ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের পুতুল নাচ বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। এক সময় গ্রামীণ জনপদে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার বিনোদনে বিশেষ করে শিশুদের বিনোদনে পুতুল নাচের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় তিতাসের কূলঘেষে গড়ে উঠা প্রাচীন জনপদ কৃষ্ণনগর।
এই গ্রামে ১৮৭৯ সালে ৩১ডিসেম্বর পিতা বৃন্দাবন দাসের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন কালজয়ী অমর শিল্পী ভারতীয় উপমহাদেশের পুতুল নাচের জনক ওস্তাদ বিপিন দাস। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েও তিনি গুরু গৃহে প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শিখে শৈশব-কৈশোর কাটান। তিনি পার্শ্ববর্তী মেরকুটা গ্রামে তুলসী বালাকে বিবাহ করেন। সংসার জীবনে তিনি চার ছেলে ও তিন মেয়ের জনক ছিলেন। ছেলেরা হলেন ওস্তাদ গোপাল দাস, ওস্তাদ গোবিন্দ দাস, অনিল দাস, ও অর্জুন দাস।
মেয়েরা হলেন দশদাবালা, সাধনবালা ও চারু বালা। তৎকালীন সময়ে মনতলা ঘাট হতে গয়না ও মাল বোঝাই নৌকা ও জাহাজ নারায়ণগঞ্জ হয়ে কলকাতায় আসা-যাওয়া করত। এই সব জাহাজের দায়িত্বে থাকা পিতামহ গগন দাসের সাথে কিছু সময় বিপিন দাসও এই কাজ করেছিলেন বলে তাঁকে অনেকে বিপিন মাঝি বলে থাকেন। কৈশোর বয়সেই মাটির তৈরি পুতুল দেখে তাঁর মাঝে স্বপ্ন জাগে এ গুলিকে যদি নাচানো যেত, তাহলে নৃত্যের তালে তালে অনেক কিছু বলা যেত। ভারতীয় উপমহাদেশে নবীনগরের কৃষ্ণনগর গ্রামের বিপিন পাল প্রথম আধুনিক পুতুল নাচের প্রচলন করেন। বিপিন পাল তৎকালীন সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে পুতুল নাচ করতেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়াও গ্রামীণ জীবনের নানা দৃশ্যপট তুলে ধরা হয় এতে। কখনও কাঠুরিয়াকে বাঘের আক্রমণ , কখনওবা জেলেদের কুমির খেয়ে ফেলার করুণ পরিনতি তুলে ধরা হয়েছে। জমজমাট এই পুতুল নাচ দেখার জন্য শিশু বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি- পেশার লোকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত ছিল। পুতুল নাচ দেখে শিশুদের আনন্দের সীমা ছিল না, এই ভাবনা থেকেই তিনি প্রথমে মাটির পুতুল, দেবদেবীসহ বিভিন্ন আকৃতির পুতুল তৈরি শুরু করে ক্রমান্বয়ে স্টিক পুতুল, স্প্রিং পুতুল ও সূতোর তৈরি পুতুল তৈরি করেন। তিনি একই এলাকার কয়েক জন শিষ্যকে সাথে নিয়ে চমক তৈরি করে ছিলেন পুতুল নাচ সৃষ্টির মাধ্যমে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে তাঁর পরিবার সহ মতি মিয়া, রমনাথ বাবু, তারুমিয়া ও সিদ্দিক মিয়াকে সাথে নিয়ে বৃদ্ধি করেন পুতুল নাচের প্রচার ও প্রসারতা।
তাঁর এ শিষ্যরা দীর্ঘবছর ওস্তাদের সাথে থেকে পরবর্তীতে যার যার এলাকায় পুতুল নাচের দল তৈরি করে। এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডার ধন মিয়া, কালু মিয়া, মো. রাজ হোসেন, কাজিপাড়ার শরীফ মালদার এবং কান্দপাড়ার কয়েক ঘর পুতুল নাচের আকর্ষণে প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেরাও পুতুল নাচের দল তৈরি করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, বিক্রমপুর, সিলেট, নোয়াখালী, চট্রগ্রামসহ সারাদেশ ব্যাপী এই পুতুল নাচ দলের পদচারণায় মুখরিত করে তুলেন। তা ছাড়া ঐ সময় ফরিদপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় পুতুল নাচের প্রচলন ও জনপ্রিয়তা আলোড়ন তৈরি করে ছিল। বিপিন দাস তাঁর দুই ছেলে গোপাল দাস ও গোবিন্দ দাসকে সাথে রেখে এই পেশায় শিক্ষা দেন এবং তাঁরাও ওস্তাদ হয়ে বিপিন দাসের স্বপ্নের পুতুল নাচ সর্ব ভারতে ছড়িয়ে দেন।
