০৫:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাবা-মা ও ভাইয়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তোফাজ্জল

বরগুনা প্রতিবেদক:
গ্রামের বাড়ি বাঁশ বাগানের নিচে চিরনের শায়িত হলেন নিহত তোফাজ্জল। বরগুনার পাথরঘাটায় জানাজা শেষে বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় মাসুদ কামাল তোফাজ্জল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে পিটিয়ে হত্যা করা বরগুনার মানষিক ভারসাম্যহীন যুবক মাসুদ কামাল তোফাজ্জলের মরদেহ তার প্রিয় গ্রাম পাথরঘাটায় দাফন করা হয়।

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে বরগুনা পাথরঘাটার তালুক গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে বাবা, মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। এর আগে শুক্রবার সকাল নয়টায় স্থানীয় মাদরাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল নামে। এ সময় তারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

চার বছর আগে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ না থাকায় তোফাজ্জলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়নি। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন তোফাজ্জল।

বুধবার চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটক করে ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা পর্যন্ত হলের গেস্টরুমে কয়েক দফা মারধর করা হয় তাকে। এক পর্যায়ে ক্যান্টিনে বসিয়ে খাবারও খাওয়ায় শিক্ষার্থীরা। এরপর আবারও মারধর করা হয়। এ সময় তোফাজ্জল অসুস্থ হয়ে পড়লে মধ্যরাতে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্থানীয়রা জানান, মেধাবী তোফাজ্জল হোসেন একসময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। পড়াশোনা করতেন পাথরঘাটা কলেজে। স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত সজন, পরিচ্ছন্ন ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তোফাজ্জেল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার পরিবারে নেমে আসে একের পর এক স্বজন হারানোর বেদনা। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার বাবা।

২০১৩ সালে মা বিউটি বেগম মারা যান, এরপর ২০২৩ সালে ভাই পুলিশের এএসআই নাসির উদ্দিনও মারা যান। একের পর এক মৃত্যুর শোকের মধ্যে তোফাজ্জলের প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন তার প্রভাবশালী বাবা এবং মেয়ের বিয়ের আগে সন্ত্রাসীদের দিয়ে মারধর করান তোফাজ্জলকে। এরপর থেকে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তোফাজ্জল।

তোফাজ্জেলের ভাবী শরিফা বলেন, গত কাল রাতে অপরিচিত একটি মোবাইল ফোন নম্বর (০১৭৪৩৭৪৫৪২৬) থেকে আমার ফোনে কল আসে। কলটি ধরার পরেই অপর প্রান্ত থেকে এক লোক তোফাজ্জল কী হয় তা জানতে চান। পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘সে চুরি করে ধরা পড়েছে, তাকে বাঁচাতে হলে ২ লাখ টাকা দিতে হবে।’ এরপর তারা ফোনে ধমক দিতে থাকেন এবং বলেন কোনো মিথ্যা কথা বলবেন না, তাহলে সমস্যা হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পরে বিভিন্ন লোকজন জানান তোফাজ্জল মারা গেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীর বংশ-পরিচয় দেওয়ার মতো আর কিছুই রইল না। আমার দুই সন্তান বাবাহারা, তাদের একজন চাচা ছিল, তাও শেষ করে দিল। আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম, সরকারের কাছে দাবি যাতে করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেওয়া হয়।

তোফাজ্জলের চাচা ফজলুর রহমান বলেন, ‘তোফাজ্জলের বাবা আব্দুর রহমান প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান। এর তিন বছর পর তার মা মারা যান। এর পর থেকেই মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েন এবং বড় ভাই নাসিরের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। ভাইও দুই বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন তোফাজ্জল। এর কিছুদিন পর একটি প্রেম গঠিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাজারের ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুর রহমান ও তার লোকজন তাকে মারধর করেন। এর পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কাউকে কিছুই করতেন না। শুধু পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ২০ টাকা বা ৫০ টাকা টাকা চেয়ে নিতেন। আমি কখনোই তাকে চুরি করতে দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে যে চুরি অপবাদ দেওয়া হয়েছে, এর কোনো সত্যতা পাইনি। আমরা অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন বলেন, ‘তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল, এটা আমি জানি। তার সঙ্গে যেটা হয়েছে এটা অমানবিক। যেসব নম্বর থেকে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে, সেসব নম্বর বর্তমানে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’

মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্মম নির্যাতন করে মেরে ফেলায় ক্ষুব্ধ পাথরঘাটার স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের দাবি, খুনি কখনও মেধাবী হতে পারে না। অপরাধীর পরিচয় শুধু অপরাধীই। তাই তারা তোফাজ্জলকে নির্যাতনকারী সকলের শাস্তির দাবি করেছেন।

