টানা কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।এতে তলিয়ে যাচ্ছে রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে করে রংপুরের গংগাচড়া, কাউনিয়া এলাকার নিচু ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে এবং নিম্নাঞ্চলের শাকসবজি, রোপা আমনসহ বীজতলা তলিয়ে গেছে। এসব উপজেলার কয়েকহাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরেছেন।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সড়ক সেতুর পশ্চিম তীরে সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ৬০ মিটার এলাকা ধসে পড়েছে।এতে বাঁধে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতের ধাক্কায় পুরো বাঁধই ঝুঁকির মুখে।
স্থানীয়রা বলছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সেতু ও সংলগ্ন রংপুর–লালমনিরহাট মহাসড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট)সকালে তিস্তা সেতুর পশ্চিম পাশের প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ সেতু রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে স্রোতের তীব্রতা বেড়েই চলছে।এর ফলে বাঁধের নিচের মাটি ধুয়ে গিয়ে ব্লকগুলো ধসে পড়ছে এবং বাকি অংশও ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে।তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তীব্র স্রোতের ধাক্কায় পুরো বাঁধই এখন ঝুঁকির মুখে। তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।
মহিপুর এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, “গত দুই বারের বন্যায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো মেরামতের উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।এখন নদীতে পানি বাড়তেই বাঁধের বড় অংশ ধসে বিশাল গর্ত হয়েছে। তিন গ্রামের এক হাজারের বেশি পরিবার ও সেতুটি ঝুঁকিতে পড়ছে।
২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) প্রায় ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে গঙ্গাচড়ার মহিপুরে তিস্তার ওপর দ্বিতীয় সড়ক সেতুটি নির্মাণ করে।সেতুটি রংপুর–লালমনিরহাট জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ করেছে।কিন্তু বর্তমান ভাঙন যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে সেতু ও সংলগ্ন সড়ক মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘন্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়ন, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন এবং পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর, দ্বীপচরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।বন্যার আশঙ্কায় অনেকে ঘরবাড়ি নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান,বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গেলে তিস্তার পানি সরাসরি রংপুর–লালমনিরহাট সড়কে আঘাত করবে, যা ভেঙে গেলে দুই জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে।পাশাপাশি তিনটি গ্রামের অন্তত দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করেনি তারা।
তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় গঙ্গাচড়া,কাউনিয়া ও পীরগাছার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চরাঞ্চল ও দ্বীপচরের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সকাল থেকে অনেক ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, শখের বাজার, চিলাখালসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
মর্ণেয়া ইউনিয়নের আনছারটারী গ্রামের আলেফ উদ্দীন বলেন, “পানি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে চারণভূমি ডুবে গেছে, পশুখাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে।
নোহালী ইউনিয়নের চর নোহালী, চর বাগডহরা, চর বৈরাতি ও আশ্রয়ণ বাজার এলাকায়ও শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে বলে জানিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ আলী।
পীরগাছার তিস্তা বেষ্টিত ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় সাম্প্রতিক ভাঙনে শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।শুধু শিবদেব গ্রামেই ৪৯টি বসতবাড়ি, একটি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হারিয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ পরিবারের মাঝে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এক বান্ডিল ঢেউটিন ও নগদ ৩ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, সাময়িক সহায়তা নয়, দীর্ঘমেয়াদি ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।
গঙ্গাচড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন,বন্যায় তিস্তার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের তালিকা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার পঞ্চগড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর সঙ্গে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় তিস্তার উজানে পানি দ্রুত বেড়েছে।ফলে রংপুর অঞ্চলে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ডিএস./