১১:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

অনলাইনে শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

চলার জন্য যেমন পথ চাই তেমনি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান চাই। করোনা এখন পথে-ঘাটে, দোকানে সব জায়গায়। দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। সকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে চাইলেও করোনার কারণে ফিরতে পারছে না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই যে জ্ঞান অর্জন করার  চিন্তা সেটা অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে বসে বিভিন্ন নামকরা অধ্যাপকের ক্লাস করা যাচ্ছে আধুনিকায়নের যুগে। সরকার পক্ষ থেকে অনলাইনে ক্লাসের জন্য উৎসাহ প্রদান করা হলেও শিক্ষার্থীদের মতামত জানা জরুরি। অনেকের শুধু অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা কিংবা মাস্টার্সের পরীক্ষা বাকি আছে কিন্তু এই  অনাকাঙ্খিত বন্ধের জন্য দিতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা কি সত্যি চায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম! সেসব কথাই তুলে ধরেছেন- ইকবাল হাসান

মাহফুজ আব্দুল্লাহ, আইন বিভাগ, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়: বর্তমানে অনলাইন ক্লাস যেন “মরার উপর খাড়ার ঘা।” এমনিতেও ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি তার উপর দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার যে  মান তাতে শত ইচ্ছা থাকা সত্তেও  শিক্ষার্থীদের শতভাগ অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না । দিনশেষে অনলাইন ক্লাস আশির্বাদস্বরূপ হলেও দূর্বল ইন্টারনেট সেবা ও ইন্টারনেট প্যাকেজগুলির উচ্চমূল্যের কারনে এ শুভ উদ্যোগ ব্যহত হচ্ছে৷ যথাযথ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করলে তা জাতির ভবিষ্যত তৈরীতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে৷
তাইয়্যেবুন মিমি, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: আপাতকালীন সময়ে সবকিছুর সাথেই মানিয়ে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্র  চালু রাখাটা জরুরি, তথাপি অনলাইনে ক্লাসের পক্ষে সম্পূর্ণ একাত্মতা পোষণ করতে পারছি না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বড় একটি অংশ অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের টিউশন/ কোচিং-এর উপর নির্ভরশীল,  যেটা এখন একেবারেই বন্ধ। তাছাড়া দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকেই গ্রামাঞ্চলে থাকে যেখানে নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়াটা একদমই স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পড়ে।
আমি নিজে সাহিত্যের শিক্ষার্থী। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু বুঝেছি,  শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সাথে আর কোন শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনা হয় না। আমার প্রাচ্যদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই গুরুমুখী শিক্ষায়  দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদি যেভাবে পাঠদান করা হতো সেই ধারণা থেকে আমরা চাইলেও বের হতে পারব না। সেদিক থেকে বলতে গেলে কিছু কিছু বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা যেগুলোতে ছাত্র- শিক্ষক ব্যক্তিক সংযোগ অাবশ্যিক বা মাঠপর্যায়ের পড়াশোনা আবশ্যিক সেগুলো অনলাইনে একেবারেই মানসম্মত হবে না বলে আমার ধারণা। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে শেখার চর্চা থামিয়ে রাখা যাবে না, সুতরাং অনলাইনে পরীক্ষামূলক শিক্ষাদান কর্মসূচী চালু করা যেতে পারে, তবে সেটা যেন কোনভাবেই তড়িঘড়ি সার্টিফিকেট লাভ বা পাস করার উদ্দেশ্যে না হয় এটাই চাওয়া।
মো: হাসান বিশ্বাস,টেলিভিশন, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে  দিন দিন ভয়ংকর গতিতে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর  সংখ্যা। মৃত্যুর ভয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে অনেকে। সময়টা যেন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার। এমন পরিস্থিতিতে পড়ার টেবিলে মন বসানো সম্ভব না।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেকের পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ। সংখ্যায় কম হলেও স্মার্টফোন ব্যবহারের সামর্থ্য নেই এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া   অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন। ফলে অনেকেই ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা উচ্চমূল্যের কারণে ইন্টারনেট বিল বহন করার সক্ষমতা নেই। এছাড়া বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ রয়েছে। ফলে পরিবারে দেখা দিচ্ছে আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও মৌলিক চাহিদার সংকট। এমতাবস্থায় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীবান্ধব নয়।
সুবর্ণা মোস্তফা, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: করোনাকালীন দুঃসময়ে সকলধরনের হুমকির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনও হুমকির মুখে। এই সময় সমাধান রূপে যে সিদ্ধান্ত নেয়ার আলোচনা চলছে সেটা অনলাইন ক্লাস।  অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা শতভাগ শিক্ষার্থীর  নেই। অনেকেই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসে যেখানে  মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছানো অসম্ভব। পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসের প্রস্তুতির জন্য মেগাবাইট এর যে উচ্চমূল্য তাও সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে যে বাজেট পাশ করা হয়েছে তাতেও ইন্টারনেট খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিকূলতাই একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইন ক্লাসকে প্রায় অসম্ভব পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। তাই প্রথমে অনলাইন বিষয়টি শিক্ষার্থীদের অনুকূল করা এবং পরবর্তীতে এই বিষয় বাস্তবায়ন যুক্তিযুক্ত। কারণ প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন অত্যন্ত মূল্যবান।
অলিন মো: মোমিন, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: ভাইরাসের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রুটিনে হুট করেই বন্দী জীবন অার অফুরন্ত সময় যোগ হয়।  কিছুদিন তা উপভোগ করলেও এখন শিক্ষার্থীরা হাঁপিয়ে উঠেছে।  শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতোমধ্যে এক সেমিস্টার ড্রপ  হয়ে গেছে।  ৬ অাগষ্ট পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার ফলে  দ্বিতীয় সেমিস্টারও ড্রপ হওয়ার পথে।  ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউসিজি অনলাইন ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দিলেও তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঙ্গতকারণেই বাস্তবায়ন হয়নি। মহামারীর তান্ডবে  প্রতিটি  মধ্যবিত্ত অার নিম্নবিত্তের ঘরে এখন নূন অানতে পান্তা পুরায় অবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এমন পরিবার থেকেই অাসা। অপর্যাপ্ত ইন্টারনেট সেবার সাথে উচ্চমূল্যে ডেটা কিনে ক্লাস করা তাদের জন্য অসম্ভবই। তবে  দীর্ঘ ছুটির কারণে এখন ঘরবন্দী শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার দিকে নজর দেয়া জরুরি। অাক্রান্ত শনাক্তের রেকর্ড  ধাবমান মিছিল, অর্থনৈতিক সংকট, অনিশ্চিত জীবন, নির্দিষ্ট গন্ডিতে বদ্ধ বসবাস এসব কিছু কিন্তু হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এসব থেকে উত্তরণ পেতে তাদের ব্যস্ত রাখা জরুরি।  অার অনলাইন ক্লাস হতে পারে তার বড় সমাধান। তাই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নতুন করে অনলাইন ক্লাস বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীবান্ধব পদক্ষেপ নেয়া খুবই প্রয়োজন।
মার্জিয়া আক্তার মিশু, গণিত বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: গত মার্চের মাঝামাঝিতে বন্ধ ঘোষনা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আর কতদিন,কবে রেহাই মিলবে এই মহামারি থেকে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই জীবন নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন হতাশ, তখন অনলাইন ক্লাস একটা বড় সুযোগ বলতে পারি।  সেশনজট এর হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই মিলবে; এমন ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীরা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু কারো কাছে ব্যাপার টা অস্বস্তিকর হয়ে দাড়াচ্ছে। কিছু শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন ক্লাস একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট, প্রয়োজনীয় স্মার্ট ডিভাইসগুলোর অভাববোধ  অনেক শিক্ষার্থীকে বিচ্ছিন্ন  করছে  অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে।শুধু তাই নয়, ফোরজি’র এই যুগে কিছু এলাকা এখনো নেটওয়ার্ক সার্ভিস এর বাইরে। ওইসব এলাকায় অনলাইন ক্লাসের কথা চিন্তা করাই  ভুল।এরকম শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যাওয়াটা  বৈষম্য তৈরি করে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, ডিজিটাল ক্লাসের মেথড সম্পর্কেও  কিছু শিক্ষকরাও এখনো সম্পুর্ন অবহিত নন। অনলাইনে যেসব ক্লাস করানো হবে সেগুলো ভিডিও হিসেবে ইন্টারনেটে দেয়া থাকলে পরবর্তীতে ডাউনলোড করে ক্লাস করা যাবে। এছাড়া লেকচারটি ফাইল আকারে সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে অনলাইন ক্লাস ফলপ্রসূ হবে।মোটকথা, অনলাইন কার্যক্রমে কেউ যাতে হয়রানির স্বীকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য  রেখে  অনলাইন ক্লাস নেয়া উদ্যোগটি  বাস্তবায়নে আশাবাদী।
রামীম হাসান, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, তিতুমীর কলেজ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন কার্যক্রমে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এরকম দীর্ঘসময় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকা আমাদের জন্যও ক্ষতিকর। কিন্তু সেই অনলাইন কার্যক্রম সবার জন্য যথার্থ না। সবার  অার্থিক অবস্থা এক রকম না। আমাদের কলেজের বেশীরভাগ ছেলে মেয়ে গ্রাম থেকে আসা। তার উপর মেগাবাইটের দাম আকাশ ছোঁয়া। অন্যদিকে, গ্রাম অঞ্চলের ইন্টারনেট ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তবে, ইন্টারনেটের জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা যদি আমাদের দেয়া হয় আমরা অনলাইন কার্যক্রমের জন্য তৈরি।
শ্যামলী তানজিন অনু, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: করোনা মহামারীতে জীবন সংকটময়। উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে অতিষ্ট জীবন। এরই মধ্যে ইদের পর অনলাইন ক্লাস নেওয়াও শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ তিনমাস ফলে যারা টিউশনির টাকায় চলে তাদের উপার্জনের রাস্তাও বন্ধ। পরিবার থেকে টাকা নিয়ে ডাটা কিনে ক্লাস করা অসম্ভব।  এখন ইন্টারনেট প্যাকের যে দাম তা একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীর পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাছাড়া অনলাইন  ক্লাসে উপস্থিত সংখ্যা কম। ক্লাসে মনোযোগও কম থাকে। উপস্থিত অনেকে  কানেক্ট হয়ে অন্য কাজেও ব্যস্ত থাকে। এদিকে গ্রাম অঞ্চলে যাদের বসবাস তাঁদের ইন্টারনেট কানেকশন খুবই বাজে।একটা ফটো শো করতে অনেকটা সময় লাগে। ফলে কেউ কেউ অনলাইন ক্লাস করতে বাড়ি থেকেও দুরে যায় শুধু কানেকশন ভালো পাবার জন্য। তারপরেও সমস্যা।বর্ষা চলে অাসায় বর্তমানে আবহাওয়া নাজুক। একটু বৃষ্টি বাতাস হলেই গ্রামে  বিদ্যুৎ বিভ্রাট। আর বিদ্যুৎ চলে গেলে নেটের গতি শূণ্যতে নেমে যায়।
এটা ঠিক পড়াশোনা প্রায় অচলাবস্থা। তবুও করোনায় যেখানে জীবন অতিষ্ট , সেখানে এতো সংকটের মধ্যে  অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত কতোটা যৌক্তিক তা বোধে আসেনা।
শিক্ষা হোক সবার জন্য

সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ট্রমা সেন্টার না থাকায় দুর্ঘটনায় আহত অনেকেই মারা যান

অনলাইনে শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

প্রকাশিত : ০১:১৭:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুন ২০২০
চলার জন্য যেমন পথ চাই তেমনি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান চাই। করোনা এখন পথে-ঘাটে, দোকানে সব জায়গায়। দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। সকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে চাইলেও করোনার কারণে ফিরতে পারছে না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই যে জ্ঞান অর্জন করার  চিন্তা সেটা অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে বসে বিভিন্ন নামকরা অধ্যাপকের ক্লাস করা যাচ্ছে আধুনিকায়নের যুগে। সরকার পক্ষ থেকে অনলাইনে ক্লাসের জন্য উৎসাহ প্রদান করা হলেও শিক্ষার্থীদের মতামত জানা জরুরি। অনেকের শুধু অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা কিংবা মাস্টার্সের পরীক্ষা বাকি আছে কিন্তু এই  অনাকাঙ্খিত বন্ধের জন্য দিতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা কি সত্যি চায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম! সেসব কথাই তুলে ধরেছেন- ইকবাল হাসান

মাহফুজ আব্দুল্লাহ, আইন বিভাগ, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়: বর্তমানে অনলাইন ক্লাস যেন “মরার উপর খাড়ার ঘা।” এমনিতেও ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি তার উপর দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার যে  মান তাতে শত ইচ্ছা থাকা সত্তেও  শিক্ষার্থীদের শতভাগ অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না । দিনশেষে অনলাইন ক্লাস আশির্বাদস্বরূপ হলেও দূর্বল ইন্টারনেট সেবা ও ইন্টারনেট প্যাকেজগুলির উচ্চমূল্যের কারনে এ শুভ উদ্যোগ ব্যহত হচ্ছে৷ যথাযথ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করলে তা জাতির ভবিষ্যত তৈরীতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে৷
তাইয়্যেবুন মিমি, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: আপাতকালীন সময়ে সবকিছুর সাথেই মানিয়ে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্র  চালু রাখাটা জরুরি, তথাপি অনলাইনে ক্লাসের পক্ষে সম্পূর্ণ একাত্মতা পোষণ করতে পারছি না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বড় একটি অংশ অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের টিউশন/ কোচিং-এর উপর নির্ভরশীল,  যেটা এখন একেবারেই বন্ধ। তাছাড়া দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকেই গ্রামাঞ্চলে থাকে যেখানে নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়াটা একদমই স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পড়ে।
আমি নিজে সাহিত্যের শিক্ষার্থী। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু বুঝেছি,  শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সাথে আর কোন শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনা হয় না। আমার প্রাচ্যদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই গুরুমুখী শিক্ষায়  দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদি যেভাবে পাঠদান করা হতো সেই ধারণা থেকে আমরা চাইলেও বের হতে পারব না। সেদিক থেকে বলতে গেলে কিছু কিছু বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা যেগুলোতে ছাত্র- শিক্ষক ব্যক্তিক সংযোগ অাবশ্যিক বা মাঠপর্যায়ের পড়াশোনা আবশ্যিক সেগুলো অনলাইনে একেবারেই মানসম্মত হবে না বলে আমার ধারণা। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে শেখার চর্চা থামিয়ে রাখা যাবে না, সুতরাং অনলাইনে পরীক্ষামূলক শিক্ষাদান কর্মসূচী চালু করা যেতে পারে, তবে সেটা যেন কোনভাবেই তড়িঘড়ি সার্টিফিকেট লাভ বা পাস করার উদ্দেশ্যে না হয় এটাই চাওয়া।
