০৯:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

বিপর্যয়ে ক্ষতবিক্ষত সম্ভাবনাময়ী পর্যটন খাত !

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে কমবেশি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সব খাত। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে অর্থনীতিতে। তবে এর ব্যতিক্রম পর্যটন খাত। প্রাকৃতিক নৈঃসর্গের দেশ বাংলাদেশ। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার সৌন্দর্য, যা কিনা কাছে টানে দেশি- বিদেশি পর্যটকদের। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বিস্তৃত হাওড়াঞ্চল, বিশাল পার্বত্যাঞ্চল, মহাস্থানগড় এবং পাহাড়পুরের হাজার বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ এদেশে রয়েছে ভ্রমণপিপাসু একজন মানুষকে আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছু। কিন্তু কেন যেন সেভাবে এগুতে পারছে না দেশের পর্যটন খাত।

প্রতিবেশী দেশগুলোর জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান অনেক বেশি হলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় প্রচারণা, উন্নত সেবাদানে দক্ষতার অভাব, পর্যটকদের অতিরিক্ত খরচসহ দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার অভাবটাই সবচেয়ে বেশি প্রকট। মূলত পর্যটকবান্ধব সুযোগ-সুবিধা না দিতে পারার কারণেই পশ্চিমা পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এদেশ থেকে। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলোতে সারা বছরই লেগে থাকে পশ্চিমা পর্যটকদের ভিড়।

২০২০ সালের করোনাভাইরাসের ধাক্কায় দেশের পর্যটন খাত পড়ে গভীর অনিশ্চয়তায়।তার পর বারবার ঘুরে দাঁড়ালেও পদে পদে হোঁচট খেয়েছে। কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবার কখনও রাজনৈতিক অস্থিরতায় একের পর এক বিপর্যয়ে ক্ষতবিক্ষত সম্ভাবনার পর্যটন খাত। এতে ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা থাকার পরও একদিকে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, অন্যদিকে একের পর এক বিপর্যয়ে পর্যটন ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

এমন পরিস্থিতিতে উদযাপিত হয়ে ছিলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পর্যটন শান্তির সোপান’। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উদযাপন করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নানান কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে–আগারগাঁওয়ে পর্যটন ভবন থেকে শোভাযাত্রা, সকাল ৯টায় পর্যটন ভবনে সেমিনার, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁগুলো বিশেষ ছাড় ঘোষণা করেছে। ‘লাইভ কুকিং শো’ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স টিকিটে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। শিশুদের মধ্যে পর্যটনের সৌরভ ছড়িয়ে দিতে সব জেলায় চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী উত্তপ্ত পরিস্থিতি, এর পর দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহে দুই ঈদ উৎসবের সময়ও মন্দার মুখে ছিল এই খাত। তার ওপর জুলাই ও আগস্টজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং পরবর্তীকালে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ভয়াবহ বন্যায় আরও বিপর্যয় নেমে এসেছে এ খাতে। নতুন করে পাহাড়ে অস্থিরতারও আঁচ পড়েছে পর্যটনে; নেই ভ্রমণপিপাসুর কোলাহল। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এ খাতকে ঘিরে অন্তত ১৬ ধরনের পরিষেবা দেওয়া লোকজনের জীবিকা।

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে বিগত সরকারের ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউর কারণে পর্যটন খাতকে প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কিছুদিন দেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া অনিশ্চয়তার প্রভাবও পড়ে পর্যটন খাতে। এর পর বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপ্রিয় বেশ কিছু পর্যটন স্পটেও পড়ে বন্যার প্রভাব। সর্বশেষ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতায় গত চার দিনে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর মধ্যে শুধু রাঙামাটিতে পর্যটন খাতে দৈনিক লোকসানের পরিমাণ কোটি টাকার বেশি।
এ খাতের ব্যবসায়ী ও সেবাদানকারীরা বলছেন, ভ্রমণের জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল পরিবেশ। এতদিন সেই পরিবেশ ছিল না। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাই অচিরেই দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার মাধ্যমে সুদিন ফেরার আশা করা হচ্ছে। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা চান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) জানিয়েছে, দেশে পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ জড়িত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি। এর মধ্যে পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করেন এশিয়ার দেশগুলোয়। কিন্তু অপরিকল্পিত কার্যক্রমের কারণে তার পুরো সফলতা আসছে না বাংলাদেশে।

টোয়াবের সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরাইশী বলেন, পর্যটন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এর ৩০ শতাংশ হয় দুই ঈদে। এর মধ্যে রোজার ঈদে ২০ শতাংশ ও কোরবানির ঈদে ১০ শতাংশ। কিন্তু গত এক যুগে ধাপে ধাপে নানা অস্থিরতায় এ খাতে বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। সব মিলিয়ে যা লাখো কোটিতে দাঁড়াবে।

টোয়াবের ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট রিলেটেড স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান ও কেয়ার ট্যুরিজমের প্রোপ্রাইটর মো. সোরওয়ার্দি হোসেন সারওয়ার বলেন, ‌আগে যেখানে এই সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকের ঢল নামত, এখন সেখানে পর্যটক নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। আর পাহাড়েও কেউ যাচ্ছে না। আবার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভারত-বাংলাদেশের পর্যটক আসা-যাওয়াও কমে গেছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে আছে চলতি বছরের বাজেটে আমাদের ওপর আরোপ করা ১৫ শতাংশ ভ্যাট, যা অনেকটাই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। বিগত সরকারের কাছেও ভ্যাটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

কিন্তু সরকার সে সময় এ দাবি মানেনি। এখন তাদের প্রত্যাশা, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন চাপিয়ে দেওয়া এই ভ্যাট পুনর্বিবেচনা করে।
টোয়াবের হিলট্র্যাকস রিলেটেড স্টিয়ারিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান জুয়েল বলেন, ‌ট্যুরিজম খাত খুবই স্পর্শকাতর। রাজনৈতিক অস্থিরতা কি প্রাকৃতিক– সবার আগে বন্ধ হয় এই খাত।

আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত যত ট্যুর হওয়ার কথা ছিল, তার বেশির ভাগই বাতিল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সরকার পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিচ্ছে, কারণ তারা বিদেশ থেকে ডলার আনছেন। একইভাবে পর্যটন ব্যবসায়ীরাও বিদেশি পর্যটক দেশে আনার মাধ্যমে ডলার আনছেন। কিন্তু তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই।

স্পিড হলিডেস-এর প্রধান নির্বাহী মেসবাউল আলম বলেন, সরকারকে এখন বিশ্বদরবারে এই বার্তা দিতে হবে, দেশে এখন আন্দোলন-সংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল। বিদেশিরা নির্ভয়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে পারেন। এই বার্তা দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। তাহলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। তারা বাংলাদেশ ভ্রমণে উৎসাহিত হবেন।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) মো. জিয়াউল হক হাওলাদার বলেন, পর্যটকরা সব সময় নিরাপত্তার বিষয়টি আগে চিন্তা করে ভ্রমণে বের হন। গত কয়েক বছরে ধাপে ধাপে নানা অস্থিরতা পর্যটন খাতকে এগোতে দেয়নি।

ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে কিন্তু কোনো ভাবে কাটিয়ে উঠতে পারছেনা নানান প্রতিকুলতার কারনে ।সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান বলেন, নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সংকট কাটিয়ে পর্যটনশিল্পে নতুন উদ্যোগ ও ভাবনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে কাজ করছি আমরা। পর্যটনশিল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা হালনাগাদকরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্র্যান্ডিং করতে হবে পর্যটন খাতকে। দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে প্রচার করতে হবে। তাহলেই বিদেশি পর্যটকরা আমাদের পর্যটন গন্তব্যগুলো নিয়ে আকর্ষণ বোধ করবেন।

বিজনেস বাংলাদেশ/ডিএস

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

বিপর্যয়ে ক্ষতবিক্ষত সম্ভাবনাময়ী পর্যটন খাত !

প্রকাশিত : ০৩:০১:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে কমবেশি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সব খাত। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে অর্থনীতিতে। তবে এর ব্যতিক্রম পর্যটন খাত। প্রাকৃতিক নৈঃসর্গের দেশ বাংলাদেশ। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার সৌন্দর্য, যা কিনা কাছে টানে দেশি- বিদেশি পর্যটকদের। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বিস্তৃত হাওড়াঞ্চল, বিশাল পার্বত্যাঞ্চল, মহাস্থানগড় এবং পাহাড়পুরের হাজার বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ এদেশে রয়েছে ভ্রমণপিপাসু একজন মানুষকে আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছু। কিন্তু কেন যেন সেভাবে এগুতে পারছে না দেশের পর্যটন খাত।

প্রতিবেশী দেশগুলোর জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান অনেক বেশি হলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় প্রচারণা, উন্নত সেবাদানে দক্ষতার অভাব, পর্যটকদের অতিরিক্ত খরচসহ দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার অভাবটাই সবচেয়ে বেশি প্রকট। মূলত পর্যটকবান্ধব সুযোগ-সুবিধা না দিতে পারার কারণেই পশ্চিমা পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এদেশ থেকে। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলোতে সারা বছরই লেগে থাকে পশ্চিমা পর্যটকদের ভিড়।

২০২০ সালের করোনাভাইরাসের ধাক্কায় দেশের পর্যটন খাত পড়ে গভীর অনিশ্চয়তায়।তার পর বারবার ঘুরে দাঁড়ালেও পদে পদে হোঁচট খেয়েছে। কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবার কখনও রাজনৈতিক অস্থিরতায় একের পর এক বিপর্যয়ে ক্ষতবিক্ষত সম্ভাবনার পর্যটন খাত। এতে ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা থাকার পরও একদিকে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, অন্যদিকে একের পর এক বিপর্যয়ে পর্যটন ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

এমন পরিস্থিতিতে উদযাপিত হয়ে ছিলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পর্যটন শান্তির সোপান’। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উদযাপন করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নানান কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে–আগারগাঁওয়ে পর্যটন ভবন থেকে শোভাযাত্রা, সকাল ৯টায় পর্যটন ভবনে সেমিনার, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁগুলো বিশেষ ছাড় ঘোষণা করেছে। ‘লাইভ কুকিং শো’ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স টিকিটে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। শিশুদের মধ্যে পর্যটনের সৌরভ ছড়িয়ে দিতে সব জেলায় চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী উত্তপ্ত পরিস্থিতি, এর পর দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহে দুই ঈদ উৎসবের সময়ও মন্দার মুখে ছিল এই খাত। তার ওপর জুলাই ও আগস্টজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং পরবর্তীকালে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ভয়াবহ বন্যায় আরও বিপর্যয় নেমে এসেছে এ খাতে। নতুন করে পাহাড়ে অস্থিরতারও আঁচ পড়েছে পর্যটনে; নেই ভ্রমণপিপাসুর কোলাহল। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এ খাতকে ঘিরে অন্তত ১৬ ধরনের পরিষেবা দেওয়া লোকজনের জীবিকা।

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে বিগত সরকারের ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউর কারণে পর্যটন খাতকে প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কিছুদিন দেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া অনিশ্চয়তার প্রভাবও পড়ে পর্যটন খাতে। এর পর বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপ্রিয় বেশ কিছু পর্যটন স্পটেও পড়ে বন্যার প্রভাব। সর্বশেষ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতায় গত চার দিনে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর মধ্যে শুধু রাঙামাটিতে পর্যটন খাতে দৈনিক লোকসানের পরিমাণ কোটি টাকার বেশি।
এ খাতের ব্যবসায়ী ও সেবাদানকারীরা বলছেন, ভ্রমণের জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল পরিবেশ। এতদিন সেই পরিবেশ ছিল না। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাই অচিরেই দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার মাধ্যমে সুদিন ফেরার আশা করা হচ্ছে। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা চান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) জানিয়েছে, দেশে পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ জড়িত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি। এর মধ্যে পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করেন এশিয়ার দেশগুলোয়। কিন্তু অপরিকল্পিত কার্যক্রমের কারণে তার পুরো সফলতা আসছে না বাংলাদেশে।

