করোনা ভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসায় প্রায় এক মাস আগে সরকারের দেওয়া দুটি আইসিইউ বেড দক্ষলোকের অভাবে চালু সম্ভব হয়নি নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে। অন্যদিকে অনুমোদনের পরও আরটি পিসিরা ল্যাব স্থাপন হয়নি। ফলে করোনায় উচ্চ সংক্রমণের জেলা নওগাঁয় দ্রুত করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল না পাওয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। এনিয়ে নওগাঁবাসিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে । করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নওগাঁয় দ্রুত পিসিআর ল্যাব স্থাপনের তাগিদ সচেতন নাগরিকদের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে ৯ মে নওগাঁ সদর হাসপাতালে আরটি পিসিআর ল্যাব ও দুটি আইসিইউ বেড স্থাপনের অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে, একমাস পরও নওগাঁয় আরটি পিসিআর ল্যাবের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পৌঁছায়নি । দুটি আইসিইউ বেড হাসপাতালে পৌছালেও দক্ষলোকের অভাবে বসানো সম্ভব হয়নি।
নওগাঁ সদর হসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো : আবু আনসার আলী জানান, আরটি পিসিআর ল্যাব ও দুটি আইসিইউ বেড স্থাপনের অনুমোদন হলেও নানা সমস্যার থাকায় তা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। আর কবে নাগাদ স্থাপন করা হবে এ বিষয়েও সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছেন না তিনি।
জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের সবেচেয়ে বড় জেলা নওগাঁ। এ জেলায় প্রায় ৩০ লাখ লোক বসবাস করেন। গত বছর জেলায় প্রথম ২৩ এপ্রিল করোনা ভাইরাসে রাণীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন স্বাস্থ্যকর্মী শনাক্ত হন। আর ৩০ মে নওগাঁ শহরের সুলতানপুর গ্রামের শাজাহান নামে এক ব্যক্তি মারা যান। এরপর করোনার শনাক্ত ও মৃত্যুর হার নওগাঁয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। কিন্তু নওগাঁ জেলার পার্শবার্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলাতেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরে। ফলে গত মাসের ঈদের পর থেকে হঠাৎ করে নওগাঁয় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জেলায় করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে মে মাসের আগ পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল গড়ে ৮ ভাগ । ঈদের আগে মে মাসে যেখানে শনাক্তের হার ছিল গড়ে ১৮ ভাগ। ঈদের পরে মে মাসে সেটি বৃদ্ধি পায় ২৫ ভাগে। গত বছর থেকে জুন পযর্ন্ত জেলায় করোনায় মারা গেছেন ৪৩ জন। শনাক্ত ২ হাজার ৩০১ জন আর সুস্থ্য হয়েছেন ২ হাজার ৫ জন।
জুন মাসে ৩১ দিনে নওগাঁয় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের আর শনাক্ত হয়েছে ২শ’ জনের মতো । জুন পযর্ন্ত জেলায় সুস্থ্যর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩০১ জন।
তবে চলতি মাসে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, গত ১৪ জুন পযর্ন্ত শনাক্ত ও মৃত্যুর হার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে । নওগাঁয় এই ১৪ দিন মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের আর শনাক্ত হয়েছে ৭৩৫ জন । গত মাসগুলোর চেয়ে চলতি মাসে মৃত্যু ও শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেলেও অপরদিকে সুস্থ্য হয়েছে মাত্র ২শ’ জন। জেলায় মোট মারা গেছেন ৫৪ জন আর শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৬ জন। মোট সুস্থ্য হয়েছে ২ হাজার ২০৭ জন।
নওগাঁর ডেপুটি সিভিল সার্জন মনজুর এ মোর্শেদ জানান, গত মাসে জেলায় সবচেয়ে মৃত্যু ও শনাক্ত হয়েছি। ফলে চলতি মাসের শুরুতে করোনায় উচ্চ সংক্রমণ এলাকা নওগাঁ পৌর সভা ও নিয়ামতপুরে ৭ দিনের বিশেষ লকডাউন দেওয়া হয়। তবে এরপরও এই ১৪ দিনে মৃত্যু ও শনাক্তের হারের বিষয়টি উদ্বিগ্নজনক। এইজন্যে সবাইকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার অনুরোধ করেন।
নওগাঁ সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁয় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে করোনা আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যা। গেল ২৪ ঘন্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে জেলায় আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনাক্ত হয়েছে ৭২ জন। যা নতুন শনাক্তের হার ২৬.৬২ ।
গত ২৪ ঘন্টায় মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে একজনের বাড়ি রাণীনগর উপজেলা অপরজনের বাড়ি নিয়ামতপুর উপজেলায়। জেলায় গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে কোয়ারেনটাইনে নেওয়া হয়েছে ১৭৪ জনকে এবং এ পর্যন্ত জেলায় সর্বমোট কোয়ারেনটাইনে আছে ২৪ হাজার ৩০১ জন। ২৪ ঘন্টায় কোয়ারেনটাইন থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে ৭৪ জনকে।
