০৭:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

তোমারই আজ জয়

‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্তভাবনাহীন, তুমি ফিরে এলে অপূর্ণতা ঘুচে, বাংলাদেশ হলো পূর্ণ স্বাধীন।’ ‘মৃত্যুর দুয়ার ভেঙ্গে অমরত্ব লভিয়াছ/ তুমি জ্যোতির্ময়/ পূর্ণ কর স্বাধীনতা মুক্ত কর ভয়/ তোমারই আজ জয়।’

আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক অনন্য দিন। স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ’৭২ সালের এ দিনেই পাকিস্তানে দীর্ঘ কারাবাস শেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন বাঙালির অবিসংবাদিত এ নেতা। জাতির জনক স্বয়ং তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা।’ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে আজ জাতি পালন করছে ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।

নয় মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালি বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। জীবন মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনেই পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

অদম্য সাহসী এবং বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি কারাগারে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হলেও অকুতোভয় ও লড়াকু মনোবৃত্তির বঙ্গবন্ধুকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। এমনকি পাকিস্তানের কারাগারে রাখার সময় প্রহসনমূলক মামলা দিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। খোঁড়া হয়েছিল কবর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র গতিতে বেগবান হয়েছিল। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। বাঙালিকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী এদেশে গণহত্যা শুরু করলে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করতে চেষ্টা করলেও কখনও পারেনি দাবিয়ে রাখতে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কান্ডারি পাকিস্তানি কারাগারে থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল প্রেরণাদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। যখন ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হয় তখনও বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। এ প্রসঙ্গে বেবী মওদুদ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুজিব সাহেবের স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে যখন দেশের রাষ্ট্র্রপতির স্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে নিরাপত্তা, পিওন-আর্দালি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হলেও তিনি তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের রাষ্ট্রপতি এখনও মুক্ত হননি। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমি এসব নিয়ে কি করব?’ একজন খাঁটি হৃদয়ের দেশপ্রেমিক বাঙালি রমণী, যিনি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে তাঁর মতোই দেশকে ভালবেসেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঠিক সারথি ছিলেন- দেশমাতৃকার মুক্তি সাধনে অকৃত্রিম ও নানামুখী উৎসের সহায়তা করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার অনস্বীকার্য ও অনুকরণীয় অবদান ছিল। এই মহীয়সী নারীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাবোধ। পরাস্ত পাকিস্তানিশাসকরা বুঝতে পেরেছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমানের যে অকৃত্রিম দেশপ্রেম এবং সে দেশপ্রেমের ফল্গুধারায় বাঙালি তাঁকে অবিসংবাদিত নেতার আসনে বসিয়েছে এবং তাঁকে ঘিরেই স্বাধীনতা সংগ্রাম করে তাঁর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে, তখন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিকারাগারে রেখে দিলে দেশ-বিদেশের নানামুখী চাপে তারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। বাধ্য হয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দেয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর একটা একচল্লিশ মিনিটে এদেশের মাটিতে তিনি ফিরে আসেন। এর আগে তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যান এবং পরে সেখান থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফেরত আসেন।

