চন্দন আনোয়ার (জ. ১৯৭৮-) বর্তমান বাংলাসাহিত্যের প্রত্যয়ী কথাসাহিত্যিক। গল্প-উপন্যাস ছাড়া মননশীল প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই তাঁর সৃষ্টির জগত যথেষ্ঠ সমৃদ্ধ। দুই বাংলা থেকেই তার বই প্রকাশিত হয়েছে। উভয় অনুসিন্ধৎসু পাঠক-লেখক যথেষ্ট সম্মোহনের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে এই প্রতিশ্রুতি গদ্যশিল্পীর দিকে।
তাঁর গল্পগ্রন্থ: প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন; ২. অসংখ্য চিৎকার ; ৩. পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর, ৪. ইচ্ছামৃত্যু ইশতেহার; ৫. ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ; ৬. আঁধার ও রাজগোখরা ৭. নির্বাচিত ৩০ । উপন্যাস : ১. শাপিতপুরুষ; ২. অর্পিত জীবন।
প্রবন্ধগ্রন্থ: ১. বাংলা ছোটগল্প ও তিন গোত্রজ গল্পকার : মানিক-হাসান-ইলিয়াস; ২. উজানের চিন্তক হাসান আজিজুল হক; ৩. হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণকৌশল; ৪. নজরুলের জীবন ও কর্মে প্রেম; ৫. বাঙালির চিন্তাবিভূতি : সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ; ৬. কথাসাহিত্যের সোজাকথা; ৭. হাসান আজিজুল হক : আলাপন ও মূল্যায়ন।
সম্পাদিত গ্রন্থ : ১. শূন্যদশকের গল্প : গল্পপঞ্চাশ; ২. হাসান আজিজুল হক : নিবিড় অবলোকন; ৩. এই সময়ের কথাসাহিত্য ১ম খণ্ড ও ২য় খণ্ড; ৪ হাসান আজিজুল হক সমীপেষু। তাঁর সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয় গল্প-বিষয়ক পত্রিকা ‘গল্পকথা’।
চন্দন আনোয়ারের জীবনবোধ ও সাহিত্যদর্শন বাঙ্গালির অতীত-বর্তমান সভ্যতা ও সময়কেন্দ্রিক। তাঁর গল্পের বিষয় গতানুগতিক সাদামাটা নয়, একটু ব্যতিক্রমী ধাঁচের। অত্যন্ত সুকৌশলে তিনি মানবজীবনের কদর্যচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর গল্পে স্থান উন্মোচিত হয়েছে প্রধানত মানুষের ব্যক্তিগত-সামাজিক-নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনের অবক্ষয়ের চিত্র। বিশেষ করে বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে নারীর অধিকার-প্রেম, সাংসারিক টানাপোড়ন, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা, নৈতিক ও মূল্যবোধের ক্ষয়িত রূপ, সাম্প্রদায়িকতা ও চলমান শাসক ও রাজনীতির বেহালদশা । ঘুরে-ফিরে বারে বারে গল্পের কলেবরে আমরা পেয়েছি আদর্শবাদী রাজনীতির পরিবর্তে পেশি শক্তির অশুভ ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী অপরাজনীতির ভয়াল চিত্র। বাঙ্গালি জাতির অতীত সময়ের দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের মত সংবেদনশীল পেক্ষাপটও সুন্দর সাবলীলতার ফ্রেমে শিল্পরস সৃষ্টিতে পিছপা হননি।
চন্দন আনোয়ার সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক আব্দুশ শাকুর বলেছিলেন-“ও বড় লেখক হতে পারবে, ওর মধ্যে সম্ভাবনা আছে।” তাঁর লেখা নিয়ে পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান বর্ষীয়ান কথাসাহিত্যিক সাধন চট্রোপাধ্যায় মনোভব ব্যক্ত করেছেন এভাবে,-“চন্দন আনোয়ার প্রায় সকল গল্পের শুরুতেই আখ্যানে চাপা একটি টেনশন তৈরি করে। কাহিনীর কোন ঘনঘটা থাকে না। পাঠককে টেনশনের সুতো ধরে ক্রমশ কোতুহলকে মেলাতে মেলাতে, শরীরের সম্প্রসারিত অংশ হয়ে ক্রমশ দেশ হয়ে ওঠে।” (কলকাতার একুশ শতক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত চন্দন আনোয়ারের ‘নির্বাচিত ৩০’ গ্রন্থের পাঠক্রিয়ার অভিজ্ঞতা) এবং তার গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘ উভয়বঙ্গের সাম্প্রতিক লেখালেখিতে এমন গল্পের তুলনা খুবই বিরল ।’ বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ড.মোহাম্মদ জয়নুদ্দিন, চন্দন আনোয়ারের লেখা নিয়ে বলেন,- “তার গল্প কেবল কল্পনার ফানুষ নয়, বাস্তবতার মাটি-রসে পুষ্ট নবতর সৃজনকর্ম । তিনি কেবল সাদামাটা ঘটনা বিস্তারে আগ্রহী নন, গদ্যের কৌশলী প্রয়োগে, শিল্পের বিশেষ মাধুর্যে তার গল্প হয় সফল শিল্প।”( চন্দন আনোয়ারের চর্চিত গল্পমালা )
চন্দন আনোয়ারের গল্পে উন্মেচিত জীবন সংকটের নিউক্লিয়ার প্রধানত ব্যক্তি-পারিবারিক, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নেতিবাচক অবক্ষয়। সমাজ-বাস্তবতার নগ্ন মুখোশ উন্মোচনে তিনি কখনো লুকোচুরি বা আপোশ করেনি। তাঁর গল্প বিশ্লেষণে পাঠক হিসেবে আমার চোখে এমনটিই ধরা পড়েছে । এবার আমরা তার প্রকাশিত কয়েকটি গল্পগ্রন্থের পাতায় ফিরে যায়।
চন্দন আনোয়ারের প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ, প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন। এখানে ৭টি গল্প স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘অসংখ্য চিৎকার’ নামকরণের মধ্যেই গল্পের আগাম সংকটের মেসেজ নিহিত। এখানে ১১টি গল্পের চিৎকার যেন বাঙালির গণমানুষের জীবনযন্ত্রণার এক অখণ্ড অভিশপ্ত চিৎকার। গল্পকারের গল্পের শরীর বেড়ে ওঠেছে জীবন বাস্তবতার জটিল-কঠিন সংকটকে ঘিরে। সে সংকট কখনো ঘণীভূত হয়েছে ব্যক্তি মানসে, কখনো সমাজে, কখনো রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে, আবার কখনো অতীত ও চলমান সভ্যতা ও সময়ে। গল্পে ধরা পড়েছে অর্থনৈতিক সংকট ,সেই সাথে সাংসারিক-পারিবারিক টানাপোড়ন ও নারীর যৌনজীবন।
চন্দন আনোয়ারের গল্পে নির্মিত চরিত্রে নানাবিধ সংকট চরম রূপ ধারণ করেছে। ব্যক্তির বিবেকবর্জন, নৈতিকতার অবক্ষয় গল্পের সর্বত্র বিরাজমান। নীতি-আদর্শ আর মূল্যবোধের পরাজয় মানুষকে ঠেলে দিয়েছে নির্মমতার দিকে। চরিত্রগুলোর এই সংকট পাঠককে অনায়াসে টেনে নিয়ে চলে গল্পের শেষাবধি। ব্যক্তি কখনো এতটাই সংকটে নিপতিত যে, পারিবারিক বন্ধনেও তারা ফিরতে পারেনি। পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা বৃদ্ধ বাবার মৃত্যু সংবাদ পেতে সর্বদা ব্যকুল। ব্যক্তিমানসের এই অবনতি ও বিচ্ছিন্নতাবোধ ব্যক্তিকে জর্জরিত করেছে মহা এক সংকটে। এভাবে ব্যক্তি জীবনের সংকট তাঁর গল্পের অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ধরা দিয়েছে। গল্পের সংকটাপন্ন চরিত্রগুলো সব সময় আবার সংকট উত্তরণে মরিয়াও থেকেছে। ছিন্নমূল টোকাই বা বস্তিবাসী থেকে উচ্চবিত্ত নারী-পুরুষও বাদ পড়েনি এই জীবন সংকটে। নির্মিত চরিত্রগুলির জীবন সংকট তিনি তুলে ধরেছেন স্ব-স্ব গন্ডিতে ও স্ব-স্ব ভাষায় বেরসিক বাক্যে- গল্পে নৈতিক অবক্ষয় কবলিত ‘আইনা’ রাগে ক্ষোভে রাজনীতিবিদ ‘মজা’ ভাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে ,-“খানকির পুতেরা এবার কুত্তাক্ষেপা ক্ষেপেছে।”(‘মা ও ককটেল বালকেরা )। এ ধারার গল্প ‘মা ও ককটেল বালকেরা’, ‘করোটির ছাদে গুলি’, ‘কাফন চোর’, ‘আমি কেউ নয়’, ‘দুই বিধবার নিশুতি রাত’, ‘আমাদের যুবক নেতা’ ‘ইচ্ছামৃত্যু’ প্রতিটি গল্পই ব্যক্তি-পরিবার-সংসার মাঝে মারাত্মক সংকটে জর্জরিত।
