১১:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

নারী শিক্ষা প্রসারে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)

হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) (১৮৭৩-১৯৬৫) একজন শিক্ষাবিদ, শিক্ষাসংস্কারক, সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা, সুফি, সমাজসেবক। ১৮৭৩ সালে ডিসেম্বর মাসের কোন এক শনিবার সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার, ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি কলকাতার লন্ডন মিশনারি স্কুল থেকে ১৮৯০ সালে এন্ট্রান্স (বর্তমান এস,এস,সি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি লাভ করেন। তিনি হুগলি কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে এফ.এ (বর্তমানে এইচ.এস.সি), ১৮৯৪ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন এবং ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর দীর্ঘ চাকরি জীবনের সম্পূর্ণটাই কেটেছে শিক্ষা বিভাগে। একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসন গ্রহণ এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ছিল সত্যিই অনন্য। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরের চাকরিজীবনে আহ্ছানউল্লা একদিকে ছিলেন আদর্শবাদী ও কর্তব্যনিষ্ঠ, অন্যদিকে ছিলেন অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষা সম্প্রসারণে অত্যন্ত তৎপর। চট্টগ্রামে চাকরিকালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের (ওঊঝ) অন্তভূক্ত হন। তিনি কিছুদিন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদ ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনিই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির মানোন্নয়ন করে মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথ উন্মুক্ত করেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে উত্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পর্যালোচনার জন্য গঠিত স্পেশাল কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রভাবশালী হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষাকে চিহ্নিত করেছিলেন। সামগ্রিক শিক্ষা উন্নয়নের পাশাপাশি নারী শিক্ষা উন্নয়নে হজরত খানবাহাদুর (র.) অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ ‘বিদ্যা শিক্ষা করা প্রতিটি নর-নারীর জন্য ফরজ’ ইছলামের এই নির্দেশনা এবং নবীজীর অমর বাণী ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যার্জন কর’ এটা খানবাহাদুর আছানউল্লা (র.) মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই বাল্যকাল থেকেই মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তিনি বৈষয়িক শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের শিক্ষাদানে মায়ের ভ‚মিকা বেশি থাকে। গৃহিণী সুমাতা হলে সংসারে শান্তি বিরাজ করে। তাই মাতাকে কর্তব্য পরায়ণ হতে হলে তাঁর সুশিক্ষার প্রয়োজন।’ তিনি আরো বলেন, ‘খোদার অভিপ্রেত নয় মানবজাতির অর্ধাংশ অন্তঃপুরে আবদ্ধ থেকে কেবল গার্হস্থ্য কার্য করবে। আধুনিক শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা পুরুষের কাজে সহায়তা করতে পারে, হিসাব ও সওদাপত্র করতে পারে, শিক্ষিকার কাজ করতে পারে, রাজনীতি, শাসনকার্য ও দেশ রক্ষায় সহায়তা করতে পারে। সমাজে সমগ্র জীবন যাত্রায় যেহেতু নারী পুরুষ উভয়েরই উপস্থিতি রয়েছে। তাই শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যতীত কখনই সুন্দর সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তবে সেক্ষেত্রে নারীদের মান, সম্ভ্রম ও মর্যাদা সমুন্নত রেখেই এগোতে হবে।” উল্লেখ্য, নারী শিক্ষায় তাঁর আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৎকালে মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছাকে উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেতে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। এই ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন খানবাহাদুর আছানউল্লা (র.) এঁর পত্রবধু এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) – এঁর পক্ষে এদেশের নারী শিক্ষা উন্নয়নের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের এবং সফলতার পিছনে ছিল তাঁর অধ্যবসায়, সৎসাহস, নিরলস কর্মপরিচালনা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট তাঁর বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ব্যারিস্টার রবাট নাথানের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের নারী শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয় যেখানে চট্টগ্রামের ইন্সপেক্টর হিসেবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষিত করতে সেসময় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা কমিটিকে নানাভাবে সহায়তা করেন। তৎকালীন জনশিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর মি. হেনরি শার্পের নিকট আরো অনেকের সাথে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এক পত্র দ্বারা নারী শিক্ষা বিষয়ে তাঁর মতামত জানান এবং মি. শার্প খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার মতামতকে বেশি প্রধান্য দিয়ে সেটা নাথান নারী শিক্ষা কমিটিকে জানিয়েছিলেন। পত্রে দেখা গিয়েছে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা নতুন বই-পুস্তক তৈরির সুপারিশ করেন এবং সেটা কার্যকর হয়েছিল। এছাড়াও ছাত্রীদের গ্রামার শিক্ষা, পান্ডুলিপি পঠন, পাটীগণিত শিক্ষা, নোট লেখা, ইতিহাস পাঠ, ছবি আঁকা ও গান-বাজনা শিক্ষার বিষয়ে তিনি মতামত দিয়েছিলেন এবং সেগুলোও বিবেচনায় আনা হয়।

ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত মুছলিম নারী শিক্ষা বিষয়ক সাব-কমিটিতে অন্যতম একজন সদস্য হিসেবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সাব-কমিটির সভাগুলোর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে নতুন প্রদেশের সকল আঞ্জুমান ও খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের নিকট একটি সার্কুলার পত্র প্রেরণ করা হয়। উক্ত সার্কুলারে জানানো হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় অন্তঃত ১০টি করে উন্নত গার্লস স্কুল ও কেন্দ্রীয়ভাবে একটি নারী শিক্ষা প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে। পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের নারীদের শিক্ষার ঊপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য গঠিত ০৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতেও খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করেন। এভাবে দেখা যায়, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ও তাঁর সহকমীগণ নারী শিক্ষার বিষয়ে যেসব বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো ছিল যুগান্তকারী ব্যবস্থা এবং ঐগুলো বিষেশভাবে ফলপ্রসূ হয়েছিল।

শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯১১ সালে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ওই বছর ২৮ জুন শিক্ষার প্রসারে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লন্ডনের ‘রয়্যাল সোসাইটি ফর দি এনকারেজমেন্ট অব আর্টস, ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড কমার্স’-এর সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তিনি এম.আর.এস.এ উপাধি লাভ করেন এবং ‘হুজ হু ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে তাঁর জীবনী প্রকাশিত হয়।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা কতৃক প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং সুপারিশে এদেশে অনেক গার্লস স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষিকা নিয়োগ করে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বানপাড়া গার্লস হাই স্কুল; চট্টগামে অপণাচরণ সিটি করপোরেশন গার্লস স্কুল; কলকাতা মুসলিম এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গার্লস কলেজ অন্যতম।

লেখক পরিচিতি:
শারমিন রহমান
প্রকল্প সমন্বয়কারী
স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

তাপদাহের কারণে ঢাকাসহ ৫ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা

নারী শিক্ষা প্রসারে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)