পাকিস্তানিবাহিনী কর্তৃক ধৃত হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে সর্বদা উচ্চারিত হতো ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ আজও সাধারণ বাঙালিকে গভীরভাবে আলোড়িত করে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ১৯২২-এর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতা থেকে উৎসারিত হয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। কবিতায় কবি লিখেছিলেন যে, ‘জয় বাংলা’র পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ/ জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি/ জয় প্রাণ অন্তহীন।’-কবির চিত্রকল্পের বাস্তবতার বিমূর্ত হয়েছেন জাতির জনক। দেশবাসীকে পাকিস্তানিশোষক-শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করতে তিনি সুগভীর প্রয়াস পরিকল্পনা এবং সফল বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেন। মানুষকে উদ্দীপ্ত করেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে, স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার প্রয়াস গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা এই অঞ্চলজুড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষকে আলোড়িত করে। পরবর্তী নয় মাস, বঙ্গবন্ধুর অটল বিশ্বাস, সাহস ও দেশপ্রেম ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। পাকিস্তানি কারাগারে থাকায় তিনি এ যুদ্ধে, মধ্যে শামিল ছিলেন পরোক্ষভাবে। পাশাপাশি যারা সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন তাদের কাছে তাঁর নির্দেশ ছিল সর্বাত্মক প্রতিরোধ করা। কিছু রাজাকার-আলবদর-আলশামস মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কারাগার থেকে বাংলার বন্ধু মুজিব হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত উৎসাহের বিমূর্ত প্রতিমূর্তি। মুক্তিবাহিনী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। মৃত্যু, নির্যাতন, শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা কোনটাই মুক্তিবাহিনীকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে বার্তা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় যে, অকুতোভয় মুজিব বলেছিলেন, এটিই আমার শেষ বার্তা হতে পারে। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশবাসীর প্রতি আহবান জানাই, আপনি যেখানেই থাকুন এবং যা কিছু আপনার সঙ্গে থাকুক না কেন- শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। তিনি আরও আহবান জানান যে, যতক্ষণ না পাকিস্তানিদখলদার সেনাদের শেষ সৈনিক পর্যন্ত বাংলার মাটি থেকে বহিষ্কার করা যাবে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনারা লড়াই অবশ্যই অব্যাহত রাখবেন।
বস্তুত ৭ মার্চ, ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই বাঙালি প্রস্তুত হচ্ছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানিবাহিনী যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু করে তার যোগ্য জবাব বাঙালিরা দিতে পিছপা হয়নি। দি নিউইউর্য়ক টাইমসের ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২-এর সংখ্যায় এ্যান্থনি লুইস ‘শেখ মুজিব, মুক্ত, ব্রিটেন পৌঁছেছেন’ শিরোনামের প্রামাণিক দলিলে লিখেছেন, শেখ মুজিব লন্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, একটি স্বাধীন বাঙালি জাতি এখন চরম বাস্তবতা এবং বিশ্বের সমস্ত দেশকে তার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি জানাতে এবং সহায়তা দেয়ার জন্য তিনি আবেদন করেছেন, যাতে করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা না যান। পূর্ব বাংলার অবিসংবাদি নেতা হিসেবে উল্লেখ করে সাংবাদিক লিখেছেন যে, বাংলাদেশের মনোনীত রাষ্ট্রপতির কাছে স্বপ্ন পূরণে দেশ স্বাধীন হওয়ার অভিব্যক্তিতে অত্যন্ত আবেগঘন পরিবেশ বিরাজ করছিল। বাংলাদেশের বিজয়ের পর পাকিস্তানিশাসক মহলেও পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৯ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খান আরেক চালবাজ জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এ সময় তিনি সিল মেরে সমন্বিত খাম ভুট্টোকে দেন। এতে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া লিখেছিলেন যে, আমি মুজিবকে ফাঁসিতে না ঝুঁলিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। কি দুঃসাহস পাকিস্তানিস্বৈরাচারী শাসকের বাংলার নয়নের মণিকে তিনি ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলেন। ওই খামের কাগজে মুজিব সাহেবকে ফাঁসি দেয়ার আদেশ ছিল, কেবল তারিখ ছিল না এবং এটি ভুট্টোকে ঠিক করার জন্য দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগে মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতের রায়ের পরে ইয়াহিয়া ডেথ ওয়ারেন্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। দুষ্টু ও শয়তান প্রকৃতির ইয়াহিয়া এবং ক‚টচালে অভিজ্ঞ ভুট্টো আসলে বাস্তবতাবর্জিত ছিলেন। তারপরও বিশ্ব জনমতের চাপে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ছিল অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার জন্য উৎসারিত। বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য নির্জন ও একাকিত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য তাঁর যাত্রাপথেও স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য ব্যাকুলতা ঝরে পড়েছে। এ সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছে মুক্ত মুজিবের চেয়ে বন্দী মুজিব সেদিন বাঙালির কাছে সকল আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিফলন ছিল। বাঙালিরা বহু শতাব্দী ধরে যে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি তা এবার অবলীলায় অর্জিত হলো। তিনি বিজয়কে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করতে বলেছেন। দুষ্টু, শয়তান এবং চক্রান্তকারীদের সকল চক্রান্তের বেড়াজাল এ সময় তিনি ছিন্নভিন্ন করে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ভারতের পালাম বিমানবন্দরে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে পৌঁছলেন। বিমান থেকে নামার সময় আবেগ মাখানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ‘জয় বাংলা’। সে সময় বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান তৎকালীন ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরি, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্যরা। শেখ মুজিব বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় ভারত এবং ভারতবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করতে আপনারা সকলেই নিরলস পরিশ্রম এবং প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সেই মুহূর্তেও তিনি তাঁর দেশবাসীকে স্মরণ করেছিলেন। তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে, যখন আমাকে আমার দেশের মানুষদের কাছ থেকে ধরে নেয়া হলো তখন তারা আমার জন্য অশ্রæপাত করেছিল। যখন আমাকে বন্দী করা হলো তখন তারা লড়াই করেছিল এবং এখন তারা বিজয়ী হয়েছে তখন আমি মুক্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছি। এক মহামানবের সাধারণ মানুষের জন্য ত্যাগ, পরিশ্রম ও ক্লান্তিহীন পথে বিজয়ের আলোকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গৌরবগাথা। বঙ্গবন্ধু সেদিন কলকাতা হয়ে না ফিরে বরং বহুল প্রতীক্ষিত তাঁর স্বদেশে সরাসরি ফিরতে মনস্থ করেন। তাঁর এ ইচ্ছা ছিল দেশবাসীর সঙ্গে তাঁর চিন্তা-চেতনার দ্রুত মেলবন্ধন সুদৃঢ় করা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন কলকাতাবাসীকে সময় নিয়ে এ অঞ্চলের কোটি অধিবাসীকে যুদ্ধকালীন সময় আশ্রয় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী শেষের দিকে যুক্ত হয়। ওইদিন ভারতে স্বল্পকালীন অবস্থান করার সময় মুজিব সাহেবের অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় তৎকালীন সেনাপ্রধান ম্যানেকশকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সে মুহূর্তে সমগ্র জাতি আনন্দ-উচ্ছাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। এই বক্তৃতাটিতে দেশপ্রেম, দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভাঙ্গাচোরা রাষ্ট্রের সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষত কিভাবে সারাবেন, দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে যেন অন্ন-বস্ত্র, ওষুধ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আবেদনও ছিল। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি সেদিন তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্য জনগণের মনে আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসায় সমৃদ্ধ হয়েছিল। এজন্যই বেবী মওদুদ লিখেছেন যে, ‘পাকিস্তানিকারাগারের মৃত্যুদণ্ড থেকে তিনি বিজয়ী বীর হিসেবে মহামানবে অভিনন্দিত হয়ে ফিরে এলেন তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে, যার পবিত্র মাটিকে তিনি একদিন শত্রæমুক্ত করার আহবান দেন, সেই মাটির ছায়ায় তিনি নিশ্চিত শান্তিময় আশ্রয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতন্ত্রমনা। আর তাই গণতন্ত্রকে তিনি বিকশিত করতে চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিপুষ্ট করে। বিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে নানা ফ্রন্টে গড়তে চেয়েছিলেন নানামুখী ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ সমুজ্জ্বল। মাত্র সাড়ে তিন বছর শাসনকালে তিনি রাষ্ট্রের বিকাশ করতে চেয়েছে বহুমাত্রিকতায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

