০৯:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তামা কাঁসার ও পিতলের তৈজসপত্র

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য পিতল-কাঁসা শিল্প। নিত্য নতুন সিরামিক, মেলামাইন, কাঁচ ইত্যাদির সামগ্রী সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ পিতল-কাঁসার ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। নিকট অতীতেও পিতল-কাঁসা সামগ্রী গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহৃত হিসেবে দেখা যেতো। বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ার সাথে সাথে এসবের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে।

 

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার মধ্যবাজারে একমাত্র অবস্থিত তামা কাঁসার ও পিতলের দোকান নাম বিপুল পাল, পিতা মৃত বিনয় পাল, বাড়ি বিলশুকা, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া। তিনি বলেন, আমি ছোট কাল থেকেই এই ব্যবসার সাথে জড়িত আছি। বর্তমানে বেচাকেনা কম হয় তারপরও পুরাতন ঐতিহ্য ব্যবসা ছাড়তে পারি না। বিদেশী পর্যটকরা এক সময়ে কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজ খচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেতো। কিন্তু এই পিতল-কাঁসা শিল্পের ঐতিহ্য আজ নানা সমস্যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা বর্তমানে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দেখারও কেউ নেই।

 

পিতল-কাঁসা শিল্পে জড়িত শিল্পীরা পৈতৃক পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কাঁসার তৈজসপত্র আমাদের ঐতিহ্য ও বাঙালী সামাজিক জীবনের অন্যতম কালচারের অংশ। বাঙালির গৃহস্থালি ও কৃষ্টির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প। একসময় বিয়ে, খৎনা, জন্মদিন, আকিকা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে প্রধান উপহার সামগ্রী ছিল কাঁসার গ্লাস, বাটি, ফুলদানি, চামচ, রেকাব শানকে, গামলা, বেলিবগি, পানদানি, থালা, পিতলের টব, কলসি, বালতি, কড়াই, পানের থালা, ধূপদানি, তামার কলস, হাঁড়ি-পাতিল, পুষ্পপাত্র ইত্যাদি। যেকোনো অনুষ্ঠানেও দেওয়া হতো নাম খোদাই করা এসব কাঁসার । সেসব উপহার স্থান দখল করে নিয়েছে আধুনিক ডিজাইনের চীনামাটি, পাইরেক্স, মেলামাইন, প্লাস্টিক, কাঁচ ও স্টিল। কাঁচামাল কারিগরের অভাবে বাংলা ঐতিহ্য তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

এক সময় ভেড়ামারায় কাঁসা ও পিতলের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কাঁসা ও পিতলের অপূর্ব শিল্প কর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকার কাঁসা শিল্পীদের মধ্যে নাম করা অনেককেই প্রশংসা ও পদকে ভূষিত করেছেন। এদের মধ্যে প্রয়াত মধুসূদন কর্মকার, গণেশ কর্মকার, বসন্ত কর্মকার, যোগেশ কর্মকার, হারান কর্মকার উল্লেখযোগ্য কাঁসা একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ। বাংলায় এ মিশ্র ধাতব শিল্পটি কখন, কোথায় শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়না। তবে শিল্প গবেষক ও নৃবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একে পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চান। এই শিল্পকে রামায়ণ-মহাভারতের যুগের বলেও মনে করেন অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পী। বংশগত পেশায় কাঁসার শিল্পী প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র কর্মকার মনে করতেন, রামায়ণ-মহাভারতের জীবনচর্চায় পূজা-পার্বণে কাঁসার তৈরি ঘটি-বাটি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারে তিনি এ ধারণা পোষণ করতেন।

১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসনামলে এ দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে তারা ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করত। ব্রিটিশ শাসনামলে এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এ শিল্পের ছোট-বড় বহু কারখানা গড়ে ওঠে।

নৃবিজ্ঞানীদের তথ্যসূত্রে জানা যায়, এ শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সে সময়ের রাজা প্রদ্যুৎ কুমার ঠাকুর। তিনি প্রথম এই হস্তশিল্পের সামগ্রী নিজে ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে লন্ডনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এ স্বর্ণোজ্জ্বল রাজকীয় নকশার ডিনার সেট উপঢৌকন হিসেবে রাজপরিবারে পাঠিয়েছিলেন।

১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সে প্রদর্শনীতে জামালপুরের ইসলামপুরের কাঁসার বাসন দর্শকের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে শিল্পী জগৎচন্দ্র কর্মকার তাঁর হাতে গড়া তৈজসপত্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ কাঁসাশিল্পী হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এতে করে সারা বিশ্বে কাঁসাশিল্পের পরিচিতি লাভ করে এর চাহিদা দিন দিন আরও বেড়ে যায়।

কাঁসার তৈরি নান্দনিক তৈজসপত্র: দেশে কাঁসাশিল্পের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত ধামরাই, শিমুলিয়া, টাঙ্গাইলের কাগমারী, বগুড়ার শিববাড়ী, রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও জামালপুরের ইসলামপুর কাঁসাশিল্প গড়ে উঠেছিল।

 

এ শিল্পটিও কি মসলিন শিল্পের মতো বিলীন হয়ে যাবে কালের গর্ভে? নাকি পরবর্তী প্রজন্মকে আমরাও দিতে পারব একটি একান্ত আপন অনুভূতি? জন্মদিনে প্রিয়জন একটি কাঁসার গ্লাস কিংবা ফুলদানিতে নাম খোদাই করা উপহার দিলে সেটি সে আনকোরা আবেগে সযত্নে রাখবে নিজের কাছে। ব্যবহারের সময় মনে পড়বে সেই উপহারের কথা। আনমনে, আপনমনে কেউ কেউ তাকিয়ে ভাববে খোদাই করা নিজের নামে।

ট্যাগ :

গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তামা কাঁসার ও পিতলের তৈজসপত্র

প্রকাশিত : ০৮:৫১:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য পিতল-কাঁসা শিল্প। নিত্য নতুন সিরামিক, মেলামাইন, কাঁচ ইত্যাদির সামগ্রী সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ পিতল-কাঁসার ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। নিকট অতীতেও পিতল-কাঁসা সামগ্রী গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহৃত হিসেবে দেখা যেতো। বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ার সাথে সাথে এসবের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে।

 

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার মধ্যবাজারে একমাত্র অবস্থিত তামা কাঁসার ও পিতলের দোকান নাম বিপুল পাল, পিতা মৃত বিনয় পাল, বাড়ি বিলশুকা, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া। তিনি বলেন, আমি ছোট কাল থেকেই এই ব্যবসার সাথে জড়িত আছি। বর্তমানে বেচাকেনা কম হয় তারপরও পুরাতন ঐতিহ্য ব্যবসা ছাড়তে পারি না। বিদেশী পর্যটকরা এক সময়ে কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজ খচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেতো। কিন্তু এই পিতল-কাঁসা শিল্পের ঐতিহ্য আজ নানা সমস্যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা বর্তমানে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দেখারও কেউ নেই।

 

পিতল-কাঁসা শিল্পে জড়িত শিল্পীরা পৈতৃক পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কাঁসার তৈজসপত্র আমাদের ঐতিহ্য ও বাঙালী সামাজিক জীবনের অন্যতম কালচারের অংশ। বাঙালির গৃহস্থালি ও কৃষ্টির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প। একসময় বিয়ে, খৎনা, জন্মদিন, আকিকা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে প্রধান উপহার সামগ্রী ছিল কাঁসার গ্লাস, বাটি, ফুলদানি, চামচ, রেকাব শানকে, গামলা, বেলিবগি, পানদানি, থালা, পিতলের টব, কলসি, বালতি, কড়াই, পানের থালা, ধূপদানি, তামার কলস, হাঁড়ি-পাতিল, পুষ্পপাত্র ইত্যাদি। যেকোনো অনুষ্ঠানেও দেওয়া হতো নাম খোদাই করা এসব কাঁসার । সেসব উপহার স্থান দখল করে নিয়েছে আধুনিক ডিজাইনের চীনামাটি, পাইরেক্স, মেলামাইন, প্লাস্টিক, কাঁচ ও স্টিল। কাঁচামাল কারিগরের অভাবে বাংলা ঐতিহ্য তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

এক সময় ভেড়ামারায় কাঁসা ও পিতলের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কাঁসা ও পিতলের অপূর্ব শিল্প কর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকার কাঁসা শিল্পীদের মধ্যে নাম করা অনেককেই প্রশংসা ও পদকে ভূষিত করেছেন। এদের মধ্যে প্রয়াত মধুসূদন কর্মকার, গণেশ কর্মকার, বসন্ত কর্মকার, যোগেশ কর্মকার, হারান কর্মকার উল্লেখযোগ্য কাঁসা একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ। বাংলায় এ মিশ্র ধাতব শিল্পটি কখন, কোথায় শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়না। তবে শিল্প গবেষক ও নৃবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একে পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চান। এই শিল্পকে রামায়ণ-মহাভারতের যুগের বলেও মনে করেন অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পী। বংশগত পেশায় কাঁসার শিল্পী প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র কর্মকার মনে করতেন, রামায়ণ-মহাভারতের জীবনচর্চায় পূজা-পার্বণে কাঁসার তৈরি ঘটি-বাটি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারে তিনি এ ধারণা পোষণ করতেন।

১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসনামলে এ দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে তারা ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করত। ব্রিটিশ শাসনামলে এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এ শিল্পের ছোট-বড় বহু কারখানা গড়ে ওঠে।

নৃবিজ্ঞানীদের তথ্যসূত্রে জানা যায়, এ শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সে সময়ের রাজা প্রদ্যুৎ কুমার ঠাকুর। তিনি প্রথম এই হস্তশিল্পের সামগ্রী নিজে ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে লন্ডনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এ স্বর্ণোজ্জ্বল রাজকীয় নকশার ডিনার সেট উপঢৌকন হিসেবে রাজপরিবারে পাঠিয়েছিলেন।

১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সে প্রদর্শনীতে জামালপুরের ইসলামপুরের কাঁসার বাসন দর্শকের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে শিল্পী জগৎচন্দ্র কর্মকার তাঁর হাতে গড়া তৈজসপত্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ কাঁসাশিল্পী হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এতে করে সারা বিশ্বে কাঁসাশিল্পের পরিচিতি লাভ করে এর চাহিদা দিন দিন আরও বেড়ে যায়।

কাঁসার তৈরি নান্দনিক তৈজসপত্র: দেশে কাঁসাশিল্পের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত ধামরাই, শিমুলিয়া, টাঙ্গাইলের কাগমারী, বগুড়ার শিববাড়ী, রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও জামালপুরের ইসলামপুর কাঁসাশিল্প গড়ে উঠেছিল।

 

এ শিল্পটিও কি মসলিন শিল্পের মতো বিলীন হয়ে যাবে কালের গর্ভে? নাকি পরবর্তী প্রজন্মকে আমরাও দিতে পারব একটি একান্ত আপন অনুভূতি? জন্মদিনে প্রিয়জন একটি কাঁসার গ্লাস কিংবা ফুলদানিতে নাম খোদাই করা উপহার দিলে সেটি সে আনকোরা আবেগে সযত্নে রাখবে নিজের কাছে। ব্যবহারের সময় মনে পড়বে সেই উপহারের কথা। আনমনে, আপনমনে কেউ কেউ তাকিয়ে ভাববে খোদাই করা নিজের নামে।