নওগাঁ সদর হাসপাতালে করোনা নমুনা সংগ্রহ বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হওয়ার সরকারি নির্দেশণা রয়েছে। সেই নিয়ম উপেক্ষা করে নমুনা সংগ্রহকারীরা বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাথে সাখ্যাত শেষে দুপূর সাড়ে ১২ টার দিকে নমুনা সংগ্রহ শুরু করা হয়। ফলে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন নমুনা দিতে আসা ব্যক্তিরা । করোনার নমুনা দিতে আসা ব্যক্তিদের হয়রানিসহ নানান অভিযোগের বিষয়টি সম্প্রতি কিছু দিন আগে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে । দ্রুত এই হয়রানি বন্ধের দাবি করে করোনার নমুনা দিতে আসা ব্যক্তি ও সচেতন মহল ।
এদিকে এ হাসপাতালের আসা আইসিইউ বেড দুটি নওগাঁয় ৩০ লাখ মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তীব্র শ্বাসকষ্টের রোগীদের আইসিইউ-তে রেখে চিকিৎসা দিতে নওগাঁ সদর হাসপাতাল থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা ৪৫ কিলোমিটার দূরের বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়ে থাকে। কত রোগীকে এ পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে হিসাব দিতে না পারলেও সিভিল সার্জন হানিফ জানান, গত রবিবার জেনারেল হাসপাতাল থেকে রাজশাহীতে একজন রোগী পাঠানো হয়েছে। এছাড়া জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও সরাসরি রোগীদের এসব হাসপাতালে পাঠানো হয়ে থাকে।
সিভিল সার্জনের অফিস থেকে সোমবার পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, এ হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ ৩০টি সাধারণ বেডের বিপরীতে ৫৭ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নওগাঁর সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন রেজা জানান, প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য একটি করে হলেও ৩০ লাখ মানুষের এ জেলায় কমপক্ষে ৩০টি আইসিইউ বেড প্রয়োজন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের উচ্চঝুঁকির জেলা নওগাঁয় দুটি আইসিইউ বেড বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য । তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্যখাতে লুটপাটের কারণে রোগীর পরিবর্তে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। দ্রুত স্বাস্থ্যখাতে দূর্নীতি বন্ধ করে আধুনিক চিকিৎসাসেবা গড়ে তুলতে দাবি জানান।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের নওগাঁর সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন মুকুল জানান, অনুমোদনের এক মাসেও করোনায় উচ্চ সংক্রমণের জেলা নওগাঁয় আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন হয়নি । স্বাস্থ্যখাতে লুটপাটে মগ্ন থাকয় নওগাঁয় বরাদ্দ দুটি আইসিইউ বেড দক্ষলোকের অভাবে চালু করতে পারেনি । ফলে দ্রুত করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল না পাওয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। পাশাপাশি নওগাঁয় সহজেই এই সেবা নিতে পারছেন জেলা বাসি। এনিয়ে নওগাঁবাসিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক ডা: রেজাউল মাহমুদ জানান, আরটি পিসিআর ল্যাব ও অত্যন্ত ২০/২৫ টি আইসিইউ বেড দ্রুত প্রয়োজন। এই দাবি কেন্দ্রী নেতৃবৃন্দদের জানানো হয়েছে। অপর প্রশ্নে আরো জানান, সরকারি চিকিৎসকরা কোন দূর্ণীতি বা লুটপাট করেন না। যা মধ্যস্বত্তভোগী ও স্বাস্থ্য বিভাগে জড়িত নয় এমন দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিরা এই দূর্ণীতি বা লুটপাট করেন। এ ছাড়াও করোনা মোকাবেলায় কিছুটা দীর্ঘ পরিকল্পনা অভাবে দক্ষলোকবল গড়ে তুলতে না পারায় আজ আইসিইউ বেড চালু সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি অত্যন্ত আন্তরিক।
নওগাঁ সদর হসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এবং সিভিল সার্জন ডা. এবিএম আবু হানিফ জানান, করোনার নমুনা দিতে আসা ব্যক্তিদের হয়রানিসহ নানান অভিযোগের বিষয়টি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তারপরও কেউ যদি হয়রানি হয়ে থাকে তবে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরো জানান, আরটি পিসিআর মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আসা মাত্র তা চালু করা হবে। প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে দুটি আইসিইউ বেড বসিয়ে এখনও চালু করা যায়নি। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ঠিকাদারের মাধ্যমে এসব আইসিইউ বেড হাসপাতালে বসানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই চালু হবে।
বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ




