মো: হাসান বিশ্বাস,টেলিভিশন, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে  দিন দিন ভয়ংকর গতিতে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর  সংখ্যা। মৃত্যুর ভয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে অনেকে। সময়টা যেন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার। এমন পরিস্থিতিতে পড়ার টেবিলে মন বসানো সম্ভব না।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেকের পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ। সংখ্যায় কম হলেও স্মার্টফোন ব্যবহারের সামর্থ্য নেই এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া   অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন। ফলে অনেকেই ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা উচ্চমূল্যের কারণে ইন্টারনেট বিল বহন করার সক্ষমতা নেই। এছাড়া বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ রয়েছে। ফলে পরিবারে দেখা দিচ্ছে আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও মৌলিক চাহিদার সংকট। এমতাবস্থায় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীবান্ধব নয়।
সুবর্ণা মোস্তফা, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: করোনাকালীন দুঃসময়ে সকলধরনের হুমকির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনও হুমকির মুখে। এই সময় সমাধান রূপে যে সিদ্ধান্ত নেয়ার আলোচনা চলছে সেটা অনলাইন ক্লাস।  অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা শতভাগ শিক্ষার্থীর  নেই। অনেকেই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসে যেখানে  মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছানো অসম্ভব। পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসের প্রস্তুতির জন্য মেগাবাইট এর যে উচ্চমূল্য তাও সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে যে বাজেট পাশ করা হয়েছে তাতেও ইন্টারনেট খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিকূলতাই একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইন ক্লাসকে প্রায় অসম্ভব পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। তাই প্রথমে অনলাইন বিষয়টি শিক্ষার্থীদের অনুকূল করা এবং পরবর্তীতে এই বিষয় বাস্তবায়ন যুক্তিযুক্ত। কারণ প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন অত্যন্ত মূল্যবান।
অলিন মো: মোমিন, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: ভাইরাসের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রুটিনে হুট করেই বন্দী জীবন অার অফুরন্ত সময় যোগ হয়।  কিছুদিন তা উপভোগ করলেও এখন শিক্ষার্থীরা হাঁপিয়ে উঠেছে।  শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতোমধ্যে এক সেমিস্টার ড্রপ  হয়ে গেছে।  ৬ অাগষ্ট পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার ফলে  দ্বিতীয় সেমিস্টারও ড্রপ হওয়ার পথে।  ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউসিজি অনলাইন ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দিলেও তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঙ্গতকারণেই বাস্তবায়ন হয়নি। মহামারীর তান্ডবে  প্রতিটি  মধ্যবিত্ত অার নিম্নবিত্তের ঘরে এখন নূন অানতে পান্তা পুরায় অবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এমন পরিবার থেকেই অাসা। অপর্যাপ্ত ইন্টারনেট সেবার সাথে উচ্চমূল্যে ডেটা কিনে ক্লাস করা তাদের জন্য অসম্ভবই। তবে  দীর্ঘ ছুটির কারণে এখন ঘরবন্দী শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার দিকে নজর দেয়া জরুরি। অাক্রান্ত শনাক্তের রেকর্ড  ধাবমান মিছিল, অর্থনৈতিক সংকট, অনিশ্চিত জীবন, নির্দিষ্ট গন্ডিতে বদ্ধ বসবাস এসব কিছু কিন্তু হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এসব থেকে উত্তরণ পেতে তাদের ব্যস্ত রাখা জরুরি।  অার অনলাইন ক্লাস হতে পারে তার বড় সমাধান। তাই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নতুন করে অনলাইন ক্লাস বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীবান্ধব পদক্ষেপ নেয়া খুবই প্রয়োজন।
মার্জিয়া আক্তার মিশু, গণিত বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: গত মার্চের মাঝামাঝিতে বন্ধ ঘোষনা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আর কতদিন,কবে রেহাই মিলবে এই মহামারি থেকে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই জীবন নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন হতাশ, তখন অনলাইন ক্লাস একটা বড় সুযোগ বলতে পারি।  সেশনজট এর হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই মিলবে; এমন ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীরা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু কারো কাছে ব্যাপার টা অস্বস্তিকর হয়ে দাড়াচ্ছে। কিছু শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন ক্লাস একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট, প্রয়োজনীয় স্মার্ট ডিভাইসগুলোর অভাববোধ  অনেক শিক্ষার্থীকে বিচ্ছিন্ন  করছে  অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে।শুধু তাই নয়, ফোরজি’র এই যুগে কিছু এলাকা এখনো নেটওয়ার্ক সার্ভিস এর বাইরে। ওইসব এলাকায় অনলাইন ক্লাসের কথা চিন্তা করাই  ভুল।এরকম শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যাওয়াটা  বৈষম্য তৈরি করে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, ডিজিটাল ক্লাসের মেথড সম্পর্কেও  কিছু শিক্ষকরাও এখনো সম্পুর্ন অবহিত নন। অনলাইনে যেসব ক্লাস করানো হবে সেগুলো ভিডিও হিসেবে ইন্টারনেটে দেয়া থাকলে পরবর্তীতে ডাউনলোড করে ক্লাস করা যাবে। এছাড়া লেকচারটি ফাইল আকারে সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে অনলাইন ক্লাস ফলপ্রসূ হবে।মোটকথা, অনলাইন কার্যক্রমে কেউ যাতে হয়রানির স্বীকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য  রেখে  অনলাইন ক্লাস নেয়া উদ্যোগটি  বাস্তবায়নে আশাবাদী।
রামীম হাসান, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, তিতুমীর কলেজ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন কার্যক্রমে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এরকম দীর্ঘসময় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকা আমাদের জন্যও ক্ষতিকর। কিন্তু সেই অনলাইন কার্যক্রম সবার জন্য যথার্থ না। সবার  অার্থিক অবস্থা এক রকম না। আমাদের কলেজের বেশীরভাগ ছেলে মেয়ে গ্রাম থেকে আসা। তার উপর মেগাবাইটের দাম আকাশ ছোঁয়া। অন্যদিকে, গ্রাম অঞ্চলের ইন্টারনেট ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তবে, ইন্টারনেটের জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা যদি আমাদের দেয়া হয় আমরা অনলাইন কার্যক্রমের জন্য তৈরি।
শ্যামলী তানজিন অনু, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: করোনা মহামারীতে জীবন সংকটময়। উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে অতিষ্ট জীবন। এরই মধ্যে ইদের পর অনলাইন ক্লাস নেওয়াও শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ তিনমাস ফলে যারা টিউশনির টাকায় চলে তাদের উপার্জনের রাস্তাও বন্ধ। পরিবার থেকে টাকা নিয়ে ডাটা কিনে ক্লাস করা অসম্ভব।  এখন ইন্টারনেট প্যাকের যে দাম তা একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীর পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাছাড়া অনলাইন  ক্লাসে উপস্থিত সংখ্যা কম। ক্লাসে মনোযোগও কম থাকে। উপস্থিত অনেকে  কানেক্ট হয়ে অন্য কাজেও ব্যস্ত থাকে। এদিকে গ্রাম অঞ্চলে যাদের বসবাস তাঁদের ইন্টারনেট কানেকশন খুবই বাজে।একটা ফটো শো করতে অনেকটা সময় লাগে। ফলে কেউ কেউ অনলাইন ক্লাস করতে বাড়ি থেকেও দুরে যায় শুধু কানেকশন ভালো পাবার জন্য। তারপরেও সমস্যা।বর্ষা চলে অাসায় বর্তমানে আবহাওয়া নাজুক। একটু বৃষ্টি বাতাস হলেই গ্রামে  বিদ্যুৎ বিভ্রাট। আর বিদ্যুৎ চলে গেলে নেটের গতি শূণ্যতে নেমে যায়।
এটা ঠিক পড়াশোনা প্রায় অচলাবস্থা। তবুও করোনায় যেখানে জীবন অতিষ্ট , সেখানে এতো সংকটের মধ্যে  অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত কতোটা যৌক্তিক তা বোধে আসেনা।
শিক্ষা হোক সবার জন্য