মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে জনতা ব্যাংক লিমিটেড। সকল সংকটকে পেছনে ফেলে এখন ব্যাংকটির লক্ষ্য শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। লক্ষ্য নিজেকে ‘জনতার ব্যাংকে’ পরিণত করা; দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা।
গত চার বছর ধরে আর্থিক শৃংখলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক সময়ে নানা সংকটে জর্জরিত জনতা ব্যাংক। এর ফলও মিলেছে দ্রুত। ২০২০ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক এখন দেশের লাখ কোটি টাকা সম্পদের অধিকারী ৪টি ব্যাংকের একটি।
বিগত বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি বড় আর্থিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে ব্যাংকটি। পূর্বের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার কারণে অনেকগুলো বড় ঋণ যুক্ত হয়েছে খেলাপির খাতায়। এ নিয়ে ব্যাংকটি ঘিরে সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু সব আলোচনা-সমালোচনাকে পেছনে ফেলে এখন স্বমহিমায় ভাস্বর জনতা ব্যাংক। বঙ্গবন্ধু যে উদ্দেশে ব্যাংকটির নামকরণ করেছিলেন ‘জনতা’, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নই এখন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, পর্ষদ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্রত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডকে জাতীয়করণের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল জনতা ব্যাংক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে এই ব্যাংকটির নামকরণ করেছিলেন ‘জনতা’। তিনি চেয়েছিলেন এই ব্যাংকটি হবে গণমানুষের ব্যাংক।
গতবছর করোনা মহামারির মাঝে যখন সারা বিশ্বের আর্থিক খাতে স্থবিরতা নেমেছে সেখানে জনতা ব্যাংকের মোট সম্পদ ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকটির প্রায় সবক’টি সূচকেই হয়েছে দৃশ্যমান উন্নতি। ২০২০ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০১৭ সালেও ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সাল শেষে ৬০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকটির এডি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। এছাড়া ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে জনতা ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ এডি রেশিও বা আমানত ঋণ অনুপাত জনতা ব্যাংকের। অর্থাৎ ব্যাংকটির অধিকাংশ অর্থই উৎপাদনশীল ভূমিকায় রয়েছে।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। প্রয়োজন অনুযায়ী পুরো অর্থই মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকটি। নগদ আদায়েও সাফল্য দেখিয়েছে জনতা। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মাঝেও ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ১৭৮ কোটি টাকা নগদ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। একই সময়ে অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব থেকেও ৪৭ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এর একটি বড় অংশই দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বিসমিল্লাহ গ্রুপের টাকা। অবলোপনকৃত ঋণের টাকা আদায় নিঃসন্দেহে ব্যাংকটির কর্মীবাহিনীর বড় সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হবে।
নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের ফলে ২০২০ সালে দেশের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের বিপর্যয় হলেও বৈদেশিক বাণিজ্যে সাফল্যের দৃষ্টান্ত জনতা ব্যাংক। ২০২০ সালে ব্যাংকটির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ১৮ হাজার ৬২৮ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা। একই সময়ে ব্যাংকটির মাধ্যমে ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা রফতানি হয়েছে। বিদায়ী বছরে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসীরা ৭ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন যা ব্যাংকটিকে রেমিট্যান্স আহরণে অন্যতম শীর্ষ ব্যাংকে পরিণত করেছে।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে জনতা ব্যাংক নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো ধরনের ফি ও চার্জ ছাড়াই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও কার্যপরিধি বিস্তৃত করেছে জনতা ব্যাংক। গ্রাহকদের রিয়েলটাইম ব্যাংকিং সেবা দিতে সব শাখা অনলাইনের আওতায় আনা হয়েছে অনেক আগেই।
বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আদায়ে বছরভিত্তিক অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে ঋণ আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন কর্মকর্তারা। শীর্ষ ২০ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য টাস্কফোর্স কমিটি করা হয়েছে। সব বিভাগীয় কার্যালয়, এরিয়া অফিস ও শাখা পর্যায়ে খেলাপিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ঋণ আদায় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
যেসব শাখায় ১০ কোটি বা তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলোতে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে রিলেশনশিপ ম্যানেজার নিযুক্ত করে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনজীবীদের সঙ্গে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ফলোআপ মিটিং করছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশে জনতা ব্যাংকই প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেটি অ্যাকাউন্ট ছাড়াই গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবা প্রদানে সক্ষম। নিজস্ব জনবল দ্বারা জেবিপিন ক্যাশ নামে একটি ওয়েববেইজড সফটওয়্যার তৈরি করেছে ব্যাংকটি।
প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের বাইরে গিয়ে কাজ করছে জনতা। নতুন নতুন খাতে ঋণ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যেভাবে সুশৃংখল উদ্ভাবনী ব্যাংকিং পরিচালনা করছেন এবং পর্ষদ যেভাবে ইতিবাচক নীতিসহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তা নিরবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকলে অচিরেই আর্থিক খাতের মধ্যে আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে জনতা ব্যাংক।
বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর


