ওস্তাদ গোপাল দাস পিতা বিপিন দাসের নির্দেশে ভারতে গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় তাঁর অসংখ্য শিষ্য তৈরি করে পুতুল নাচের দল গঠন ও পরিচিতি তুলে ধরেন। ফলে পুরো ভারতবর্ষে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও বিপিন দাসের পরিচিতিসহ সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুধু ভারতই নয় তিনি পুতুল নাচের দল নিয়ে পৃথিবীর প্রায় ২৭টি দেশ ভ্রমণ করেন। স্বীকৃতি স্বরূপ বিপিন দাসের পক্ষে মরণোত্তর বিভিন্ন পদক ও পুরস্কার ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সহ অনেক স¦নামধন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হতে গ্রহণ করেন। ওস্তাদ গোবিন্দ দাস পিতার সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে পুতুল নাচের ব্যাপক প্রচার ও দল গঠন করে পরিচিতি তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকেন।
ওস্তাদ গোবিন্দ দাস তাঁর ছেলে বাদল দাসকে এই পেশায় দীক্ষা দিয়ে নিজের হাতে গড়া “দি রয়েল বেঙ্গল পুতুল নাচ”, “সাঝের বাতি পুতুল নাচ” ও “সন্ধ্যামালতী” নামক তিনটি পুতুল নাচের দল দিয়ে আজ পযন্ত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বিপিন দাস বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ও বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনে বেশ পটু ছিলেন। তিনি সেতার, হারমোনিয়াম, তবলা, মাটির পাতিল – ঝালা সহ অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। ওস্তাদ বিপিন দাস রৌদ্রবীণা এবং খৈমন বীণা বাজাতে ওস্তাদ ছিলেন। তিনি তবলা বোলে “বদ্ধকালা” বোল নিজে সৃষ্টি করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসন আমলে তিনি বেশ কয়েকটি নির্বাক ছবি তৈরি করেছিলেন। এদের মধ্যে -ডধী ফড়ষষ , ঝরষবহপব ঃড়বিৎ, ইৎড়শবহ রফড়ষধঃবৎ ংঃুষব ইত্যাদি। এ ছাড়া সবাক ছায়াছবি-“সোনা গাঙের নোনা মাঝি” এবং ১৯৬২ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যৌথভাবে নির্মিত তাঁর জীবনের সর্বশেষ ছবি-“শোয়ে নদীয়া জাগে পানি” তৈরি করেছিলেন। বিপিন পালের পুতুল নাচের দলে ১৪ জন সদস্য ছিল ।
এর মধ্যে ১০ জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করত। বাকিরা বাদ্যযন্ত্র বাজাত ও গান গাইত। দেশের বিখ্যাত পুতুল নাচের পালা গুলো হল ‘মনহারা’, ‘রাজকন্যা মনিক মালা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘রূপবান’, ‘গরীবের ছেলে’, ‘গরীবের মেয়ে’, হিংসার পরিনাম’,‘প্রেম সার্থক’ ও ‘গাজী কালু ’, ‘গুনাই সুন্দরী’, ‘সাগর ভাসা’, ‘ফেরারি সম্র্রাট, ‘নাচ মহল’, ‘ভিখারির ছেলে’ পুতুল নাচের অন্যতম পালা। এ ছাড়া পুতুল নাচে সাপ, নৌকা-মাঝি, কুমার, মাছ, বাঘ, হনুমান, হরিণ, ঘোড়া প্রভূতি বিষয় নিয়ে গ্রাম্য জীবনভিত্তিক হাসি-ঠাট্টা ও তামাশামূলক গল্পে রচিত পুতুল নাচ গ্রামীণ জনপদের বিনোদনের গুরুত্বপূর্ন মাধ্যম ছিল। গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এই বিশাল জনপ্রিয়তার অগ্রপথিক হিসাবে বিপিন দাস ছিলেন পথ প্রদর্শক ও নির্দেশক।
পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি তৎকালীন সমাজ ও মানুষের সুপ্ত ভাবনা প্রভাবিত করতে চেয়ে ছিলেন নিজস্ব সৃষ্টিশীলতায় ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে সচেতনতা তৈরি করতে। বর্তমানে অশ্লীল নাচ গানের কারণে পুতুল নাচ নানান বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, প্রশাসন সাধারনত এ সব প্রোগ্রাম করার অনুমতি দেয় না। কারণ বিভিন্ন সময় পুতুল নাচের নামে বিভিন্ন ব্যক্তিরা অশ্লীল নাচ গান করে। পুতুল নাচ দলের সদস্যদের দাবী “এ বিষয়ে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা করে এ শিল্পকে রক্ষা করতে।
বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব