০৮:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মহামারীর বছরে বেড়ে যেতে পারে ব্যাংকের নিট মুনাফা

  • নিউজ ডেস্ক
  • প্রকাশিত : ০৯:৪২:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • 16

করোনা মহামারীর কারণে ঋণের কিস্তি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখার দাবি ব্যবসায়ীদের। বেশির ভাগ ব্যাংকও তা-ই চায়। কারণ ঋণের কিস্তি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করা হলে কোনো ঋণই খেলাপি হবে না। ফলে প্রয়োজন পড়বে না সঞ্চিতি সংরক্ষণের। অন্যদিকে কিছু খেলাপি ঋণ আদায় হওয়ায় অবমুক্ত হবে আগের সঞ্চিতির অর্থ। পুঁজিবাজারে চাঙ্গা ভাব অব্যাহত থাকলে সেখান থেকেও আয় বাড়বে। সব মিলিয়ে বছর শেষে নিট মুনাফা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ব্যাংকগুলোর।

এদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখার দাবি পূরণ করতে গেলে বহুমুখী সমস্যায় পড়তে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারীতে বিপর্যস্ত ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমলেও নিট মুনাফা বাড়বে। বেশি ডিভিডেন্ড দিয়ে পরিচালকরা বেসরকারি ব্যাংক থেকে মুনাফার অর্থ বের করে নেয়ার সুযোগ পাবেন। এতে দুর্বল হবে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত। এজন্য সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মুনাফা পরিস্থিতি দেখেই শ্রেণীকৃত ঋণের সময় গণনা শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা।

করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক দুর্যোগে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে সবার আগে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চের শেষ সপ্তাহেই নির্দেশনা দেয়া হয়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ না করলেও কোনো ঋণ খেলাপি করা যাবে না। পরে এ সময়সীমা বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। সে হিসেবে চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে ঋণ শ্রেণীকরণের বর্ধিত সময়সীমা। নতুন করে সময় না বাড়ালে ডিসেম্বর থেকেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের খেলাপি করার সুযোগ পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিবেদন দেখে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ব্যাংকের মুনাফা যদি ইতিবাচক ধারায় থাকে, তাহলে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানো হবে না। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের কেস-টু-কেস ভিত্তিতে খেলাপি করার নীতিমালা দেয়া হবে। আর ব্যাংকের মুনাফা পরিস্থিতি খারাপ থাকলে শ্রেণীকরণের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হবে।

এদিকে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানোর দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। সম্প্রতি ভার্চুয়াল মাধ্যমে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা এ বিষয়ে সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এক পক্ষ বলছে, ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলোর চাপ কমবে। ব্যবসায়ী ও ঋণগ্রহীতারা এর সুফল পাবেন। অন্য পক্ষ বলছে, করোনায় কম ক্ষতির শিকার হয়েছেন এমন সামর্থ্যবান গ্রাহকরাও ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন। শ্রেণীকরণের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকলে বছরের শেষ তিন মাসে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কিস্তি পরিশোধে চাপ দিতে পারবে। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়বে, একই সঙ্গে গ্রাহকদের ঋণের দায়ও কমে আসবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, হিসাবের সুবিধার জন্য ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি করেছিলাম। তবে গ্রাহকদের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে সময়সীমা না বাড়ানোই ভালো। কারণ সামর্থ্য আছে এমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছেন না। এতে গ্রাহকদের দেনার ভার দিন দিন বড় হচ্ছে। গ্রাহকদের মনে রাখা দরকার, ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতেই হবে। সেটি আজ হোক কিংবা কাল।

ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ না বাড়িয়ে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পক্ষে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি। কিছু গ্রাহক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়ের কথা বলে টাকা দিচ্ছেন না। সবার জন্য ঋণ পরিশোধের মেয়াদ না বাড়িয়ে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে মেয়াদ বাড়ানোর নীতিমালা দিলে সুবিধা হতো।

ঋণের কিস্তি পরিশোধের শিথিলতার মেয়াদ না বাড়ানোর পক্ষে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদও। তিনি বলেন, আমাদের বড় গ্রাহকরা কিস্তির টাকা দিচ্ছেন না। ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আরোপ হলে গ্রাহকদের কাছ থেকে কিছু টাকা হলেও আদায় করা যেত।

জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত হওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতার শিথিলতা উঠিয়ে নেয়ার পর গ্রাহকরা বড় ধরনের চাপে পড়বেন। এ চাপ যাতে সহনশীল হয় সেজন্য ঋণ পরিশোধ নীতিতে ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্থগিত হওয়া ঋণের কিস্তিগুলো এখনই পরিশোধ করতে হবে না গ্রাহকদের। সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ঋণের শেষ কিস্তি পরিশোধের পরই স্থগিত হওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ স্বাভাবিক পন্থায় ডিসেম্বরে একজন গ্রাহক যে পরিমাণ অর্থ ঋণের কিস্তি হিসেবে পরিশোধ করার কথা, সে পরিমাণ অর্থই পরিশোধ করতে হবে। এতে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে না।

ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় শিথিলতা আনায় ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ফ্লো কমেছে। গ্রাহকরা কিস্তির টাকা ফেরত না দেয়ায় অনেক ব্যাংকের আমানতে টানও পড়েছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট যাতে তীব্র না হয়, তার জন্য সিআরআরে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকের এডি রেশিও বাড়ানো, রেপোর সুদহার ও ব্যাংক রেট কমানো হয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নগদায়নের সুযোগও দেয়া হয়েছে। মহামারীতে ছাড় দেয়া এসব নীতির সুফল ব্যাংকগুলো মার্চ থেকেই ভোগ করছে। গ্রাহকদের দেয়া সুযোগ- সুবিধার প্রতিদান হিসেবে ব্যাংকগুলোকে এসব নীতি সুবিধা দেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ বাড়ানো হলেও ব্যাংকের ভিত মজবুত করার উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, সঞ্চিতি সংরক্ষণের চাপ না থাকায় অনেক ব্যাংকের নিট মুনাফা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্যাংকগুলো যাতে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে মুনাফার অর্থ বের করে না দেয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মহামারী সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগে সারা বিশ্বের ব্যাংকগুলো রিজার্ভ ও সঞ্চিতি বাড়িয়ে আর্থিক ভিত শক্তিশালী করছে। আমাদের ব্যাংকগুলোকেও সে পথে হাঁটতে হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯ সালে রেকর্ড ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করেছে ব্যাংকগুলো। গত বছরে ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এ ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ যুক্ত হলে ব্যাংকিং খাতের বিপদগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।

বিজনেস বাংলাদেশ/এসএম

জনপ্রিয়

দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দেওয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, নগদ অর্থ লুট, আহত ৩

মহামারীর বছরে বেড়ে যেতে পারে ব্যাংকের নিট মুনাফা

প্রকাশিত : ০৯:৪২:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০

করোনা মহামারীর কারণে ঋণের কিস্তি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখার দাবি ব্যবসায়ীদের। বেশির ভাগ ব্যাংকও তা-ই চায়। কারণ ঋণের কিস্তি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করা হলে কোনো ঋণই খেলাপি হবে না। ফলে প্রয়োজন পড়বে না সঞ্চিতি সংরক্ষণের। অন্যদিকে কিছু খেলাপি ঋণ আদায় হওয়ায় অবমুক্ত হবে আগের সঞ্চিতির অর্থ। পুঁজিবাজারে চাঙ্গা ভাব অব্যাহত থাকলে সেখান থেকেও আয় বাড়বে। সব মিলিয়ে বছর শেষে নিট মুনাফা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ব্যাংকগুলোর।

এদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখার দাবি পূরণ করতে গেলে বহুমুখী সমস্যায় পড়তে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারীতে বিপর্যস্ত ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমলেও নিট মুনাফা বাড়বে। বেশি ডিভিডেন্ড দিয়ে পরিচালকরা বেসরকারি ব্যাংক থেকে মুনাফার অর্থ বের করে নেয়ার সুযোগ পাবেন। এতে দুর্বল হবে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত। এজন্য সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মুনাফা পরিস্থিতি দেখেই শ্রেণীকৃত ঋণের সময় গণনা শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা।

করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক দুর্যোগে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে সবার আগে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চের শেষ সপ্তাহেই নির্দেশনা দেয়া হয়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ না করলেও কোনো ঋণ খেলাপি করা যাবে না। পরে এ সময়সীমা বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। সে হিসেবে চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে ঋণ শ্রেণীকরণের বর্ধিত সময়সীমা। নতুন করে সময় না বাড়ালে ডিসেম্বর থেকেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের খেলাপি করার সুযোগ পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিবেদন দেখে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ব্যাংকের মুনাফা যদি ইতিবাচক ধারায় থাকে, তাহলে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানো হবে না। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের কেস-টু-কেস ভিত্তিতে খেলাপি করার নীতিমালা দেয়া হবে। আর ব্যাংকের মুনাফা পরিস্থিতি খারাপ থাকলে শ্রেণীকরণের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হবে।

এদিকে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানোর দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। সম্প্রতি ভার্চুয়াল মাধ্যমে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা এ বিষয়ে সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এক পক্ষ বলছে, ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলোর চাপ কমবে। ব্যবসায়ী ও ঋণগ্রহীতারা এর সুফল পাবেন। অন্য পক্ষ বলছে, করোনায় কম ক্ষতির শিকার হয়েছেন এমন সামর্থ্যবান গ্রাহকরাও ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন। শ্রেণীকরণের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকলে বছরের শেষ তিন মাসে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কিস্তি পরিশোধে চাপ দিতে পারবে। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়বে, একই সঙ্গে গ্রাহকদের ঋণের দায়ও কমে আসবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, হিসাবের সুবিধার জন্য ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি করেছিলাম। তবে গ্রাহকদের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে সময়সীমা না বাড়ানোই ভালো। কারণ সামর্থ্য আছে এমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছেন না। এতে গ্রাহকদের দেনার ভার দিন দিন বড় হচ্ছে। গ্রাহকদের মনে রাখা দরকার, ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতেই হবে। সেটি আজ হোক কিংবা কাল।

ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ না বাড়িয়ে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পক্ষে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি। কিছু গ্রাহক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়ের কথা বলে টাকা দিচ্ছেন না। সবার জন্য ঋণ পরিশোধের মেয়াদ না বাড়িয়ে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে মেয়াদ বাড়ানোর নীতিমালা দিলে সুবিধা হতো।

ঋণের কিস্তি পরিশোধের শিথিলতার মেয়াদ না বাড়ানোর পক্ষে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদও। তিনি বলেন, আমাদের বড় গ্রাহকরা কিস্তির টাকা দিচ্ছেন না। ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আরোপ হলে গ্রাহকদের কাছ থেকে কিছু টাকা হলেও আদায় করা যেত।

জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত হওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতার শিথিলতা উঠিয়ে নেয়ার পর গ্রাহকরা বড় ধরনের চাপে পড়বেন। এ চাপ যাতে সহনশীল হয় সেজন্য ঋণ পরিশোধ নীতিতে ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্থগিত হওয়া ঋণের কিস্তিগুলো এখনই পরিশোধ করতে হবে না গ্রাহকদের। সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ঋণের শেষ কিস্তি পরিশোধের পরই স্থগিত হওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ স্বাভাবিক পন্থায় ডিসেম্বরে একজন গ্রাহক যে পরিমাণ অর্থ ঋণের কিস্তি হিসেবে পরিশোধ করার কথা, সে পরিমাণ অর্থই পরিশোধ করতে হবে। এতে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে না।

ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় শিথিলতা আনায় ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ফ্লো কমেছে। গ্রাহকরা কিস্তির টাকা ফেরত না দেয়ায় অনেক ব্যাংকের আমানতে টানও পড়েছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট যাতে তীব্র না হয়, তার জন্য সিআরআরে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকের এডি রেশিও বাড়ানো, রেপোর সুদহার ও ব্যাংক রেট কমানো হয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নগদায়নের সুযোগও দেয়া হয়েছে। মহামারীতে ছাড় দেয়া এসব নীতির সুফল ব্যাংকগুলো মার্চ থেকেই ভোগ করছে। গ্রাহকদের দেয়া সুযোগ- সুবিধার প্রতিদান হিসেবে ব্যাংকগুলোকে এসব নীতি সুবিধা দেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ বাড়ানো হলেও ব্যাংকের ভিত মজবুত করার উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, সঞ্চিতি সংরক্ষণের চাপ না থাকায় অনেক ব্যাংকের নিট মুনাফা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্যাংকগুলো যাতে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে মুনাফার অর্থ বের করে না দেয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মহামারী সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগে সারা বিশ্বের ব্যাংকগুলো রিজার্ভ ও সঞ্চিতি বাড়িয়ে আর্থিক ভিত শক্তিশালী করছে। আমাদের ব্যাংকগুলোকেও সে পথে হাঁটতে হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯ সালে রেকর্ড ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করেছে ব্যাংকগুলো। গত বছরে ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এ ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ যুক্ত হলে ব্যাংকিং খাতের বিপদগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।

বিজনেস বাংলাদেশ/এসএম