তোমারই আজ জয়

প্রকাশিত : ০৩:৪৩:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ জানুয়ারী ২০২১

‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্তভাবনাহীন, তুমি ফিরে এলে অপূর্ণতা ঘুচে, বাংলাদেশ হলো পূর্ণ স্বাধীন।’ ‘মৃত্যুর দুয়ার ভেঙ্গে অমরত্ব লভিয়াছ/ তুমি জ্যোতির্ময়/ পূর্ণ কর স্বাধীনতা মুক্ত কর ভয়/ তোমারই আজ জয়।’

আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক অনন্য দিন। স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ’৭২ সালের এ দিনেই পাকিস্তানে দীর্ঘ কারাবাস শেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন বাঙালির অবিসংবাদিত এ নেতা। জাতির জনক স্বয়ং তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা।’ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে আজ জাতি পালন করছে ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।

নয় মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালি বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। জীবন মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনেই পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

অদম্য সাহসী এবং বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি কারাগারে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হলেও অকুতোভয় ও লড়াকু মনোবৃত্তির বঙ্গবন্ধুকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। এমনকি পাকিস্তানের কারাগারে রাখার সময় প্রহসনমূলক মামলা দিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। খোঁড়া হয়েছিল কবর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র গতিতে বেগবান হয়েছিল। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। বাঙালিকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী এদেশে গণহত্যা শুরু করলে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করতে চেষ্টা করলেও কখনও পারেনি দাবিয়ে রাখতে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কান্ডারি পাকিস্তানি কারাগারে থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল প্রেরণাদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। যখন ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হয় তখনও বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। এ প্রসঙ্গে বেবী মওদুদ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুজিব সাহেবের স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে যখন দেশের রাষ্ট্র্রপতির স্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে নিরাপত্তা, পিওন-আর্দালি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হলেও তিনি তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের রাষ্ট্রপতি এখনও মুক্ত হননি। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমি এসব নিয়ে কি করব?’ একজন খাঁটি হৃদয়ের দেশপ্রেমিক বাঙালি রমণী, যিনি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে তাঁর মতোই দেশকে ভালবেসেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঠিক সারথি ছিলেন- দেশমাতৃকার মুক্তি সাধনে অকৃত্রিম ও নানামুখী উৎসের সহায়তা করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার অনস্বীকার্য ও অনুকরণীয় অবদান ছিল। এই মহীয়সী নারীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাবোধ। পরাস্ত পাকিস্তানিশাসকরা বুঝতে পেরেছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমানের যে অকৃত্রিম দেশপ্রেম এবং সে দেশপ্রেমের ফল্গুধারায় বাঙালি তাঁকে অবিসংবাদিত নেতার আসনে বসিয়েছে এবং তাঁকে ঘিরেই স্বাধীনতা সংগ্রাম করে তাঁর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে, তখন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিকারাগারে রেখে দিলে দেশ-বিদেশের নানামুখী চাপে তারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। বাধ্য হয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দেয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর একটা একচল্লিশ মিনিটে এদেশের মাটিতে তিনি ফিরে আসেন। এর আগে তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যান এবং পরে সেখান থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফেরত আসেন।

