র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে এ পর্যন্ত ২৬০০ জনের অধিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করেছে। তার মধ্যে প্রায় ১৪০০ জন নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি সদস্য। র্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয় জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়ালসহ বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতা ২০০৭ সালে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
জেএমবি এর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হলে নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে পড়ে জেএমবি। পরবর্তীতে সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বে জেএমবি সুসংহত হয় এবং গড়ে তোলে জেএমবি “সারোয়ার-তামিম গ্রুপ।২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জেএমবি’র আমীর সারোয়ার জাহান এবং অপর শীর্ষ জঙ্গি নেতা তামীম চৌধুরী। উক্ত সময়কালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাশকতার ছক তৈরী করেছিল তারা। অতঃপর ২০১৬ সালের ০৮ অক্টোবর র্যাবের অভিযানে পালাতে গিয়ে বিল্ডিং থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তৎকালীন জেএমবি এর আমীর সারোয়ার জাহান। হলি আর্টিজান ঘটনার পর হতে অদ্যাবধি প্রায় ১৫০০ জন বিভিন্ন সংগঠনের জঙ্গি তন্মধ্যে ৮ শতাধিক জেএমবি সদস্যদের গ্রেফতার করে র্যাব ফলে জেএমবি’র সাংগঠনিক সক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পায়।
বর্তমানে জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে একটি পরাজিত শক্তি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর্যূপরি জঙ্গি বিরোধী অভিযান ও কর্মতৎপরতার ফলে জঙ্গিদের তৎপরতা প্রায় শুন্যের কোটায়। তথাপিত্ত র্যাব আত্মতুষ্টিতে ভুগছে না। আমরা আগোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহতগোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়, সংগঠনকে চাঙ্গা করতে জঙ্গিরা পুনরায় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পুনরায় সংগঠিত হতে এবং পরবর্তীতে নাশকতা কার্যক্রম চালাতে তাদের অর্থেরও প্রয়োজন রয়েছে। প্রত্যেক জঙ্গি সদস্যদের বাধ্যতামূলক ইয়ানত প্রদান জঙ্গিদের অর্থের একটি মূল উৎস। তবে জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে লুট, ছিনতাই ও ডাকাতি ইত্যাদির মাধ্যমেও অর্থ জোগাড় করেছে।র্যাব অতি সম্প্রতি ময়মনসিংহে এ ধরণের একটি অপচেষ্টা রুখে দেয়। ময়মনসিংহের গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রাজশাহীতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা যায়, গ্রুপের গ্রুপে বিচ্ছিন্ন পুরাতন জেএমবি সদস্যরা সংগঠন চাঙ্গা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এ রকম একটি গ্রুপে সম্পর্কে জানতে পারে র্যাব ।ফলশ্রুতিতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত মধ্যরাত হতে অদ্য সকাল পর্যন্ত র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর বসিলা হতে জেএমবি’র একটি গ্রুপের কর্ণধার মোঃ এমদাদুল হক উজ্জল মাষ্টার ময়মনসিংহ’কে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত অভিযানে জব্দ করা হয় ০১টি বিদেশী পিস্তল, ০৫ রাউন্ড গোলাবারুদ, নগদ তিন লক্ষাধিক টাকা, রাসায়নিক দ্রব্য, অভিনব পদ্ধতিতে তৈরীকৃত দেশীয় বুলেট প্রুপ জ্যাকেট, উগ্রবাদী বই ও লিফলেট ইত্যাদি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মোঃ এমদাদুল হক উজ্জল মাষ্টার নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
গ্রেফতারকৃত জঙ্গি মোঃ এমদাদুল হক উজ্জল মাষ্টার ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে। ১৯৯৫ সালে স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারণে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় সে চাকুরীচ্যুত হয়। সে ২০০২ সালে মুক্তাগাছায় সফররত এক জঙ্গি নেতার বয়ান শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে সে শায়েখ আব্দুর রহমান এর নিকট হতে বায়াত প্রাপ্ত হয়। অতঃপর সে সহ বেশ কয়েকজন জামালপুরে একটি আস্তানায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। জঙ্গি তৎপরতায় সে অতি দ্রুত ময়মনসিংহের একজন আঞ্চলিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সে শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও সালাহউদ্দিন সালেহীন এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল। গ্রেফতারকৃত এমদাদুল হক উজ্জল মাষ্টার জেএমবি শীর্ষ নেতাদের ময়মনসিংহে অবস্থানের সফরকালীন সময়ে বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকত। উপরোক্ত