টোয়াবের সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরাইশী বলেন, পর্যটন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এর ৩০ শতাংশ হয় দুই ঈদে। এর মধ্যে রোজার ঈদে ২০ শতাংশ ও কোরবানির ঈদে ১০ শতাংশ। কিন্তু গত এক যুগে ধাপে ধাপে নানা অস্থিরতায় এ খাতে বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। সব মিলিয়ে যা লাখো কোটিতে দাঁড়াবে।

টোয়াবের ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট রিলেটেড স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান ও কেয়ার ট্যুরিজমের প্রোপ্রাইটর মো. সোরওয়ার্দি হোসেন সারওয়ার বলেন, ‌আগে যেখানে এই সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকের ঢল নামত, এখন সেখানে পর্যটক নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। আর পাহাড়েও কেউ যাচ্ছে না। আবার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভারত-বাংলাদেশের পর্যটক আসা-যাওয়াও কমে গেছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে আছে চলতি বছরের বাজেটে আমাদের ওপর আরোপ করা ১৫ শতাংশ ভ্যাট, যা অনেকটাই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। বিগত সরকারের কাছেও ভ্যাটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

কিন্তু সরকার সে সময় এ দাবি মানেনি। এখন তাদের প্রত্যাশা, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন চাপিয়ে দেওয়া এই ভ্যাট পুনর্বিবেচনা করে।
টোয়াবের হিলট্র্যাকস রিলেটেড স্টিয়ারিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান জুয়েল বলেন, ‌ট্যুরিজম খাত খুবই স্পর্শকাতর। রাজনৈতিক অস্থিরতা কি প্রাকৃতিক– সবার আগে বন্ধ হয় এই খাত।

আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত যত ট্যুর হওয়ার কথা ছিল, তার বেশির ভাগই বাতিল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সরকার পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিচ্ছে, কারণ তারা বিদেশ থেকে ডলার আনছেন। একইভাবে পর্যটন ব্যবসায়ীরাও বিদেশি পর্যটক দেশে আনার মাধ্যমে ডলার আনছেন। কিন্তু তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই।

স্পিড হলিডেস-এর প্রধান নির্বাহী মেসবাউল আলম বলেন, সরকারকে এখন বিশ্বদরবারে এই বার্তা দিতে হবে, দেশে এখন আন্দোলন-সংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল। বিদেশিরা নির্ভয়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে পারেন। এই বার্তা দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। তাহলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। তারা বাংলাদেশ ভ্রমণে উৎসাহিত হবেন।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) মো. জিয়াউল হক হাওলাদার বলেন, পর্যটকরা সব সময় নিরাপত্তার বিষয়টি আগে চিন্তা করে ভ্রমণে বের হন। গত কয়েক বছরে ধাপে ধাপে নানা অস্থিরতা পর্যটন খাতকে এগোতে দেয়নি।

ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে কিন্তু কোনো ভাবে কাটিয়ে উঠতে পারছেনা নানান প্রতিকুলতার কারনে ।সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান বলেন, নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সংকট কাটিয়ে পর্যটনশিল্পে নতুন উদ্যোগ ও ভাবনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে কাজ করছি আমরা। পর্যটনশিল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা হালনাগাদকরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্র্যান্ডিং করতে হবে পর্যটন খাতকে। দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে প্রচার করতে হবে। তাহলেই বিদেশি পর্যটকরা আমাদের পর্যটন গন্তব্যগুলো নিয়ে আকর্ষণ বোধ করবেন।

বিজনেস বাংলাদেশ/ডিএস