পাকিস্তানিবাহিনী কর্তৃক ধৃত হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে সর্বদা উচ্চারিত হতো ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ আজও সাধারণ বাঙালিকে গভীরভাবে আলোড়িত করে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ১৯২২-এর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতা থেকে উৎসারিত হয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। কবিতায় কবি লিখেছিলেন যে, ‘জয় বাংলা’র পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ/ জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি/ জয় প্রাণ অন্তহীন।’-কবির চিত্রকল্পের বাস্তবতার বিমূর্ত হয়েছেন জাতির জনক। দেশবাসীকে পাকিস্তানিশোষক-শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করতে তিনি সুগভীর প্রয়াস পরিকল্পনা এবং সফল বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেন। মানুষকে উদ্দীপ্ত করেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে, স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার প্রয়াস গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা এই অঞ্চলজুড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষকে আলোড়িত করে। পরবর্তী নয় মাস, বঙ্গবন্ধুর অটল বিশ্বাস, সাহস ও দেশপ্রেম ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। পাকিস্তানি কারাগারে থাকায় তিনি এ যুদ্ধে, মধ্যে শামিল ছিলেন পরোক্ষভাবে। পাশাপাশি যারা সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন তাদের কাছে তাঁর নির্দেশ ছিল সর্বাত্মক প্রতিরোধ করা। কিছু রাজাকার-আলবদর-আলশামস মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কারাগার থেকে বাংলার বন্ধু মুজিব হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত উৎসাহের বিমূর্ত প্রতিমূর্তি। মুক্তিবাহিনী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। মৃত্যু, নির্যাতন, শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা কোনটাই মুক্তিবাহিনীকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে বার্তা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় যে, অকুতোভয় মুজিব বলেছিলেন, এটিই আমার শেষ বার্তা হতে পারে। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশবাসীর প্রতি আহবান জানাই, আপনি যেখানেই থাকুন এবং যা কিছু আপনার সঙ্গে থাকুক না কেন- শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। তিনি আরও আহবান জানান যে, যতক্ষণ না পাকিস্তানিদখলদার সেনাদের শেষ সৈনিক পর্যন্ত বাংলার মাটি থেকে বহিষ্কার করা যাবে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনারা লড়াই অবশ্যই অব্যাহত রাখবেন।
বস্তুত ৭ মার্চ, ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই বাঙালি প্রস্তুত হচ্ছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানিবাহিনী যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু করে তার যোগ্য জবাব বাঙালিরা দিতে পিছপা হয়নি। দি নিউইউর্য়ক টাইমসের ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২-এর সংখ্যায় এ্যান্থনি লুইস ‘শেখ মুজিব, মুক্ত, ব্রিটেন পৌঁছেছেন’ শিরোনামের প্রামাণিক দলিলে লিখেছেন, শেখ মুজিব লন্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, একটি স্বাধীন বাঙালি জাতি এখন চরম বাস্তবতা এবং বিশ্বের সমস্ত দেশকে তার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি জানাতে এবং সহায়তা দেয়ার জন্য তিনি আবেদন করেছেন, যাতে করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা না যান। পূর্ব বাংলার অবিসংবাদি নেতা হিসেবে উল্লেখ করে সাংবাদিক লিখেছেন যে, বাংলাদেশের মনোনীত রাষ্ট্রপতির কাছে স্বপ্ন পূরণে দেশ স্বাধীন হওয়ার অভিব্যক্তিতে অত্যন্ত আবেগঘন পরিবেশ বিরাজ করছিল। বাংলাদেশের বিজয়ের পর পাকিস্তানিশাসক মহলেও পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৯ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খান আরেক চালবাজ জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এ সময় তিনি সিল মেরে সমন্বিত খাম ভুট্টোকে দেন। এতে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া লিখেছিলেন যে, আমি মুজিবকে ফাঁসিতে না ঝুঁলিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। কি দুঃসাহস পাকিস্তানিস্বৈরাচারী শাসকের বাংলার নয়নের মণিকে তিনি ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলেন। ওই খামের কাগজে মুজিব সাহেবকে ফাঁসি দেয়ার আদেশ ছিল, কেবল তারিখ ছিল না এবং এটি ভুট্টোকে ঠিক করার জন্য দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগে মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতের রায়ের পরে ইয়াহিয়া ডেথ ওয়ারেন্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। দুষ্টু ও শয়তান প্রকৃতির ইয়াহিয়া এবং ক‚টচালে অভিজ্ঞ ভুট্টো আসলে বাস্তবতাবর্জিত ছিলেন। তারপরও বিশ্ব জনমতের চাপে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ছিল অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার জন্য উৎসারিত। বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য নির্জন ও একাকিত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য তাঁর যাত্রাপথেও স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য ব্যাকুলতা ঝরে পড়েছে। এ সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছে মুক্ত মুজিবের চেয়ে বন্দী মুজিব সেদিন বাঙালির কাছে সকল আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিফলন ছিল। বাঙালিরা বহু শতাব্দী ধরে যে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি তা এবার অবলীলায় অর্জিত হলো। তিনি বিজয়কে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করতে বলেছেন। দুষ্টু, শয়তান এবং চক্রান্তকারীদের সকল চক্রান্তের বেড়াজাল এ সময় তিনি ছিন্নভিন্ন করে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ভারতের পালাম বিমানবন্দরে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে পৌঁছলেন। বিমান থেকে নামার সময় আবেগ মাখানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ‘জয় বাংলা’। সে সময় বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান তৎকালীন ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরি, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্যরা। শেখ মুজিব বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় ভারত এবং ভারতবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করতে আপনারা সকলেই নিরলস পরিশ্রম এবং প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সেই মুহূর্তেও তিনি তাঁর দেশবাসীকে স্মরণ করেছিলেন। তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে, যখন আমাকে আমার দেশের মানুষদের কাছ থেকে ধরে নেয়া হলো তখন তারা আমার জন্য অশ্রæপাত করেছিল। যখন আমাকে বন্দী করা হলো তখন তারা লড়াই করেছিল এবং এখন তারা বিজয়ী হয়েছে তখন আমি মুক্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছি। এক মহামানবের সাধারণ মানুষের জন্য ত্যাগ, পরিশ্রম ও ক্লান্তিহীন পথে বিজয়ের আলোকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গৌরবগাথা। বঙ্গবন্ধু সেদিন কলকাতা হয়ে না ফিরে বরং বহুল প্রতীক্ষিত তাঁর স্বদেশে সরাসরি ফিরতে মনস্থ করেন। তাঁর এ ইচ্ছা ছিল দেশবাসীর সঙ্গে তাঁর চিন্তা-চেতনার দ্রুত মেলবন্ধন সুদৃঢ় করা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন কলকাতাবাসীকে সময় নিয়ে এ অঞ্চলের কোটি অধিবাসীকে যুদ্ধকালীন সময় আশ্রয় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী শেষের দিকে যুক্ত হয়। ওইদিন ভারতে স্বল্পকালীন অবস্থান করার সময় মুজিব সাহেবের অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় তৎকালীন সেনাপ্রধান ম্যানেকশকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সে মুহূর্তে সমগ্র জাতি আনন্দ-উচ্ছাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। এই বক্তৃতাটিতে দেশপ্রেম, দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভাঙ্গাচোরা রাষ্ট্রের সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষত কিভাবে সারাবেন, দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে যেন অন্ন-বস্ত্র, ওষুধ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আবেদনও ছিল। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি সেদিন তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্য জনগণের মনে আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসায় সমৃদ্ধ হয়েছিল। এজন্যই বেবী মওদুদ লিখেছেন যে, ‘পাকিস্তানিকারাগারের মৃত্যুদণ্ড থেকে তিনি বিজয়ী বীর হিসেবে মহামানবে অভিনন্দিত হয়ে ফিরে এলেন তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে, যার পবিত্র মাটিকে তিনি একদিন শত্রæমুক্ত করার আহবান দেন, সেই মাটির ছায়ায় তিনি নিশ্চিত শান্তিময় আশ্রয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতন্ত্রমনা। আর তাই গণতন্ত্রকে তিনি বিকশিত করতে চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিপুষ্ট করে। বিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে নানা ফ্রন্টে গড়তে চেয়েছিলেন নানামুখী ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ সমুজ্জ্বল। মাত্র সাড়ে তিন বছর শাসনকালে তিনি রাষ্ট্রের বিকাশ করতে চেয়েছে বহুমাত্রিকতায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর