০৫:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে

২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগের প্রত্যাশা রয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে কিছু বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন। জাপান, ভারত ও চীনের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও কম-বেশি এগিয়েছে। তবে বিদ্যমান জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটে বেজার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ফিকে হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগের বৃহৎ পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বর্তমান বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগ আসা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যখন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর পরিকল্পনা নেয়া হয়, সে সময় চীন থেকে অনেক বিনিয়োগই বাংলাদেশে আসবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সংকটে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগের পরিকল্পনা স্থগিত করে রেখেছেন। কারণ কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার নিশ্চয়তা এখন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলেও তেল সরবরাহ নিশ্চিত না হলে কী করে সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

তবে বেজা সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে যে কার্যক্রম চলমান আছে সেগুলোয় শিল্পের ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। সব শিল্পই যে গ্যাসনির্ভর এমন নয়। বিদ্যুতের চলমান সমস্যা অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকেও ছুঁয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চলমান রাখা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। তবে গ্যাসনির্ভর যে শিল্পগুলো হয়েছে, সেগুলোয় প্রভাব পড়বে না। কারণ গ্যাসনির্ভর শিল্প সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বেশির ভাগ শিল্পেরই বিদ্যুিনর্ভরতা বেশি। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চারটি শিল্প উৎপাদনে গিয়েছে। চারটিই বিদ্যুিনর্ভর। বিকল্প হিসেবে এ শিল্পগুলোর জেনারেটর সংযোগ রয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বেজার আসন্ন বৈঠকে বিদ্যুতের অপ্রতুলতার বিষয়ে অভিযোগ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বিশেষ একটা সুবিধা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পায় জানিয়ে বেজা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিদ্যুতের সংযোগ আছে দুটি করে। একটা থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকলে আরেকটা দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রাখা হয় শিল্পে। সামগ্রিকভাবে যে শিল্পগুলো এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদনে আছে, সেখানে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ঘনীভূত হয়নি। গ্যাসভিত্তিক শিল্পায়নের প্রক্ষেপণও বেজায় আছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বর্তমানে দৈনিক ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, তবে তার ব্যবহার অনেক কম। বিদ্যমান সরবরাহ সক্ষমতা থেকে আরো অনেকগুলো শিল্প গড়ে উঠতে পারবে ওখানে। তবে কিছুটা হলেও সমস্যা হচ্ছে বিদ্যমান সংকটাবস্থায়। সংকটের এ পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি আরো বিরূপ হবে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের অর্থলগ্নি নিয়ে মনোবল এখন পর্যন্ত ইতিবাচকই রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানির যে সংকট, সেটা সবাইকে মানতে হবে এবং হচ্ছে। কারণ সবাই বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই অগ্রসর হচ্ছে। তার পরও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো। জমি বরাদ্দও হচ্ছে নিয়মিতভাবে। অনেকে কাজ শুরু করেছেন, অনেকে এরই মধ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আশা করছি খুব দ্রুতই বিদ্যমান সংকট কেটে যাবে। সংকট মূলত জ্বালানি নিয়ে, বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ। দুটোই নির্ভর করে সরকারের ওপর। আমরা সরকারের সাহায্যপ্রার্থী। সরকার যদি সমাধান করতে পারে, আমাদেরটাও সমাধান হবে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চারটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গিয়েছে, বাকিগুলো তৈরি হচ্ছে। যেগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোয় কারখানা শেড, যন্ত্রপাতি স্থাপনের কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন হতে হতে সংকট কেটে যাবে এমন প্রত্যাশা করছি।

জানা গিয়েছে, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেজার পক্ষ থেকে সমাপ্ত কার্যক্রমগুলোর মধ্যে আছে প্রায় ১০ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ ও তিনটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার নির্মাণ। প্রায় ২০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ ও একটি ৩৩/১১ কেভিএ সাব-স্টেশন নির্মাণ। এছাড়া পানি সরবরাহের জন্য ১৫টি প্রডাকশন টিউবওয়েল স্থাপন। এছাড়া বিনিয়োগের ভৌত অবকাঠামো-সংক্রান্ত আরো কিছু কার্যক্রমের মধ্যে আছে ১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ২৩০ কেভিএ গ্রিড লাইন ও সাব-স্টেশন নির্মাণ। এছাড়া পানি সরবরাহের জন্য ১০টি প্রডাকশন টিউবওয়েল নির্মাণ।

বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তারা বলছেন, সহজলভ্য শ্রমের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প কম। থাকার মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আছে ইন্দোনেশিয়া। মিয়ানমারে বিনিয়োগকারীদের যাওয়ার আগ্রহ তুলনামূলক কম। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক। কিন্তু এখন সরকারকে উঠে পড়ে লাগতে হবে বড় না হলেও মাঝারি আকারের বিনিয়োগকারী আকর্ষণের জন্য। বর্তমানে জ্বালানি সংকট একটা অস্থায়ী যুদ্ধের মতো। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে আশাবাদী বিনিয়োগকারীরা। তবে আমলাতন্ত্রকে সহজ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। বিনিয়োগকারীরা যেন অনলাইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে সব সেবা পেতে পারেন, এমন নিশ্চয়তা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ ধরে রাখতে অন্তত একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল খুব ভালো করে সক্রিয় করা প্রয়োজন।

জানতে চাইলে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি রুপালী চৌধুরী বলেন, অনেক অমীমাংসিত বিষয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে। যেমন পানি ও বিদ্যুতের সারচার্জ। এগুলো এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। এদিকে সারা পৃথিবীতে এখন মন্দা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও আছে। তবে অনেক সম্ভাবনার মধ্যেও বর্তমানে জ্বালানি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মহেশখালী থেকে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল। সেই কাজগুলো এখন অনেক দ্রুত শেষ হওয়া উচিত। গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা এখন মারাত্মক। কিন্তু বর্তমান জ্বালানি সংকটের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ দেখা ঠিক হবে না।

বেজার তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর আন্তরিক সহযোগিতায় বেজা দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, যার মধ্যে ২৮টির উন্নয়নকাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন), শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে এ-যাবৎ প্রায় ২ হাজার ২১৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া ১২টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে এরই মধ্যে ৪২৬ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে ২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাণিজ্যিক শিল্পোৎপাদন শুরু করেছে এবং আরো ৬১টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এ অঞ্চলগুলোয় উল্লেখযোগ্য বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে জাপান, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, নরওয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।

বেজা একটি জাপানি, একটি চীনা ও দুটি ভারতীয়সহ মোট চারটি জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। বাংলাদেশ স্পেশাল ইজেড লিমিটেড (জাপানিজ ইকোনমিক জোন) নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার প্রায় এক হাজার একর জমি ওপর। বেজা আশা করছে, বাস্তবায়ন হলে প্রস্তাবিত এলাকাগুলো অত্যাধুনিক ব্যবসায়িক হাব হয়ে উঠবে, যা দেশে দক্ষতা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কর্ণফুলী টানেল ও চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে একটি কৌশলগত অবস্থানে স্থাপিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলটিও যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পে অবদান রাখতে বেজা কক্সবাজারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনকাজ শুরু করেছে। মেরিন ড্রাইভের শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের নীল জলের পাশে গড়ে ওঠা সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ১৭ জন বিনিয়োগকারীকে এরই মধ্যে প্রায় ৮১ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (আইবিসিসিআই) সভাপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়, এর বাইরেও গ্যাস সংকট রয়েছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ কোনো সংকটেই থেমে থাকেনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগ ব্যয় বাড়বে। তবে এর কারণে কেউ বিনিয়োগ করবে না এমন ধারণা সঠিক নয়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বর্তমান সংকট কৃত্রিম। এ সংকট আজীবন থাকবে না। বর্তমানে সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, যার মাধ্যমে ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ব্যয় পরিহার করতে হচ্ছে। তা না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে এমন শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও যতটুকু সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় থাকতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে আমি যে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত, সেগুলোর কার্যক্রম বিদ্যমান সংকট পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগামীতে আরো নেতিবাচক কিছু আসছে কিনা, তা এখনই বলার সময় আসেনি।

বিজনেস বাংলাদেশ / হাবিব

জনপ্রিয়

মুরাদনগরের সাবেক ৫বারের এমপি কায়কোবাদের অপেক্ষায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ

অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে

প্রকাশিত : ১১:৩৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ নভেম্বর ২০২২

২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগের প্রত্যাশা রয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে কিছু বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন। জাপান, ভারত ও চীনের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও কম-বেশি এগিয়েছে। তবে বিদ্যমান জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটে বেজার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ফিকে হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগের বৃহৎ পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বর্তমান বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগ আসা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যখন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর পরিকল্পনা নেয়া হয়, সে সময় চীন থেকে অনেক বিনিয়োগই বাংলাদেশে আসবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সংকটে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগের পরিকল্পনা স্থগিত করে রেখেছেন। কারণ কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার নিশ্চয়তা এখন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলেও তেল সরবরাহ নিশ্চিত না হলে কী করে সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

তবে বেজা সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে যে কার্যক্রম চলমান আছে সেগুলোয় শিল্পের ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। সব শিল্পই যে গ্যাসনির্ভর এমন নয়। বিদ্যুতের চলমান সমস্যা অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকেও ছুঁয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চলমান রাখা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। তবে গ্যাসনির্ভর যে শিল্পগুলো হয়েছে, সেগুলোয় প্রভাব পড়বে না। কারণ গ্যাসনির্ভর শিল্প সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বেশির ভাগ শিল্পেরই বিদ্যুিনর্ভরতা বেশি। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চারটি শিল্প উৎপাদনে গিয়েছে। চারটিই বিদ্যুিনর্ভর। বিকল্প হিসেবে এ শিল্পগুলোর জেনারেটর সংযোগ রয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বেজার আসন্ন বৈঠকে বিদ্যুতের অপ্রতুলতার বিষয়ে অভিযোগ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বিশেষ একটা সুবিধা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পায় জানিয়ে বেজা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিদ্যুতের সংযোগ আছে দুটি করে। একটা থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকলে আরেকটা দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রাখা হয় শিল্পে। সামগ্রিকভাবে যে শিল্পগুলো এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদনে আছে, সেখানে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ঘনীভূত হয়নি। গ্যাসভিত্তিক শিল্পায়নের প্রক্ষেপণও বেজায় আছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বর্তমানে দৈনিক ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, তবে তার ব্যবহার অনেক কম। বিদ্যমান সরবরাহ সক্ষমতা থেকে আরো অনেকগুলো শিল্প গড়ে উঠতে পারবে ওখানে। তবে কিছুটা হলেও সমস্যা হচ্ছে বিদ্যমান সংকটাবস্থায়। সংকটের এ পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি আরো বিরূপ হবে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের অর্থলগ্নি নিয়ে মনোবল এখন পর্যন্ত ইতিবাচকই রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানির যে সংকট, সেটা সবাইকে মানতে হবে এবং হচ্ছে। কারণ সবাই বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই অগ্রসর হচ্ছে। তার পরও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো। জমি বরাদ্দও হচ্ছে নিয়মিতভাবে। অনেকে কাজ শুরু করেছেন, অনেকে এরই মধ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আশা করছি খুব দ্রুতই বিদ্যমান সংকট কেটে যাবে। সংকট মূলত জ্বালানি নিয়ে, বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ। দুটোই নির্ভর করে সরকারের ওপর। আমরা সরকারের সাহায্যপ্রার্থী। সরকার যদি সমাধান করতে পারে, আমাদেরটাও সমাধান হবে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চারটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গিয়েছে, বাকিগুলো তৈরি হচ্ছে। যেগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোয় কারখানা শেড, যন্ত্রপাতি স্থাপনের কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন হতে হতে সংকট কেটে যাবে এমন প্রত্যাশা করছি।

জানা গিয়েছে, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেজার পক্ষ থেকে সমাপ্ত কার্যক্রমগুলোর মধ্যে আছে প্রায় ১০ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ ও তিনটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার নির্মাণ। প্রায় ২০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ ও একটি ৩৩/১১ কেভিএ সাব-স্টেশন নির্মাণ। এছাড়া পানি সরবরাহের জন্য ১৫টি প্রডাকশন টিউবওয়েল স্থাপন। এছাড়া বিনিয়োগের ভৌত অবকাঠামো-সংক্রান্ত আরো কিছু কার্যক্রমের মধ্যে আছে ১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ২৩০ কেভিএ গ্রিড লাইন ও সাব-স্টেশন নির্মাণ। এছাড়া পানি সরবরাহের জন্য ১০টি প্রডাকশন টিউবওয়েল নির্মাণ।

বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তারা বলছেন, সহজলভ্য শ্রমের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প কম। থাকার মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আছে ইন্দোনেশিয়া। মিয়ানমারে বিনিয়োগকারীদের যাওয়ার আগ্রহ তুলনামূলক কম। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক। কিন্তু এখন সরকারকে উঠে পড়ে লাগতে হবে বড় না হলেও মাঝারি আকারের বিনিয়োগকারী আকর্ষণের জন্য। বর্তমানে জ্বালানি সংকট একটা অস্থায়ী যুদ্ধের মতো। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে আশাবাদী বিনিয়োগকারীরা। তবে আমলাতন্ত্রকে সহজ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। বিনিয়োগকারীরা যেন অনলাইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে সব সেবা পেতে পারেন, এমন নিশ্চয়তা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ ধরে রাখতে অন্তত একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল খুব ভালো করে সক্রিয় করা প্রয়োজন।

জানতে চাইলে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি রুপালী চৌধুরী বলেন, অনেক অমীমাংসিত বিষয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে। যেমন পানি ও বিদ্যুতের সারচার্জ। এগুলো এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। এদিকে সারা পৃথিবীতে এখন মন্দা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও আছে। তবে অনেক সম্ভাবনার মধ্যেও বর্তমানে জ্বালানি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মহেশখালী থেকে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল। সেই কাজগুলো এখন অনেক দ্রুত শেষ হওয়া উচিত। গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা এখন মারাত্মক। কিন্তু বর্তমান জ্বালানি সংকটের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ দেখা ঠিক হবে না।

বেজার তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর আন্তরিক সহযোগিতায় বেজা দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, যার মধ্যে ২৮টির উন্নয়নকাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন), শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে এ-যাবৎ প্রায় ২ হাজার ২১৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া ১২টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে এরই মধ্যে ৪২৬ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে ২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাণিজ্যিক শিল্পোৎপাদন শুরু করেছে এবং আরো ৬১টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এ অঞ্চলগুলোয় উল্লেখযোগ্য বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে জাপান, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, নরওয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।

বেজা একটি জাপানি, একটি চীনা ও দুটি ভারতীয়সহ মোট চারটি জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। বাংলাদেশ স্পেশাল ইজেড লিমিটেড (জাপানিজ ইকোনমিক জোন) নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার প্রায় এক হাজার একর জমি ওপর। বেজা আশা করছে, বাস্তবায়ন হলে প্রস্তাবিত এলাকাগুলো অত্যাধুনিক ব্যবসায়িক হাব হয়ে উঠবে, যা দেশে দক্ষতা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কর্ণফুলী টানেল ও চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে একটি কৌশলগত অবস্থানে স্থাপিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলটিও যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পে অবদান রাখতে বেজা কক্সবাজারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনকাজ শুরু করেছে। মেরিন ড্রাইভের শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের নীল জলের পাশে গড়ে ওঠা সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ১৭ জন বিনিয়োগকারীকে এরই মধ্যে প্রায় ৮১ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (আইবিসিসিআই) সভাপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়, এর বাইরেও গ্যাস সংকট রয়েছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ কোনো সংকটেই থেমে থাকেনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগ ব্যয় বাড়বে। তবে এর কারণে কেউ বিনিয়োগ করবে না এমন ধারণা সঠিক নয়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বর্তমান সংকট কৃত্রিম। এ সংকট আজীবন থাকবে না। বর্তমানে সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, যার মাধ্যমে ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ব্যয় পরিহার করতে হচ্ছে। তা না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে এমন শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও যতটুকু সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় থাকতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে আমি যে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত, সেগুলোর কার্যক্রম বিদ্যমান সংকট পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগামীতে আরো নেতিবাচক কিছু আসছে কিনা, তা এখনই বলার সময় আসেনি।

বিজনেস বাংলাদেশ / হাবিব