কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় পুলিশের হয়রানি বন্ধে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছে স্থানীয় বিএনপি। মঙ্গলবার (০৮ এপ্রিল) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানান মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মোল্লা মুজিবুল হক।
তিনি বলেন, ১৭ বছর আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতন সহ্য করা বিএনপি নেতাকর্মীরা আজো ঘর ছাড়া। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যে সকল অত্যাচারী নেতাদের দ্বারা বিএনপি জামায়াতসহ সাধারণ জনগণ নির্যাতিত ছিল এবং যাদের অত্যাচার থেকে নারী পুরুষ হিন্দু মুসলিম কেউ রেহাই পেত না। সে সকল চাঁদাবাজ অত্যাচারী আওয়ামী লীগের নেতারা পুলিশের সহযোগিতায় নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। শুধু তাই নয়, পূর্বের ন্যায় পুলিশের সহযোগিতায় মুরাদনগরে জুলুম নির্যাতন শুরু করেছে।
সুতরাং প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে মুরাদনগরের সাধারণ জনগণ ও বিএনপির পক্ষ থেকে আকুল আবেদন এই যে, আমাদেরকে পুলিশের ফ্যাসিবাদী আচরণ থেকে রক্ষা করুন।
আমরা আমাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। কুমিল্লার এসপি মুরাদনগর ও বাঙ্গরা থানার ওসির গায়েবি মামলা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই। আমাদেরকে নব্য ফ্যাসিবাদ ও পুলিশের বেআইনি ক্ষমতার হাত থেকে মুক্ত করুন। অন্যথায় মুরাদনগরের আপামর জনতা আরেকবার যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবে। মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
মোল্লা মুজিবুল হক বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছরে শেখ হাসিনার দু:শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে সারাদেশের ন্যায় মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও জীবনবাজি রেখে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু আমরা মুরাদনগরবাসী আজও ফ্যাসিবাদের রোষানলে পড়ে রয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের নেতা মুরাদনগরের ৫ বারের সাবেক এমপি ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নির্দেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে এমন কোনো কর্মসূচি নেই, যে কর্মসূচিতে মুরাদনগর বিএনপির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না? যার কারণে আমাদের জনপ্রিয় এ নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল আওয়ামী লীগ। তার গাড়িতে গুলি করে ব্রিকফিল্ডে (ইটভাটা) পুড়িয়ে মারা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় তৃতীয় চার্জশিটে কায়কোবাদ এর নাম অন্তর্ভুক্ত করে। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজও থেমে নেই। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের নির্দেশে মুরাদনগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা এখন এনসিপিরুপে কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও বিএনপির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
মোল্লা মুজিবুল হক বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার পর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কমিটি করা হয়। মূলত সেই কমিটিতে মুরাদনগরের কোম্পানিগন্জে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার আপন চাচাতো ভাইকে আহবায়ক করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়।
ফলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে ওই কমিটি প্রত্যাখান করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিউজ হয়েছে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে কুমিল্লার এসপি পরিবর্তন করে তার মদদপুষ্ট এসপি নিয়োগ দেয়। নতুন এসপি এসেই মুরাদনগর ও বাঙ্গরা থানার ওসি পরিবর্তন করে। মুরাদনগরের বর্তমান ওসি ঢাকায় ডিবিতে কর্মরত ছিলেন এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছেন। যিনি সব সময় সাবেক ডিবি প্রধান হারুনের প্রশংসা করেন। সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ঘনিষ্ঠ সহচর গোলাম কিবরিয়াকে দলে ভিড়িয়ে তার নেতৃত্বে মুরাদনগরের আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করছেন। বিভিন্ন ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান মেম্বার ও জুলুম নির্যাতনকারী পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে ফিরিয়ে এনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। তারই ধারাবাহিকতায় পবিত্র রমজানের শুরুর দিকে শ্রীকাইল ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার ডাকাতকে এনসিপির ব্যানার সজ্জিত গাড়ি দিয়ে উপদেষ্টার লোকজন এলাকায় নিয়ে আসে। তবে আনোয়ার ডাকাত যে সকল সাধারণ মানুষদের থেকে আওয়ামী লীগের আমলে জোর করে চাঁদা নিয়েছিলেন তাদের বাঁধার মুখে পড়েন। ওই ঘটনায় বিএনপি নেতাদের ঘর-বাড়ি ভাঙচুর করে আর পুলিশ আনোয়ার ডাকাতের ভাইয়ের মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে! আওয়ামী লীগের আমলে নির্যাতনকারী যুবলীগ নেতার ভাইয়ের মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীরা এখনো কারাগারে।
মোল্লা মুজিবুল হক বলেন, গত ২৪ মার্চ মুরাদনগরের কোম্পানিগন্জ সিএনজি স্ট্যান্ডে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার চাচাতো ভাই ওবায়েদ উল্লাহ সিরিয়ালের বাইরে গিয়ে সিএনজি নিতে চাইলে সেখানে কর্মরত কেরানী এবং সিএনজি চালকরা বাঁধা দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সদর ইউনিয়নের নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ সেক্রেটারী সাজিবসহ একদল তরুণদের ডেকে এনে সিএনজি চালকদের মারধর করে এবং পুলিশ ডেকে এনে চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে থানায় নিয়ে যায় উপদেষ্টার চাচাতো ভাই!