/রুদ্র

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

বাবা-মা ও ভাইয়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তোফাজ্জল

প্রকাশিত : ০২:৫০:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বরগুনা প্রতিবেদক:
গ্রামের বাড়ি বাঁশ বাগানের নিচে চিরনের শায়িত হলেন নিহত তোফাজ্জল। বরগুনার পাথরঘাটায় জানাজা শেষে বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় মাসুদ কামাল তোফাজ্জল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে পিটিয়ে হত্যা করা বরগুনার মানষিক ভারসাম্যহীন যুবক মাসুদ কামাল তোফাজ্জলের মরদেহ তার প্রিয় গ্রাম পাথরঘাটায় দাফন করা হয়।

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে বরগুনা পাথরঘাটার তালুক গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে বাবা, মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। এর আগে শুক্রবার সকাল নয়টায় স্থানীয় মাদরাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল নামে। এ সময় তারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

চার বছর আগে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ না থাকায় তোফাজ্জলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়নি। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন তোফাজ্জল।

বুধবার চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটক করে ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা পর্যন্ত হলের গেস্টরুমে কয়েক দফা মারধর করা হয় তাকে। এক পর্যায়ে ক্যান্টিনে বসিয়ে খাবারও খাওয়ায় শিক্ষার্থীরা। এরপর আবারও মারধর করা হয়। এ সময় তোফাজ্জল অসুস্থ হয়ে পড়লে মধ্যরাতে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্থানীয়রা জানান, মেধাবী তোফাজ্জল হোসেন একসময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। পড়াশোনা করতেন পাথরঘাটা কলেজে। স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত সজন, পরিচ্ছন্ন ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তোফাজ্জেল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার পরিবারে নেমে আসে একের পর এক স্বজন হারানোর বেদনা। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার বাবা।

২০১৩ সালে মা বিউটি বেগম মারা যান, এরপর ২০২৩ সালে ভাই পুলিশের এএসআই নাসির উদ্দিনও মারা যান। একের পর এক মৃত্যুর শোকের মধ্যে তোফাজ্জলের প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন তার প্রভাবশালী বাবা এবং মেয়ের বিয়ের আগে সন্ত্রাসীদের দিয়ে মারধর করান তোফাজ্জলকে। এরপর থেকে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তোফাজ্জল।

তোফাজ্জেলের ভাবী শরিফা বলেন, গত কাল রাতে অপরিচিত একটি মোবাইল ফোন নম্বর (০১৭৪৩৭৪৫৪২৬) থেকে আমার ফোনে কল আসে। কলটি ধরার পরেই অপর প্রান্ত থেকে এক লোক তোফাজ্জল কী হয় তা জানতে চান। পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘সে চুরি করে ধরা পড়েছে, তাকে বাঁচাতে হলে ২ লাখ টাকা দিতে হবে।’ এরপর তারা ফোনে ধমক দিতে থাকেন এবং বলেন কোনো মিথ্যা কথা বলবেন না, তাহলে সমস্যা হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পরে বিভিন্ন লোকজন জানান তোফাজ্জল মারা গেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীর বংশ-পরিচয় দেওয়ার মতো আর কিছুই রইল না। আমার দুই সন্তান বাবাহারা, তাদের একজন চাচা ছিল, তাও শেষ করে দিল। আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম, সরকারের কাছে দাবি যাতে করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেওয়া হয়।

তোফাজ্জলের চাচা ফজলুর রহমান বলেন, ‘তোফাজ্জলের বাবা আব্দুর রহমান প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান। এর তিন বছর পর তার মা মারা যান। এর পর থেকেই মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েন এবং বড় ভাই নাসিরের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। ভাইও দুই বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন তোফাজ্জল। এর কিছুদিন পর একটি প্রেম গঠিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাজারের ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুর রহমান ও তার লোকজন তাকে মারধর করেন। এর পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কাউকে কিছুই করতেন না। শুধু পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ২০ টাকা বা ৫০ টাকা টাকা চেয়ে নিতেন। আমি কখনোই তাকে চুরি করতে দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে যে চুরি অপবাদ দেওয়া হয়েছে, এর কোনো সত্যতা পাইনি। আমরা অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন বলেন, ‘তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল, এটা আমি জানি। তার সঙ্গে যেটা হয়েছে এটা অমানবিক। যেসব নম্বর থেকে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে, সেসব নম্বর বর্তমানে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’

মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্মম নির্যাতন করে মেরে ফেলায় ক্ষুব্ধ পাথরঘাটার স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের দাবি, খুনি কখনও মেধাবী হতে পারে না। অপরাধীর পরিচয় শুধু অপরাধীই। তাই তারা তোফাজ্জলকে নির্যাতনকারী সকলের শাস্তির দাবি করেছেন।

/রুদ্র