প্রকাশিত : ০৯:৪০:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩

হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) (১৮৭৩-১৯৬৫) একজন শিক্ষাবিদ, শিক্ষাসংস্কারক, সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা, সুফি, সমাজসেবক। ১৮৭৩ সালে ডিসেম্বর মাসের কোন এক শনিবার সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার, ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি কলকাতার লন্ডন মিশনারি স্কুল থেকে ১৮৯০ সালে এন্ট্রান্স (বর্তমান এস,এস,সি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি লাভ করেন। তিনি হুগলি কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে এফ.এ (বর্তমানে এইচ.এস.সি), ১৮৯৪ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন এবং ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর দীর্ঘ চাকরি জীবনের সম্পূর্ণটাই কেটেছে শিক্ষা বিভাগে। একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসন গ্রহণ এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ছিল সত্যিই অনন্য। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরের চাকরিজীবনে আহ্ছানউল্লা একদিকে ছিলেন আদর্শবাদী ও কর্তব্যনিষ্ঠ, অন্যদিকে ছিলেন অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষা সম্প্রসারণে অত্যন্ত তৎপর। চট্টগ্রামে চাকরিকালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের (ওঊঝ) অন্তভূক্ত হন। তিনি কিছুদিন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদ ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনিই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির মানোন্নয়ন করে মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথ উন্মুক্ত করেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে উত্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পর্যালোচনার জন্য গঠিত স্পেশাল কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রভাবশালী হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষাকে চিহ্নিত করেছিলেন। সামগ্রিক শিক্ষা উন্নয়নের পাশাপাশি নারী শিক্ষা উন্নয়নে হজরত খানবাহাদুর (র.) অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ ‘বিদ্যা শিক্ষা করা প্রতিটি নর-নারীর জন্য ফরজ’ ইছলামের এই নির্দেশনা এবং নবীজীর অমর বাণী ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যার্জন কর’ এটা খানবাহাদুর আছানউল্লা (র.) মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই বাল্যকাল থেকেই মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তিনি বৈষয়িক শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের শিক্ষাদানে মায়ের ভ‚মিকা বেশি থাকে। গৃহিণী সুমাতা হলে সংসারে শান্তি বিরাজ করে। তাই মাতাকে কর্তব্য পরায়ণ হতে হলে তাঁর সুশিক্ষার প্রয়োজন।’ তিনি আরো বলেন, ‘খোদার অভিপ্রেত নয় মানবজাতির অর্ধাংশ অন্তঃপুরে আবদ্ধ থেকে কেবল গার্হস্থ্য কার্য করবে। আধুনিক শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা পুরুষের কাজে সহায়তা করতে পারে, হিসাব ও সওদাপত্র করতে পারে, শিক্ষিকার কাজ করতে পারে, রাজনীতি, শাসনকার্য ও দেশ রক্ষায় সহায়তা করতে পারে। সমাজে সমগ্র জীবন যাত্রায় যেহেতু নারী পুরুষ উভয়েরই উপস্থিতি রয়েছে। তাই শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যতীত কখনই সুন্দর সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তবে সেক্ষেত্রে নারীদের মান, সম্ভ্রম ও মর্যাদা সমুন্নত রেখেই এগোতে হবে।” উল্লেখ্য, নারী শিক্ষায় তাঁর আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৎকালে মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছাকে উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেতে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। এই ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন খানবাহাদুর আছানউল্লা (র.) এঁর পত্রবধু এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) – এঁর পক্ষে এদেশের নারী শিক্ষা উন্নয়নের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের এবং সফলতার পিছনে ছিল তাঁর অধ্যবসায়, সৎসাহস, নিরলস কর্মপরিচালনা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট তাঁর বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ব্যারিস্টার রবাট নাথানের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের নারী শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয় যেখানে চট্টগ্রামের ইন্সপেক্টর হিসেবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষিত করতে সেসময় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা কমিটিকে নানাভাবে সহায়তা করেন। তৎকালীন জনশিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর মি. হেনরি শার্পের নিকট আরো অনেকের সাথে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এক পত্র দ্বারা নারী শিক্ষা বিষয়ে তাঁর মতামত জানান এবং মি. শার্প খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার মতামতকে বেশি প্রধান্য দিয়ে সেটা নাথান নারী শিক্ষা কমিটিকে জানিয়েছিলেন। পত্রে দেখা গিয়েছে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা নতুন বই-পুস্তক তৈরির সুপারিশ করেন এবং সেটা কার্যকর হয়েছিল। এছাড়াও ছাত্রীদের গ্রামার শিক্ষা, পান্ডুলিপি পঠন, পাটীগণিত শিক্ষা, নোট লেখা, ইতিহাস পাঠ, ছবি আঁকা ও গান-বাজনা শিক্ষার বিষয়ে তিনি মতামত দিয়েছিলেন এবং সেগুলোও বিবেচনায় আনা হয়।

ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত মুছলিম নারী শিক্ষা বিষয়ক সাব-কমিটিতে অন্যতম একজন সদস্য হিসেবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সাব-কমিটির সভাগুলোর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে নতুন প্রদেশের সকল আঞ্জুমান ও খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের নিকট একটি সার্কুলার পত্র প্রেরণ করা হয়। উক্ত সার্কুলারে জানানো হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় অন্তঃত ১০টি করে উন্নত গার্লস স্কুল ও কেন্দ্রীয়ভাবে একটি নারী শিক্ষা প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে। পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের নারীদের শিক্ষার ঊপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য গঠিত ০৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতেও খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করেন। এভাবে দেখা যায়, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ও তাঁর সহকমীগণ নারী শিক্ষার বিষয়ে যেসব বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো ছিল যুগান্তকারী ব্যবস্থা এবং ঐগুলো বিষেশভাবে ফলপ্রসূ হয়েছিল।

শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯১১ সালে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ওই বছর ২৮ জুন শিক্ষার প্রসারে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লন্ডনের ‘রয়্যাল সোসাইটি ফর দি এনকারেজমেন্ট অব আর্টস, ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড কমার্স’-এর সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তিনি এম.আর.এস.এ উপাধি লাভ করেন এবং ‘হুজ হু ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে তাঁর জীবনী প্রকাশিত হয়।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা কতৃক প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং সুপারিশে এদেশে অনেক গার্লস স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষিকা নিয়োগ করে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বানপাড়া গার্লস হাই স্কুল; চট্টগামে অপণাচরণ সিটি করপোরেশন গার্লস স্কুল; কলকাতা মুসলিম এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গার্লস কলেজ অন্যতম।

লেখক পরিচিতি:
শারমিন রহমান
প্রকল্প সমন্বয়কারী
স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