মুরাদনগরে একশ পনের বছর আগের মানুষ দুধনেহের। ১৪নং নবীপুর পূর্ব ইউনিয়ন পদুয়া গ্রামের ছোট একটি ভাঙ্গা কুটিরে তার বসবাস। এক শতক ভিটেতে দুটি ঘর একটিতে রান্না হয় অন্যটি থাকার। ঘরগুলো জরাজীর্ণ হওয়ায় বৃষ্টি আসলে উপর থেকে সোজা পানি পড়ে। ঘরের ভীতর আসবাপত্র বলতে কিছুই নাই। আধা বেড়ায় পাটিশন করা। একপাশে থাকে ছেলে ও তার প্রতিবন্ধী বউ। অন্যপাশে মাটির উপর সারি সারি কাঠের বিছানায় দুধনেহের। বিছানার পাশে পানি খাওয়ার ঘটি আর বাথরুমের জন্য প্লাস্টিকের ভাঙা কমড।
যেখানে ঘুম সেখানেই নাওয়া-খাওয়া। বয়সের ভাড়ে দুধনেহেরের চামড়ায় সাগড়ের ঢেউয়ের মত ভাঁজ পড়েছে। দাঁত একটিও নাই। ছোট শিশুর মত মুখের মাড়ি খুব পরিষ্কার। ভাতের প্লেট সামনে দিয়ে গেলে না খেয়েই বিছানার ভীতর লুকিয়ে রাখেন। দাঁতবিহীন মুখে এমন শক্ত খাবার কি আর খাওয়া যায় ? । যা খেতে পারেন তা ছেলের আর্থিক দূর অবস্থার কারণে জুটে না। তাই পেটের ক্ষুধা পিঠে বেঁধে দিন-রাত কুঁেজা হয়ে শুয়ে থাকেন। খেয়ে না খেয়ে থাকার কষ্টের জীবন তার শত বছরের ইতিহাস। এযেন ‘বিধিবাম’ কপালে সুখ না থাকলে কি আর সুখের সন্ধান পাওয়া যায় ? গত হওয়া একশতাব্দীর পৃথিবী আজ সভ্যতার চরম শিখরে। কত মানুষ এই সময়ে বিলিনিয়ার-মিলিনিয়ার হয়েছেন। কত আধার ঢাকা পথে আলোর বিকাশ ঘটেছে। শুধুু দুধনেহেরের জীবন সংসারে রবির দেখা মিলেনি। কবির ভাষায় সুখ ,সুখ করে তুমি কেন করো হাহুতাশ , সুখত পাবেনা কোথায়ও বৃথা সুখের আশ।
সূত্র মতে- দুধনেহেরের বিবাহ হয়েছিল ১৯৩৫ সালে মুরাদনগর উপজেলার পদুয়া গ্রামের তুরাব আলীর সাথে। সংসার জীবন তাদের রয়েছে এক ছেলে দুই মেয়ে। তুরাব আলী পেশায়-ঘর ছাউনির কাজ করতেন। তাই তাকে “ ছাওয়ারবান বলে ডাকতেন”। তিনি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামী মৃত্যুর পর দুধনেহের অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলেমেয়ের মুখে আহার তুলে দিতেন। এখন নীজেই বিছানায় শুয়ে আহারের অপেক্ষায় থাকেন। ছেলে হালিম মিয়া (৬০)। আগে রিকশা চালাতেন। বয়সের কারনে এখন আর তেমন কোন কাজকর্ম করতে পারেন না। তাই এলকায় তিন চাকার ভ্যানে ফেরি করে কাঁচা কলার ভর্তা বিক্রি করেন।
হালিম মিয়া বলেন- আমি যখন ৮বছরের শিশু তখন বাবা মারা যায়। আমার বড় এক বোন। আমিই একমাত্র ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর আমার “মা” মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করে আমাদের লালন পালন করে বড় করছে। ‘মা’-ই আমার জীবনের সব। অনেক আগে একবার মায়ের টিপি রোগ হইছিল তখন আমি কটকটি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসার করিয়েছি। মা ভালো হয়েছে। চিটাগাং ছিলাম ৩৫ বছর। বাড়ি আসছি ১৫ বছর। বাড়িতে একশতক ভিটের জায়গা ছাড়া কিছুই নাই। আমার একটা টিউবওয়েল নাই , বাথরুম নাই। মায়ের প্র¯্রাব-পায়খা পরিষ্কার করে অন্যের জায়গায় ফালাই। সরকার কত মানুষকে ঘর দেয়, আমাকে যদি একটা ঘর দিত তাহলে আমি মায়েরে নিয়া ওই ঘরে থাকতাম। মায়ের সেবা করতে আমার খারাপ লাগেনা। খারাপ লাগে তখন- যখন মায়ের খাবারগুলো দিতে পারিনা। মা- ফলের জুসসহ নরম খাবার দিলে খুশি মনে খেতে চায়। নীজেরাই একবার খেলে আরেকবার না খেয়ে থাকি। কখনো কখনো চুলায় আগুন জ্বলেনা। মায়ের এই নরম খাবার প্রতিদিন কোথা থেকে দিব। অন্য বস্ত্র, বাসস্থান কিছু নাই, তবু মাকে আলাদা করতে চান না হালিম মিয়া। সাধ্যের মধ্যে মায়ের সেবা করেন। তিনি চান তার “মা” বেঁচে থাকুক আরো শতবছর।