চন্দন আনোয়ার তাঁর গল্পে সমাজবাস্তবতার নগ্ন মুখোশ উন্মোচনে কখনো আপোস আর লুকোচুরি করেননি। চলমান সময়ের হাত ধরে সমাজকে তিনি অতি কাছ থেকে দেখেছেন। সামাজিক বিভিন্ন শাসন-শোষণ-নিপীড়ন ,অবিচার সমাজকে করে ফেলে বিতর্কিত ও কূলসিত। সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার না পেয়ে অনেক সময় সমাজকে নিশ্চিত সংকটের পথে যেতে বাধ্য করে। বঞ্চিত-নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষ হতাশায় নিপতিত হয়ে সবকিছুতে অনাস্থা আর সন্দেহ প্রকাশ করে। ‘মৃত্যু ও ঘুম’ গল্পে এরকম সামাজিক সংকটের শিকার অধ্যাপক আহম্মদ জামিলের কলেজ পড়ুয়া ছেলে ‘বিজয়’। সামাজিক বিশৃঙ্খলতা এমন নিরীহ প্রাণের বিনিময়ে সামাজিক অনাকাঙ্খিত দায় পরিশোধ করে। সমাজের উচু পর্যায়ের মানুষ কেমন করে নিজেদেরকে নোংরামির মধ্যে ডুবে থাকতে পারে তার জলন্ত প্রমাণ ‘বারবনিতা এসোসিয়েশন’ গল্পে। ‘লীলাবালা’বলে-“ এ শহরের একটাও মরদ নেই, সব নপুংসকের দল! এই শহরের আলো-বাতাস পর্যন্ত শালারা পেটে ঢুকিয়ে নপুংসক হয়ে গেছে। তুই আইছিস, দেখি তুই মরদ কি না?” এই যে সামাজিক অসংগতির ক্রাইসিস, সেটা রীতিমত গল্পে প্রবল হয়ে ওঠেছে। ‘বাড়ন্ত বালিকার ঘর সংসার’, ‘রুগ্নতার গলি ঘুপচি’, ‘মৃত্যু অথবা ঘুম’, ‘গ্যাংগ্রিন’ ‘স্কাইপ ও দুটি মৃত্যু’, ‘অন্তর্গত শূন্যতা’, ‘আমাদের যুবক নেতা’, ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ১৪২২’ এসব গল্পে সামাজিক পরিমণ্ডলের নানা সংকট উঠে আসে অবিকল-অকৃত্রিমভাবে। গল্পগুলো নিখাদ, বাস্তব ও জীবন্ত । চরিত্রগুলি মোড়কবিহীন করতে তাঁর বয়ান করতে হয়েছে রুচিহীন, অমার্জিত ও অশ্লীল। এ যেন লেখকের চেতনা ও অনুভবের বহুমাত্রিক সংকট উৎরানোর
ক্ষুদ্র প্রতিবাদ ও গভীর মনোবেদনার বহিঃপ্রকাশ। গল্প পাঠে দেখা যায় সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য, পতিতাবৃত্তি, নারীচেতনা, যৌনাচার, এরকম অসংখ্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকট সৃষ্টিতে লেখক চরম সিদ্ধহস্ত।
সময়ের পথপরিক্রমায় রাষ্ট্র-রাজনীতির ময়দানের সংঘটিত ও চলমান সংকট তাঁর গল্পের একান্ত অনুষঙ্গ। সেই সংকটের অন্যতম বিষয় হয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ের চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তির উত্থান ও মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অনেক গল্পে। আদর্শবাদী রাজনীতির নামে পেশিশক্তিময় ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাজনীতির বাস্তবচিত্র তাঁর গল্পে রূপায়ণ করেছেন। রাজনীতির আদর্শবিচ্যুতির পরিণামে ব্যক্তি ও সমাজ কীভাবে ভয়ংকর ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, সেই ভয়াবহতার শিল্পরূপ দিয়েছেন চন্দন। গল্পের লাইনে মুখোশপরা রাজনীতির ছবি স্পষ্ট-“সকালে এরাই মিছিল করবে- শিক্ষা- সন্ত্রাস একসাথে চলবে না! পিস্তল-কলম একসাথে চলবে না! বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্রি, উনসত্তর, একাত্তর, নব্বই। ওরা কারা আর এরা কারা? এত পতন! এত পচন! কারা করল এত বড় ক্ষতি? দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মেয়েটা কোথায় দাড়াবে?(গিরগিটি ও একজন মেয়ে) হিন্দু কবির লেখা বলে দেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের মত নগ্ন সাম্প্রদায়িক বীভৎসতা ‘কবি ও কাপালিক’ গল্পে সুন্দর-বাস্তবভাবে ধরা পড়েছে। রাষ্ট্র-রাজনীতির সংকট, নষ্টামি ও অধঃপতনের কূলষিত প্রভাব পড়েছে তাঁর অনেকগুলো গল্পে ‘গিরগিটি ও একজন মেয়ে’ ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ ‘পাঁচশ টাকার নোট’, ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ ‘মৃত্যু অথবা ঘুম’ ‘একটি পুকুর মরে যাচ্ছে’ ‘মা ও ককটেল বালকেরা’ ‘করোটির ছাদে গুলি’ ‘অসংখ্য চিৎকার’সহ আরো অনেক গল্পে। ‘করোটির ছাদে গুলি’ গল্পের সংলাপে দেখি- রাজনৈতিক নেতা আজাদ ভাই মকুকে বলে,-“পলিটিক্স মানে সিড়ি ভাঙ্গার খেলা ! বিশ্বাস-অবিশ্বাস,আশা-নিরাশার খেলা! লাভ-লোভের হিংসা-প্রতিহিংসার খেলা! ডিগবাজির খেলা! খেলা! মানুষ নিয়ে খেলা!” রাষ্ট্র-রাজনীতির সার্বিক অবক্ষয় স্বীকার করলেও লেখক বার বার ঘুরে-ফিরে সেই স্বাধীনতা বিরোধী সুবিধাবাদী একপেশে শ্লোগান থেকে বের হতে পারেনি। অথচ আজ আমরা স্বাধীনতার স্বপক্ষে দাঁড়িয়েই বারে বারে মানবতা, রাষ্ট্র- রাজনীতি ভুলণ্ঠিত করছি ,সেদিকে লেখকের কিছুটা কমই দৃষ্টি পড়েছে। সবকিছু মিলে তাঁর সকল গল্পের চরিত্র গুলোই অসম্ভব সংকটাপন্ন ও গতিময়।
বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈষম্য ও নগ্ন লাগামহীনতার কারণে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্র-রাজনীতিতে সর্বদা সংকট বিরাজমান, তা চন্দন আনোয়ার তাঁর গল্পে সুন্দর সাবলীলতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। নগরায়ণের কবলে কৃষক বঞ্চিত-সর্বশান্ত, অন্যদিকে আড়তদারদের বৈষম্যমূলক পুঁজিদখল, নৈতিক-চারিত্রিক স্খলন তাঁর গল্পে তীব্র প্রতিবাদমূখর হয়েছে ফুটে উঠেছে। ‘মতি পাইকারের প্রশ্নপত্র’ গল্পে ‘মতি’ সেই আবহমান বাংলার অবহেলিত কৃষক সমাজের প্রতিনিধি। ঋণের চাপে নিরন্তর মুক্তির পথখোঁজে ফিরে হারাতে হয় তার সর্বস্ব। মতি পাইকারের উন্মাদের সেই করুণ-মর্মস্পর্শী গল্পের মাধ্যমে লেখক পুঁজিপতিদের সমূলে আঘাত করেছে। মতি পাইকার প্রলাপ বকে যায়- “যাইবো না ! যাইবো না। একটা মালও ঢাকা যাইবো না। খা দেহি! কোটি শুয়োরের পাল! খা দেহি! অহন আমার বাড়াটা খা তোরা ( মতি পাইকারের প্রশ্নপত্র )। অর্থের লোভে ও অভাবে মানুষের নীতি- নৈতিকতা ,চরিত্র ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটে, সেই সংকটময়তা তাঁর গল্পে সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। ‘আমি কেউ নই’ গল্পে শফিকের বউয়ের যে চারিত্রিক স্খলন তা এই অর্থকেন্দ্রিকই। ‘পাঁচ শ টাকার নোট’ গল্পে পাঁচশ টাকার কড়কড়ে নোটের কাছে নিজের দেহকে সমর্পণ যে রীতিমত অবক্ষয় তা আর পাঠকের বুঝতে বাকী থাকে না। এছাড়া ‘মা ও ককটেল বালকেরা’, ও ‘করোটির ছাদে গুলি’ এসব গল্পেও অর্থের প্রভাবে অথবা অর্থের অভাবে গল্পের চরিত্ররা জীবন বাস্তবতার কঠিন সংকটে নিপতিত ।
চন্দন আনোয়ারের গল্পে সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, দূর্নীতি, সন্ত্রাস, বিবেকহীনতা, অপশাসন-নির্যাতন, বিভিন্ন বিচার প্রক্রিয়া, নারী-পুরুষের মনস্তত্ত্ব, প্রেম বাস্তবতা, মানুষের সুখ-স্বপ্ন, আশা-নিরাশাসহ চলমান নানা অসংগতির জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। মানুষের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় গল্পকারের হৃদয়ে ভীষণ পীড়া-যন্ত্রণা আর দীর্ঘনিঃশ্বাস বাড়িয়ে তোলে । মানুষ-সমাজ-দেশ-সভ্যতার এই রুগ্ন-পচনদশা তাঁর অন্তরে তীর হয়ে গেঁথে যায়। তাই তাঁর কলম হয়ে ওঠে লাগামহীন-বেসামাল। লেখক নিজেই বলেছেন,- “ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি কিছু করতে পারছি না,কিন্তু প্রতিবাদ তো জানিয়ে রাখতে পারি।” গল্পকারের নিজস্ব অভিব্যক্তি-“ এসব যদি আমার গল্পের বিষয় না করি তবে কী করে জীবনের দায় শোধ হবে ( একান্ত সাক্ষাৎকার)
চন্দন আনোয়ারের প্রায়ই সকল গল্পই জীবন বাস্তবতার কঠিন সংকটে ভরপূর। সে সংকটে কখনো জর্জরিত হয়েছে মানুষ, আবার কখনো সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি। আর অধিকাংশ গল্পেই এই সংকটের চরম খেসারত দিতে হয়েছে নারীকে। তাঁর নির্মিত নারী চরিত্রগুলি জৈবিকতার পরশে তেমনটি সবল, ব্যক্তিত্বময় ও আদর্শায়িত হতে পারেনি। তবে নারীর জৈবিকতার সাথে সকল সংকটকে লেখক একীভূত করে গল্পগুলো পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। তাঁর গল্পের এই উন্মোচিত জীবন সংকট আমি পাঠক হিসেবে কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনি। এমনকি গল্পগুলো আমার প্রচণ্ড ভাল লাগলেও আমি আমার পরিবারের স্ত্রী- কন্যাদের সাথে নিয়ে আলোচনা পর্যন্ত করতে পারেনি। আমার স্ত্রী-কন্যারা যেই এই গল্পের পাতায় চোখ বুলাতে গেছে, তখনই আমি অন্য কাজের ছল করে বইয়ের পাতা বন্ধ করে রেখেছি। এখানে পাঠক হিসেবে আমাকেও কঠিন সংকটে পড়তে হয়েছে। যদিও লেখক তাঁর গল্পে বাস্তবতার বাইরে অতিরঞ্জিত কিছু লেখেননি, তারপরেও গল্পে কিছু ক্ষেত্রে তাঁর লিপিবদ্ধ শব্দচয়ন, বাক্যপ্রয়োগ এতটাই বাস্তব, খোলামেলা ও জীবন্ত করেছে যা অপরিণত ও নতুন পাঠকের কাছে বেমানান, রুচিহীন ও সংকট মনে হতেই পারে। এক্ষেত্রে লেখক আমার ক্ষুদ্র পাঠকের চিন্তায় সার্বজনীন পাঠকের দরবারে তার গল্প মেলে ধরতেও সংকটে পড়েছে। তবে হ্যাঁ, তাঁর গল্পে মানবজীবনের নিরন্তর যে অন্তর্দহন, অসামঞ্জস্যতা রয়েছে তা গল্পকারকে পৌছে দিয়েছে সংকট উত্তরণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিবাচক প্রত্যয়ের সুযোগ্য অবস্থানে। গল্প নির্মাণে চন্দন আনোয়ার জীবন-সংসারের অনিবার্য দুর্দান্ত সংকট ও সত্যকে আপন চেতনায় ধারণ করে এক অনাবিল শিল্পমহিমা মাখিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়েছে এ সংসারেরই অন্দরমহলে । এক্ষেত্রে তিনি অসম্ভব দক্ষতা ও বিচক্ষণতা পরিচয় দিয়েছেন।
বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর


