নেতাদের গোপন আস্তানায় অবস্থান, মিটিং ও বয়ান আয়োজনে ভূমিকা রাখত। সে জানায়, সম্প্রতি ময়মনসিংহের অভিযানে গ্রেফতারকৃত জেএমবি সদস্য জুলহাসসহ ১০ জন জেএমবি সদস্য ২০০৩ সালে তার নিকট বায়াত নেয়। উক্ত বায়াতে অংশগ্রহণকৃত ১০ জেএমবি সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা গ্রেফতারও হয়েছে। কেউ কেউ এখনও আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে র্যাব অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গি ২০০২ পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ এলাকায় জঙ্গি কার্যক্রমের জন্য অর্থ সংগ্রহ করত। সে ধর্মীয় আবেগ অনুভ‚তিকে অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে জঙ্গি কার্যক্রমে ব্যয় করত।
গ্রেফতারকৃত জঙ্গি এমদাদুল হক আরও জানায় যে, সে ২০০৩ সালে মুক্তাগাছা এলাকায় একটি ব্রাক অফিস ডাকাতির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়া গ্রেফতারকৃতের নাশকতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ঢাকা ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন থানায় ২০০৭ ও ২০১২, ২০১৫ এবং ২০২০ সালে মামলা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। সে মুক্তাগাছায় ২০০৭ সালের স্থানীয় জঙ্গি নেতাদের সাথে নাশকতার গোপন বৈঠক চলাকালীন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সম্মুখীন হয়। সে সময় সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এছাড়া ২০০৭ সালে তার নিকটাত্মীয় রফিক মাস্টার হত্যাকান্ডে সে জড়িত ছিল। সে জানায় রফিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্যকে ধরিয়ে দেয় মর্মে তারা জানতে পারে। ফলশ্রুতিতে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে রফিক মাস্টারকে হত্যা করা হয়।
গ্রেফতারকৃত জঙ্গি এমদাদ জানায়, ২০০৭ সালের মামলার পর গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়। সে ২০০৮ হতে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মবেশেও নাম পরিবর্তন করে অবস্থান নেয়। আত্মগোপনে থাকাকালীন সময়ে সে কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, খেলনা বিক্রি, ফেরি ব্যবসা, রিক্সা ও রাজমিস্ত্রী ইত্যাদির ছদ্মবেশ ধারণ করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ২০১২ সালে সে রাজধানীর উত্তরা হতে গ্রেফতার হয়। অতঃপর সে “গোপন বৈঠকে নাশকতার পরিকল্পনা” এর মামলায় ২ বছর কারা অন্তরীণ ছিল। জেল থেকে বের হয়ে ২০১৫ সালে পুনরায় আবার বিস্ফোরকসহ গ্রেফতার হয়। পুনরায় ২০১৬ সালে জামিন প্রাপ্ত হয়ে সে পুনরায় আত্মগোপনে চলে যায়। এসময়ও সে পূর্বের ন্যায় বিভিন্ন ছদ্মবেশে রাজবাড়ী, রংপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নারায়নগঞ্জ ও ঢাকায় অবস্থান করে, সেখানে সে জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতা বজায় রাখে।
সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়লে সাংগঠনিক দূর্বলতা তৈরী হয়। ফলে তারা বিচ্ছিন্নভাবে স্বতন্ত্র কয়েকটি গ্রুপটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গি এমদাদ তার বিশ্বস্ত ও পুরাতন জেএমবি সহযোগীদের সংগঠিত করে একটি গ্রুপ তৈরীর চেষ্টা চালায়। সে উক্ত গ্রুপের মূল কর্ণধার ও সমন্বয়ক। তার গ্রুপে অর্ধশতাধিক অনুসারী রয়েছে বলে সে জানায়। গ্রুপটির নেটওয়ার্ক ময়মনসিংহ, জামালপুর, উত্তরবঙ্গসহ কয়েকটি জেলায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়াদি দেখার জন্য দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হয়েছে। অধিকাংশ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মূলধারার জেএমবি এর পুরাতন সদস্য বলে সে জানায়। এ ধরণের কয়েকজন দায়িত্বশীল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করেছি। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গ্রুপের প্রশিক্ষণ, দাওয়াত, রশদ ইত্যাদি বিষয় দেখভাল করে। তবে গ্রেফতারকৃত জঙ্গি নিজে প্রত্যক্ষভাবে অপারেশন কার্যক্রম তদারকি করে থাকে। তাদের আইটি সেক্টরকে সমৃদ্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে গ্রেফতারকৃত জানায়। অপারেশন দলের পাশাপাশি তারা “সাইবার ফোর্স” গঠনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রথাগত দাওয়াতের পাশাপাশি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিতে তারা করোনাকালীন অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে। সংগঠনের অর্থের যোগান দেওয়ার জন্য গ্রেফতারকৃত জঙ্গি এমদাদুল হক নাশকতা, ডাকাতি, ছিনতাই এ অংশগ্রহণ করতে তার সদস্যদের নির্দেশ দেয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
বিজনেস বাংলাদেশ/ এস শিকদার