশনের মধ্যে ঘুমালে এক-দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমানো যায় না। স্টেশনের বাইরে ওভার ব্রিজের ওপরে ঘুমালে একটু বেশি ঘুমানো যায়। তবে, সেখানে অনেকেই ঘুমায়, তাই জায়গা পাওয়া কঠিন। আবার ওভার ব্রিজে ঘুমালে খুব সকালে মানুষ হাঁটাচলা শুরু করলেই পুলিশ এসে মেরে ওদের তাড়িয়ে দেয়।

জানা যায়, বিমানবন্দর রেল স্টেশনে নিয়ম অনুযায়ী রাত ১২টার দিকে, রাত ২টার দিকে একবার, ভোর ৪-৫টার দিকে আরেকবার নিরাপত্তা কর্মীরা পালাক্রমে পরিদর্শনে আসেন। তখন এলোমেলো ঘুমিয়ে থাকা লোকজন, ভিক্ষুক বা কোনো পথশিশু থাকলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর নিরাপত্তা রক্ষীরা এলেই ঘুমচোখে পালাতে হয়। পরে নিরাপত্তা রক্ষীরা একটু সরলেই আবার তারা এলোমেলো, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু ঘুমের আকুতিতে, এ যেন চোর পুলিশ খেলা।

এত গেল কেবল একটি স্টেশনের পরিস্থিতি। রাজধানীতে অগণিত পথশিশু থাকলেও কোথাও তাদের একটু স্বাচ্ছন্দে ঘুমের জায়গা মেলে না। স্টেশনে মানুষের যাতায়াত, রাস্তায় গাড়ির চলাচল, পার্কে নিরাপত্তা বিঘ্নিতসহ সব জায়গা থেকে কোনো না কোনো কারণে বিতাড়িত হয় পথশিশুরা। ওদের ঘুমের জায়গা পাওয়া কষ্টসাধ্য। এমন জটিল জীবনযাত্রার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে পথশিশুরা।

চাদর-বালিশ-কাঁথাবিহীন হয় পথশিশুর বিছানা

সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) ২০১৬ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে, রাস্তায় থাকা শিশুদের মধ্যে ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো জায়গা-বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ শিশু খোলা স্থানে মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলেও তাদের দেখাশোনার কেউ থাকে না, ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায় না। পথশিশুদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত। রাস্তায় থাকা ৮৪ শতাংশ শিশুর শীতবস্ত্র নেই, জীবন ধারণের প্রয়োজনে ৮০ শতাংশ শিশু কাজ করে, ২০ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়, ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু সার্বিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে ঘুম একটি বাধ্যগত অংশ। প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্ন ঘুম যে কোনো মানুষের মেধা কার্যকর রাখে। প্রয়োজনীয় ঘুম মানুষের শরীর সুস্থ রাখে। ঘুম শারীরিক অঙ্গগুলোকে ভেতর থেকে সুস্থ রাখে। আর সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে ব্লাড প্রেসার, সুগার বেড়ে যেতে পারে। ঘুমের অভাবে মাথাব্যথা ও চোখের হাজারো সমস্যা দেখা যায়। নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে, একজন মানুষ ক্রমাগত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হবেন। যার কারণে একটি সুন্দর জীবনও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, যাদের বয়স ৬ থেকে ৯, তাদের কমপক্ষে ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। আর যাদের বয়স ১০ থেকে ১৭, তাদের প্রয়োজন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। প্রয়োজনীয় এই ঘুম থেকেই বঞ্চিত পথশিশুরা। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ছোট্ট বয়সেই ওরা ধারণ করে নানা রকম শারীরিক-মানসিক রোগ। আর সেসব রোগের ওষুধ বা চিকিৎসাও মেলে না। ফলে, শরীরের সঙ্গে নিজের রোগকেও সঙ্গী বানিয়ে নিতে বাধ্য হয় ওরা।

অনিয়মিত ঘুমের বিষয়ে কথা হলে ঢাকা আজগর আলী হাসপাতালে কর্মরত বক্ষব্যাধী বিশেষজ্ঞ ডা. রাজীব কুমার শাহ বলেন, মস্তিষ্কে ওরেক্সিন নামে একটি নিউরোট্রান্সমিটার আছে, যা মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ওরেক্সিন উৎপাদনের গতি মন্থর হয়ে যায়। ঘুম শরীরের ক্ষতিপূরণ ও শক্তি সঞ্চয়ের একটি পন্থা। তাই ঘুম কম হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়।

পথশিশুদের ঘুমহীন জীবনের বিষয়ে কথা হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা সামসাদ বলেন, শরীরের প্রতিটি টিস্যুকে নতুন করে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে ঘুম। যে কোনো বয়সের মানুষের জন্যই প্রয়োজনীয় ঘুম অত্যাবশ্যক। শিশুদের জন্য এটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে পথশিশুরা যেভাবে জীবন কাটায়, তা বিপজ্জনক। এমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা শুধু শারীরিক নয় মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। এমনকি দীর্ঘদিন নির্ঘুম থাকায় মস্তিস্ক বিকৃত হয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে। এর পরিণতি ভয়াবহ। এ সমস্যার সমাধান একটাই, তা হচ্ছে- পুনর্বাসন।

ঢাকার পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জুম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এস টি শাহীন বলেন, পথশিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ নানা প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত। পথশিশুদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষায় প্রথমেই শিশুদের শেল্টার হোমের আওতায় আনা জরুরি। যদিও ঢাকার কিছু কিছু এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি শেল্টার হোম আছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যদি ঢাকায় এলাকাভিত্তিক আরো কিছু শিশুবান্ধব শেল্টার হোম নির্মাণ করা যায় তবে শিশুদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।

তিনি আরো বলেন, তাদের জীবনের উন্নতির জন্য একটি পরিকল্পনা দরকার। নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সরকার যে যার মতো কাজ করছে। এদের সমন্বয় দরকার। এতে পরিকল্পিত কাজ হবে, এবং প্রতিটি শিশুর খুব কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব