০৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

রেমিট্যান্সে সুফল, আমদানিতে কুফল

ডলারের দর নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে প্রতি ডলারের দাম ১১০ থেকে একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঋণের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ ভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি বাতিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে নীতি সুদহার।

তবে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, সুদ বাজারভিত্তিক হলেও তা যেন বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি না বাড়ে। গত মাসে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্ত নতুন করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে। ডলারের দাম বাড়লে আমদানি খরচ বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দামও। কারণ, গাড়ি থেকে শুরু করে প্রায় সব নিত্যপণ্যই আমদানিনির্ভর। ফলে একদিকে যেমন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে, অন্যদিকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখবে।

জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডলারের দর বাড়ার প্রভাব পড়বে বাজারে। মানুষের কষ্ট বাড়বে। তবে ডলারের দর বেশি কম যা-ই হোক, মানুষকে দ্রুত স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ফেরত দিতে হবে।”

হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, “করোনা ভাইরাসের মধ্যে আমরা যে সংকটে পড়েছিলাম পরবর্তীতে যেসব দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, বাংলাদেশ তার মধ্যে সামনে সারিতে ছিল। কিন্তু এখন যে সংকটের মধ্যে আছি ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না। আমাদের অনুরোধ, টাইম ফ্রেম বেঁধে দিতে হবে, যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকা করেছে, কদিন পরে না হয় ১২২ টাকা করুক, কিন্তু আগামী ছয় মাসের মধ্যে যেন স্থিতিশীল অর্থনীতির মধ্যে আসতে পারি।”

সংশ্লিষ্টরা বলছে, গত প্রায় দুই বছর ধরেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলার সংকটের ওপর ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে হামাস-ইসরায়ের যুদ্ধ। এসব সংঘাতে অর্থনীতির যে সংকট তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না অনেক দেশ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। খোলাবাজারে কালোবাজারিদের মাধ্যমে সীমিত ডলার দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে আমদানিকারকরা। অতিরিক্ত দামে ডলার কিনছেন ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। প্রবাসী আয়ে জোর দিয়েও কার্যকরী সুফল মিলছে না।

তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে প্রতি ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে জ্বালানি আমদানির খরচে। বেড়ে যাবে আমদানি ব্যয়। ফলে বিপাকে পড়বেন আমদানিকারকরা। তবে বিপরীতে কিছুটা সুফল পাবেন রপ্তানিকারকরা।

রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, ডলারের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তে রপ্তানি আয় যেমন বাড়বে, তেমনি বৈধ পথে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, ডলার–সংকটে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়ে গেলে তা অর্থনীতির সংকট ঠেকাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদা মতো ডলার কিনতে না পেরে আমদানিকারকরা কার্ব মার্কেট থেকে বেশি দাম দিয়ে ডলার সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের বড় একটা অংশ ইতোমধ্যে চলে গেছে হুন্ডির নিয়ন্ত্রণে। রপ্তানি আয়েরও একটা অংশ বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও প্রভাব বাড়ছে হুন্ডি কারবারিদের। ফলে ডলারের দাম বাড়িয়ে এসব অবৈধ চ্যানেল ঠেকানো কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির ওপর কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে অর্থনীতির স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো বিলম্বিত। আরও আগে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা ‘কম বেদনাদায়ক’ হতো।”

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, “সুদের হার বাজারভিত্তিক করার কারণে অর্থ ধার করার খরচ বাড়বে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে। আমরা জানি, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানা রকম খরচ আছে। ঘুষ-দুর্নীতির কারণেও ব্যবসার খরচ বাড়ে। তবে দক্ষতা, সুশাসন, জবাবদিহি, দুর্নীতি হ্রাস—এসব নিশ্চিত করতে পারলে বিরূপ প্রভাব অনেকটা কমাতে পারব।”

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ

ট্যাগ :

রেমিট্যান্সে সুফল, আমদানিতে কুফল

প্রকাশিত : ০৯:৫০:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ মে ২০২৪

ডলারের দর নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে প্রতি ডলারের দাম ১১০ থেকে একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঋণের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ ভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি বাতিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে নীতি সুদহার।

তবে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, সুদ বাজারভিত্তিক হলেও তা যেন বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি না বাড়ে। গত মাসে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্ত নতুন করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে। ডলারের দাম বাড়লে আমদানি খরচ বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দামও। কারণ, গাড়ি থেকে শুরু করে প্রায় সব নিত্যপণ্যই আমদানিনির্ভর। ফলে একদিকে যেমন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে, অন্যদিকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখবে।

জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডলারের দর বাড়ার প্রভাব পড়বে বাজারে। মানুষের কষ্ট বাড়বে। তবে ডলারের দর বেশি কম যা-ই হোক, মানুষকে দ্রুত স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ফেরত দিতে হবে।”

হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, “করোনা ভাইরাসের মধ্যে আমরা যে সংকটে পড়েছিলাম পরবর্তীতে যেসব দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, বাংলাদেশ তার মধ্যে সামনে সারিতে ছিল। কিন্তু এখন যে সংকটের মধ্যে আছি ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না। আমাদের অনুরোধ, টাইম ফ্রেম বেঁধে দিতে হবে, যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকা করেছে, কদিন পরে না হয় ১২২ টাকা করুক, কিন্তু আগামী ছয় মাসের মধ্যে যেন স্থিতিশীল অর্থনীতির মধ্যে আসতে পারি।”

সংশ্লিষ্টরা বলছে, গত প্রায় দুই বছর ধরেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলার সংকটের ওপর ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে হামাস-ইসরায়ের যুদ্ধ। এসব সংঘাতে অর্থনীতির যে সংকট তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না অনেক দেশ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। খোলাবাজারে কালোবাজারিদের মাধ্যমে সীমিত ডলার দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে আমদানিকারকরা। অতিরিক্ত দামে ডলার কিনছেন ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। প্রবাসী আয়ে জোর দিয়েও কার্যকরী সুফল মিলছে না।

তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে প্রতি ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে জ্বালানি আমদানির খরচে। বেড়ে যাবে আমদানি ব্যয়। ফলে বিপাকে পড়বেন আমদানিকারকরা। তবে বিপরীতে কিছুটা সুফল পাবেন রপ্তানিকারকরা।

রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, ডলারের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তে রপ্তানি আয় যেমন বাড়বে, তেমনি বৈধ পথে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, ডলার–সংকটে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়ে গেলে তা অর্থনীতির সংকট ঠেকাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদা মতো ডলার কিনতে না পেরে আমদানিকারকরা কার্ব মার্কেট থেকে বেশি দাম দিয়ে ডলার সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের বড় একটা অংশ ইতোমধ্যে চলে গেছে হুন্ডির নিয়ন্ত্রণে। রপ্তানি আয়েরও একটা অংশ বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও প্রভাব বাড়ছে হুন্ডি কারবারিদের। ফলে ডলারের দাম বাড়িয়ে এসব অবৈধ চ্যানেল ঠেকানো কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির ওপর কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে অর্থনীতির স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো বিলম্বিত। আরও আগে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা ‘কম বেদনাদায়ক’ হতো।”

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, “সুদের হার বাজারভিত্তিক করার কারণে অর্থ ধার করার খরচ বাড়বে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে। আমরা জানি, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানা রকম খরচ আছে। ঘুষ-দুর্নীতির কারণেও ব্যবসার খরচ বাড়ে। তবে দক্ষতা, সুশাসন, জবাবদিহি, দুর্নীতি হ্রাস—এসব নিশ্চিত করতে পারলে বিরূপ প্রভাব অনেকটা কমাতে পারব।”

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