অন্যদিকে আটক শ্রমিকের মুক্তির দাবিতে সিএনজি চালকরা মিছিল করেন। আর সেই কথিত সমন্বয়করা (ছাত্রলীগের পদধারী নেতা) থানার ওসির উপস্থিতিতে ওসির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড মাইক হাতে হত্যার হুমকি দেয়। ওই ঘটনায় ওসি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো চলমান সমস্যার সমাধান করতে থানার শালিসে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়! শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। আটককৃত নেতাদের জামিন আবেদনে বিএনপির আইনজীবীরা কোর্টে দাঁড়ালে জামিনের বিরোধিতা করে বাদীর ও পুলিশের পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ তমাল ও আওয়ামী লীগের নেতা এডভোকেট তানভির রেজা ফয়সাল। পুলিশ ও কথিত সমন্বয়কের পক্ষে নিজেদের ওকালতনামা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিনের বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের জন্য কি ফ্যাসিবাদমুক্ত কোনো আইনজীবী ছিল না?
মুজিবুল হক আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভূমিকা কি প্রমাণ করে না যে, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যোগসাজশে বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিকল্পিতভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রশ্ন রেখে গেলাম।উপদেষ্টার লোকজন সংখ্যায় খুবই নগণ্য হলেও এখন পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই তাদের প্রধান ভরসা। তারা মুরাদনগরে আতংক ছড়াচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের ঘরে ঘুমাতে দেবে না। উপদেষ্টা মুরাদনগরে যা ইচ্ছে করবে। প্রশাসন তার কথামত কাজ করবে এবং বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। পুলিশ মুরাদনগরের ৬ লক্ষ মানুষকে উপেক্ষা করে গুটি কয়েক ছাত্রলীগ থেকে আসা এনসিপি কর্মীদের ঢাল হয়ে ঘুষ-চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। তাদের কথামত পুলিশ বিএনপি ও আপামর জনতাকে নানাভাবে নির্যাতন করছে। মুরাদনগর যেন পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা যেন শপথই করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ পুলিশ ভাই ভাই ভিন্নমতের ঠাঁই নাই।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সিএনজি স্ট্যান্ডের কেরানীকে ধরে নিয়ে তার ভাইয়ের কাছে ঘুষ দাবি করে পুলিশ। ঘুষ না দেওয়ায় সেই কেরানীকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় মুরাদনগরের ওসি জাহিদুর রহমান। নিরুপায় সিএনজির স্ট্যান্ডের কেরানি আবুল কালামের ভাই আদালতে ওসির বিরুদ্ধে মামলা করে। যা পিআইবিতে তদন্তাধীন রয়েছে। পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মুরাদনগরের সিএনজি চালক থেকে শুরু করে খেটে-খাওয়া মানুষ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আওয়ামী লীগ নেতারা এনসিপিতে যোগ দিচ্ছে এবং উপদেষ্টা আসিফের সাথে মিশে পুলিশের সহযোগিতায় বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর পূর্বের ন্যায় জুলুম নির্যাতন শুরু করেছে।
তিনি বলেন, আপনারা জেনে হতবাক হবেন- আওয়ামী লীগের মত নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই বিএনপি নেতাকর্মীদের হুমকি ধমকি এবং চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে পুলিশের সহযোগিতায় হয়রানি করছে আওয়ামী লীগের গোলাম কিবরিয়া ও উপদেষ্টার চাচাতো ভাই ওবায়েদ উল্লাহ। নিজের ক্ষমতার দাপট দেখাতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ও এখনো কুমিল্লা ও ঢাকা থেকে ডিবি পুলিশ এনে বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদেরও হয়রানি করছে। মুরাদনগরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজে ঘুম তো দুরে থাক নারী শিশুদের নিয়ে নির্ভয়ে বাড়িতেও থাকতে পারছে না। বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে ডিবি পুলিশের হানায় সাধারণ জনগণও আতংকিত। মুরাদনগরের মানুষ নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে চায়। দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অনুরোধ- আপনারা মুরাদনগরে আসুন এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করুন। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন (অব.) শাহজাহান ও মো. হারুন অর রশিদ, উপজেলা বিএনপির সদস্য মহিউদ্দিন মোল্লা, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলম সরকার, কামাল উদ্দিন ভুঁইয়া, নজরুল ইসলাম, মহিলা দলের সভাপতি কাজী তাহমিনা, যুবদল সভাপতি সোহেল সামাদ, মুরাদনগর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি দুলাল দেবনাথ ও সেক্রেটারি অধ্যাপক দীন দয়াল পাল, হেফাজতের নায়েবে আমির হাফেজ আমিনসহ ভুক্তভোগী ও নির্যাতিত পরিবারের কয়েকজন সদস্য।