৯০ দশকের প্রথম ভাগে কাশ্মিরে একটি মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া ও পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেনজির ভুট্টো। বেনজির তখন দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন খালেদা জিয়াকে। স্বাভাবিকভাবেই কূটনীতিক প্রথা অনুসারে ফিরতি জবাবও তৈরি করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা অনেক কিছু বিবেচনায় রেখে বেনজিরের চিঠির জবাব দেন— ‘বাংলাদেশ মধ্যস্থতা করতে রাজি আছে, যদি দুই দেশ এতে সম্মত হয়।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন একাধিক কূটনীতিক বলেছেন, ঢাকা সবসময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। কোনও বিরোধ বা অনুরোধে কোনও পক্ষ অবলম্বন করেনি।
ভারতে দায়িত্বপালনকারী বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক করিম বলেন, ‘আমার মনে পড়ছে না, আমরা কখনও কারও পক্ষ নিয়েছি।’
তবে তিনি বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ে জেনারেল জিয়ার সময় একবার আমরা ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে অবস্থান নিয়েছিলাম।’
কূটনীতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রতিটি দেশই সমান, কিন্তু বাস্তবে আয়তন, ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে এটি সত্যি নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে ঠিক করতে হবে, এই সম্পর্কের মাত্রা কী হবে এবং আচরণ কেমন হবে। কখনও কখনও কোনও কথা বলার থেকে চুপ থাকা ভালো। আবার কখনও ঝুঁকি না নিয়ে নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখা সমীচীন। কখন কী করতে হবে, এটি একটি দেশ নিজস্বভাবে নির্ধারণ করে থাকে। আমার মনে হয়, আমরা এখনও পর্যন্ত ঠিকভাবে এটি করেছি।’
ভারতে রাষ্ট্রদূত ও চীনে মিশন উপ-প্রধান হিসেবে কাজ করা করিম বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে টেনশন থাকবে। চীন সবসময় চায় আমরা যেনো তাদের পাশাপাশি থাকি। একই জিনিস ভারতও চায়।’
ভারতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে তাদের এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে এবং আমি বলেছি, চীন যে পরিমাণ অর্থ দিতে পারে, তোমরা কি সেটি দিতে পারবে।’
চীনের বিষয়ে তারিক করিম বলেন, ‘১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী হঠাৎ চীন সফর করেন। ওই সফরের দুই সপ্তাহ আগ পর্যন্ত চিরাচরিত ভাষায় চীন বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘রাজীবের সফরের পর দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের এ বিষয়ে ব্রিফ করেন চীনের কর্মকর্তারা। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
সাবেক এই কূনীতিক বলেন, ‘‘কর্মকর্তারা আমাদের তখন বললেন— দিল্লি ও বেইজিং ‘পঞ্চশীলা নীতি’ প্রণয়ন করেছে। এটি আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আমরা আবারও সেটি উজ্জীবিত করছি। এ বিষয়ে আমরা যথাযথ কাজ করবো।’’
চীনের কর্মকর্তারা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে ভারতের সঙ্গে বিবাদ মীমাংসা করে ফেলারও পরামর্শ দেন ওই বৈঠকে বলে জানান তারিক করিম।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়াটা সবচেয়ে ভালো এবং এখনও পর্যন্ত আমরা সেটাই করছি।’
ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক অনেক বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের বিনিয়োগ দরকার এবং সেটি বড় আকারে দিতে পারে চীন। আবার ভারতের সঙ্গে আমাদের বহুমুখী সম্পর্ক আছে এবং তার মধ্যে বিনিয়োগও আছে তবে পরিমাণে কম।’
কৌশলগত কিছু বিষয়ে অনেক সময় ভারত আমাদের চাপ দিয়েছে এবং প্রয়োজনের খাতিরে সেটি আমাদের মেনেও নিতে হয়েছে বলে তিনি জানান।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি আমাদের বজায় রাখতে হবে।’
ভারতে বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কাছে সবসময় ভারতের গুরুত্ব বেশি। এটি আগেও দিয়েছি, দিচ্ছি ও ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবো। এ বিষয়ে আমরা সজাগ। সব সরকার ভারতকে গুরুত্ব দিয়েছে।’
নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে ভারতকেও কখনও সমর্থন দেয়নি বাংলাদেশ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারত ও চীন জানে বাংলাদেশ কোনও পক্ষ নেবে না। আমার মনে হয়, আমাদের এই অবস্থানটি এখনও আছে।’
মিডিয়ায় যেটাই ছাপা হোক না কেন ভারতের গুরুত্ব কমেনি এবং কমবেও না জানিয়ে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘তবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতির যে অবস্থান, সেখান থেকে সরে গিয়ে কোনও অবস্থান নেওয়ার জন্য অনুরোধও করা হয় না। কারণ, তারা আমাদের সীমাবদ্ধতা জানে।’
বিজনেস বাংলাদেশ/ প্রান্ত

























