পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা, ঘাটতি মেটানো ও গ্রীষ্ককালীন পেঁয়াজ আবাদ মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কয়েক বছর ধরে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তালিকা তৈরি হওয়ায় নয়ছয়, প্রকৃত কৃষকদের প্রণোদনা না দেওয়া, মাঠ পর্যায়ে তদারকির অভাবসহ নানা অনিয়মে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকার কোটি কোটি টাকার প্রণোদনা দিলেও এ থেকে টার্গেটের সিকিভাগ পেঁয়াজও উৎপাদিত হয়নি। ফলে জনগণের করের টাকায় দেওয়া প্রণোদনার সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। অনেকে দামি পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে দিচ্ছে কালোবাজারে।
প্রণোদনার সুফল কতটা মিলেছে, তা জানতে মাঠ পর্যায়ে কৃষক, ইউপি চেয়ারম্যান, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা হয় । এতে দেখা গেছে, কাগজ-কলমে পেঁয়াজ চাষ ও উৎপাদনের নানা রেকর্ড দেখানো হলেও বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই।
প্রথম দফায় কুষ্টিয়া জেলার ৬টি উপজেলায় ১ হাজার ২০০ জনকে প্রণোদনা দেওয়া হয় গত বছরের আগস্টে। দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা দেওয়া হয় অক্টোবরে। প্রথম দফার প্রণোদনার পেঁয়াজ উত্তোলনের জন্য নির্ধারণ করা হয় ডিসেম্বরকে। অক্টোবরে দেওয়া প্রণোদনার পেঁয়াজ উত্তোলনের কথা মার্চ দ্বিতীয় সপ্তাহে।
কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দুই দফায় জেলায় ৬টি উপজেলার ৬৩টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার ২ হাজার ৪০০ জনকে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিজনকে নগদ অর্থ ২ হাজার ৮০০ টাকা, এক কেজি উন্নত জাতের পেঁয়াজ বীজ, সুতালি, পলিথিন, বালাইনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ। এর মধ্যে নগদ টাকা ছিল ৬৭ লাখ ২০ হাজার। আর প্রতি কেজি পেঁয়াজ বীজ ২ হাজার ৭৮০ টাকা হিসেবে সরকারের খরচ হয় ৬৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতিজনকে আরও দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। এতে আরও ব্যয় হয় ৪৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে কুষ্টিয়া জেলায় ব্যয় হয় ১ কোটি ৮১ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
প্রণোদনা পাওয়া কৃষকদের সংখ্যা কুমারখালী ও কুষ্টিয়া সদরে বেশি। এর মধ্যে তালিকায় কুষ্টিয়া সদরের জিয়ারখী ইউনিয়নের বেলাঘরিয়া গ্রামের সদ্য অবসরে যাওয়া কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলামের ভাই ও আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। তারা পেঁয়াজ আবাদ না করলেও প্রণোদনা নিয়েছেন।
জানা গেছে, কৃষক বাছাইয়ের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে কমিটি আছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কমিটির সভাপতি ও উপসহকারী কৃষি অফিসার কমিটির সদস্য সচিব। তবে প্রতিটি এলাকায় তালিকা করার সময় ক্ষমতাসীন দলের ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অলিখিত কোটা পান। তাঁরা তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও সমর্থকদের নাম দেন। চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা থাকায় কৃষক বাছাইয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের তেমন মতামত নেওয়া হয় না। ইচ্ছামতো তালিকা করে পাঠানো হয় উপজেলা কৃষি অফিসে। সেই তালিকায়ও কৃষকের নামসহ মোবাইল ফোন নম্বরে নানা অসংগতি পাওয়া গেছে।
কুষ্টিয়া সদরের দুটি ও কুমারখালী উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের প্রণোদনা পাওয়া ২০/২২ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের নানা অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। ৫/৬ জন কৃষকের মোবাইল ফোনে রিং দিলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
প্রণোদনা পাওয়া বটতৈল ইউনিয়নের দক্ষিণ বটতৈল গ্রামের বদর উদ্দিনের ছেলে শাজাহান আলী বলেন, ‘সরকার থেকে কয়েক মাস আগে পেঁয়াজের বীজ ও নগদ টাকা পেয়েছিলাম। তবে আবাদ করতে পারিনি নানা কারণে। টাকা খরচ হয়ে গেছে।’ একই ইউনিয়নের কবুরহাট গ্রামের কৃষক হিরো শেখ, রাইজুল ইসলাম ও আজিজুল হকও একই কথা বলেন। তাঁরা জানান, প্রণোদনার জন্য নেতারা তাঁদের নাম দিয়েছেন।
বালিয়াপাড়া গ্রামের আবুল বেপারীর ছেলে আব্দুর রশিদ বলেন, ‘যতœ করেও চারা হয়নি। সব নষ্ট এবং লোকসান হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর এলাকার প্রণোদনা পাওয়া কেউই পেঁয়াজ জন্মাতে পারেনি। সব নষ্ট হয়ে গেছে। একই গ্রামের হামিদুল ইসলাম বলেন, কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী তাঁর নাম দিয়েছিলেন তালিকায়। দলীয় বিবেচনাতেই সবাই প্রণোদনা পেয়েছেন। বিষয়টি স্বীকার করে সেকেন্দার আলী বলেন, কৃষি প্রণোদনা এলে দলের লোকজন কৃষকদের নাম পাঠায়। এভাবে অনেকে প্রণোদনা পান। জিয়ারখী ইউনিয়নের বরিয়া গ্রামের অন্তত ২৫ জন কৃষক পেয়েছেন প্রণোদনা। কেউ এখনও আবাদ শুরু করতে পারেননি। অনেকে আবাদ না করে বীজ ফেলে রেখেছেন ঘরে। টাকা খরচ করেছেন অন্য কাজে।
কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা, চাপড়া ও পান্টি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয়। এ তিন ইউনিয়নে প্রণোদনা পেয়েছেন ২ শতাধিক কৃষক। এর মধ্যে যদুবয়রা ইউনিয়নের তালিকা প্রস্তুত করেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতারা। একইভাবে অন্য দুই ইউনিয়নে তালিকা করেন চেয়ারম্যান ও নেতারা।
যদুবয়রা ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিন পেঁয়াজের ব্যবসা করেন। সচ্ছল কৃষক হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনিও প্রণোদনা পেয়েছেন। তিনি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদের বীজ ও টাকা পেলেও আবাদ করেছেন ৩ কাঠা জমিতে।
তবে কৃষি কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ এবার মাঠ পর্যায়ে খুব একটা গড়ায়নি বলে মনে করেন কেউ কেউ।
কুষ্টিয়া খামারবাড়ির উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, ‘কয়েকটি এলাকায় পেঁয়াজ ভালো হয়েছে বলে খবর জানি। তবে কোনো অসংগতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব






















