রাজধানীর জনসংখ্যা শহর ও শহরতলির মোট জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা মহানগর এলাকা, যা একটি মেগাসিটি হিসেবে পরিচিত। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর মোট জনসংখ্যা ৪ কোটি ৩২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬.৮ ভাগ রাজধানীতে বসবাস করে।
রাজধানীর জনবহুল এলাকা খিলগাঁও বাসাবো এলাকা ।অবকাঠামো ও অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর খিলগাঁও (তালতলা) সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গায় নতুন করে ২১৯ দোকান নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মার্কেটের মালিক ডিএনসিসির কাছ থেকে জায়গা ইজারা নিয়ে বণিক সমিতি দোকানগুলো তৈরি করছে। মার্কেটের দোকান মালিকদের জানান, খিলগাঁও (তালতলা) সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেটের দুই তলাবিশিষ্ট চারটি মার্কেটে ৮৫৬টি দোকান রয়েছে। ‘গরিবের মার্কেট’ খ্যাত তালতলা মার্কেটে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা। যেটুকু খালি জায়গা রয়েছে, তা পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে খালি জায়গাগুলোয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবৈধ দোকান করে বণিক সমিতির নেতারা ভাড়া বাণিজ্য করেছেন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর অবৈধ দোকানগুলো সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ করে। এরপর মার্কেটের পরিবেশ অনেকাংশে সুন্দর হয়েছে। এখন নতুন করে আবার নবগঠিত বণিক সমিতির নেতারা বাণিজ্যে নেমেছেন।
দোকান মালিকদের অভিযোগ, বণিক সমিতি মার্কেটের ৫ হাজার ২৫৭ বর্গফুট জায়গার ইজারা এনেছে। তারা ‘অস্থায়ী বরাদ্দ’ নামে বরাদ্দ নিয়ে লোহার পাত দিয়ে মজবুত দোকান তৈরির কাজ শুরু করেছে। তারা যে জায়গা বরাদ্দ এনেছে, এর চেয়ে বেশি আয়তন দখলের প্রক্রিয়া চলছে। নতুন করে তারা ২১৯ জনকে দোকান দেবে। প্রতিটি দোকান তৈরি করা হচ্ছে ৬০ ফুট আয়তনের।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের কয়েকজনের সমন্বয়ে একটি অসাধু চক্র সংস্থার বিভিন্ন জায়গা বরাদ্দ দিয়ে বাণিজ্য করছে। সরকারি দপ্তর বা সংস্থার এই ধরনের বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার বিধান রয়েছে। মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গা ডিএনসিসির চক্রটি গোপনে দোকান তৈরির জায়গা হিসাবে ইজারা চূড়ান্ত করেছে। ডিএনসিসির অসাধু চক্রের সঙ্গে বহিরাগত একটি গ্রুপ বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি প্রকৌশল টিম খিলগাঁও (তালতলা) মার্কেট পরিদর্শন করে। সেসময় বুয়েট প্রকৌশলীদের প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কেটের কাঠামোতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের চিহ্ন নেই। ফলে মার্কেটের ছাদ, দেওয়াল এবং বিভিন্ন জায়গা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে দ্রুত সংস্কার জরুরি। বুয়েটের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে মার্কেট সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও পরে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
আরও জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খিলগাঁও (তালতলা) মার্কেটে কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালের ২৬ মার্চ ওই মার্কেটে আগুনের ঘটনায় বেশকিছু দোকান পুড়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মার্কেটটিকে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে আসছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ। তুবও মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি করতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন। মার্কেটে ফায়ার হাইড্রেন বসানোর জন্য বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
মার্কেটের অবকাঠামো ও অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত করতে উদ্যোগ না নিয়ে সিটি করপোরেশন উলটো মার্কেটের পার্কিং ও উন্মুক্ত জায়গার ইজারা তুলে দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে। সিটি করপোরেশনের ইজারা আদেশ নিয়ে তারা ধাপে ধাপে পুরো মার্কেটের খালি জায়গা দখল করবে। বণিক সমিতি যাদের দোকান দেবে, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করবে। সেখান থেকে কিছু খরচ করবে ডিএনসিসির অসাধু চক্রের পেছনে। এভাবে ওই মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গা এবং উন্মুক্ত জায়গা গ্রাস করা হবে।
খোদ ডিএনসিসির এক কর্মকর্তাও মনে করেন, বরাদ্দ প্রক্রিয়াটি সঠিক হয়নি। বণিক সমিতির নামে পার্কিংয়ের এবং উন্মুক্ত জায়গা ইজারা দেওয়া সঠিক হয়নি। যদি হকার বা দুস্থদের কোনো সমিতি হতো, তাহলে ভিন্নকথা। বলা যেত, মানবিক বিবেচনায় তাদের কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দিয়েছে। বণিক সমিতির নামে এই ইজারা কার্যত সমিতির নেতাদের বাণিজ্য করার একটি সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হচ্ছে, সংস্থার মার্কেট বা অন্য স্থাপনাগুলোয় নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। সেখানে মার্কেটের খালি জায়গা বা পার্কিংয়ের জায়গায় ভাসমান দোকানের নামে শত শত দোকান বরাদ্দ দেওয়া অযৌক্তিক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দীন হাসান আজকের বিজনেস বাংলাদেশ’কে বলেন, মার্কেটকে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আয়ের উৎস মনে করলে চলবে না। এটি সামাজিক কর্মকাণ্ড, বিনোদন এবং মানুষের মিলনমেলারও বড় জায়গা। সবকিছু ভুলে গিয়ে সিটি করপোরেশন যদি আয় বাড়াতে পার্কিং বা খোলা জায়গা বরাদ্দ দিয়ে দেয়, সেটা অপ্রত্যাশিত।
তিনি জানান, ওই এলাকায় ওই মার্কেট ছাড়া তেমন কোনো পাবলিক স্পেস নেই। অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের সময় এসব জায়গা বড় সহায়ক হয় এলাকাবাসী বা মার্কেটের দোকানদারদের জন্য। সিটি করপোরেশনকে সেসব দিকও বিবেচনা করতে হবে। মার্কেটের পার্কিং বা খোলা জায়গা ছোট হয়ে গেলে যানবাহনগুলো সড়কে যানজটের সৃষ্টি করবে।
এ বিষয়ে খিলগাঁও (তালতলা) সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেট, বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম বড় মিয়া আজকের বিজনেস বাংলাদেশ’কে বলেন, এই মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ নয়। বুয়েটের প্রতিবেদন সঠিক নয়। ১৯৮৬ সালে মার্কেটের উদ্বোধন হয়েছে। এসব দোকান তাদের ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। ৩৯ বছরের মাথায় মার্কেট ভাঙতে হবে কেন? তিনি আরও বলেন, মার্কেটের পেছনের অংশেও পার্কিংয়ের জন্য কিছু জায়গা রয়েছে। সামনের জায়গা বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের লোকেরা অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে বাণিজ্য করেছে। আর এখন সিটি করপোরেশনকে ভাড়া দিয়ে ইজারা নিয়ে দোকান করা অপরাধ হবে কেন?
এ বিষয়ে ডিএনসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমান আজকের বিজনেস বাংলাদেশ’কে বলেন, খিলগাঁও (তালতলা) মার্কেট বণিক সমিতির লোকেরা প্রশাসকের দপ্তরে এসেছিলেন। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে খিলগাঁও মার্কেটের খালি জায়গায় অস্থায়ী দোকান তৈরির ইজারা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এই বরাদ্দ প্রক্রিয়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমেও করা যেত। যেহেতু ওই মার্কেট বণিক সমিতি চেয়েছে, এজন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। যদি বণিক সমিতি শর্ত লঙ্ঘন করে, তাহলে ইজারা বাতিল করা হবে।
ডিএস,.

























