০৪:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য বাংলাদেশ নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে -অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার

অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার। ছবি: মো. আবদুল্লাহ আল মামুন

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে আজকের বিজনেস বাংলাদেশ-কে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিএসএমএমইউ’র সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই প্রখ্যাত চিকিৎসক কথা বলেছেন জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার গোড়াপত্তন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা বিনির্মাণে সফল অগ্রযাত্রা ও আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে। সোনার বাংলা বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে দিয়েছেন গভীর দিকনির্দেশনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরাধ্য সোনার বাংলা নির্মাণে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার। তিনি বলেছেন, সোনার বাংলা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি এটা সত্য। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নত হয়েছে, কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব হয়েছে, শিল্প উৎপাদন বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। এই সূচকগুলো নির্দেশ করে যে সোনার বাংলা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সোনার বাংলা আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা তৈরি করতে আজকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকলকে কাজ করতে হবে। প্রত্যেককে যার যার অবস্থানে থেকে নিবেদিতভাবে কাজ করতে হবে। যার যেই যোগ্যতা আছে দেশ নির্মাণে সেই যোগ্যতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ অবদান রাখতে হবে। কূপমন্ডুকতা থেকে আমাদের বেড়িয়ে যেতে হবে। উদার চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে।

চিকিৎসা সেবার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেছেন, চিকিৎসা সেবার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়, আন্তরিক এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ করেছিলেন। সকল মানুষের জন্য ন্যূনতম চিকিৎসাসেবার লক্ষ্য ছিলো বঙ্গবন্ধুর সদ্য স্বাধীন দেশেই। তিনি প্রতিটি থানায় ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ স্থাপন করেন। থানা পর্যায়ে মেডিক্যাল অফিসার ও বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাস্থ্য খাতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকাতার প্রমাণ হলো তিনি চিকিৎসকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা থেকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করেছিলেন। প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করার লক্ষ্য কেবল বেতন বাড়ানো ছিলো না, বরং চিকিৎসকদেরকে একটি সন্তোষজন স্থান দেওয়া। পাশাপশি তিনি নার্সদের বেতন বাড়িয়েছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করেছেন। এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহকারি পদ সৃষ্টি করেছেন। সন্তান অসুস্থ হলে পিতা যেমন তার সেবার বিষয়টি চিন্তা করেন, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু মানুষের চিকিৎসার বিষয়টি চিন্তা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, চিকিৎসকদেরকে সেবক হিসেবে কাজ করতে। এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ কবজের উপর নির্ভরশীল ছিলো। তারা আধুনিক চিকিৎসা সেবা পায়নি। সেখানে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পণ্য হিসেবে চিকিৎসা সেবাকে নিলে হবে না। সেবা এবং সেবকের মনবৃত্তি নিয়ে কল্যাণের কাজ হিসেবে নিতে হবে। একজন চিকিৎসক একটি সার্টিফিকেট অর্জন করলেন এটা বিক্রি করে ব্যবসা করবেন, এটা হবে না। এটা কোনও পুঁজি নয়। এ কথাটি বঙ্গবন্ধু বারবার চিকিৎসক সমাজকে স্মরণ করিয়েছেন। স্বধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি এমন সময় তাঁরই কন্যা সরকারপ্রধানের আসনে বসে আছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর মত হৃদয় দিয়ে মানুষকে ভালোবাসেন। তিনি যেমনভাবে দেশের উন্নয়ন, শিক্ষা, ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রত্যাশা করেন ঠিক তেমনিভাবেই প্রতিটি মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চান। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি তিনি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রেরণ করেছেন। প্রায় ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক যেখানে অগ্রাধিকারভিত্তিতে তিনি মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করেছেন। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের এ বিষয়গুলি বঙ্গবন্ধু কন্যা নিশ্চিত করেছেন। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবাও রয়েছে। আমাদেরকে সব খাত এগিয়ে নেবার সঙ্গে চিকিৎসা সেবাকেও সমনা তালে এগিয়ে নিতে হবে। একজন কৃষক, শ্রমিক-বৃদ্ধ সবার স্বাস্থ্যসেবার দিকে সমান ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা কি স্বাস্থ্যখাতে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি – এমন প্রশ্নের জবাবে খ্যাতনামা এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জিত না হলেও এই সময়ে আমরা যথেষ্ট অর্জন করেছি বলে মনে করি। বাংলাদেশে আমাদের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭২ বছর। অথচ যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন গড় আয়ু ছিলো ৩৬ বছর। দ্বিগুনের মত গড় আয়ু বৃদ্ধি স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন না হলে সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি স্বাস্থ্য খাতের বাজেটও বৃদ্ধি করেছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাঁর কন্যাও তেমনি নার্সদেরকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করেছেন। কারণ তারাও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। চিকিৎসা সেবায় বঙ্গবন্ধুর অবদান তুলে ধরে ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, বঙ্গবন্ধু চিকিৎসকদের চাকরিকে যেমন জাতীয়করণ করেছিলেন, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষ যাতে ওষুধ পায় সেজন্য ওষুধের পরিত্যাক্ত কারখানাগুলো চালু করেছিলেন এবং ওষুধ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। শহর এবং গ্রামে বিভিন্ন হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুতো দীর্ঘদিন ধরে এই ভূখণ্ডের মানুষের চিকিৎসার বঞ্চনা দেখেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, গ্রামে যদি আমি চিকিৎসকদের না রাখতে পারি, তাহলে গ্রামের মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাবে না। তিনি চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেছেন, “আপনারা মনে রাখবেন, আপনারা সাধারণ মানুষের অর্থে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হয়েছেনে। তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আপনাদের গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।” বঙ্গবন্ধু এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কিছু বিধিবিধানও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাতবরন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলার মানুষ অনেক আগেই ন্যূনতম চিকিৎসা সেবাটি পেতেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও বাংলার প্রতিটি মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায়ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিপুল বিনিয়োগ করছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামনের দিনে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও উন্নত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই প্রখ্যাত শিক্ষক বলেন, চিকিৎসার উচ্চতর গবেষণার বিষয় যদি বলি, এক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর বিরাট অবদান। চিকিৎসা গবেষণার জন্য বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শাহবাগ হোটেলে আইপিজিএমআর প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উচ্চতর গবেষণার সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য আইপিজিএমআর’কে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেছেন। আমরা হয়তো চিকিৎসা সেবার আরাধ্য জায়গায় পৌঁছতে পারিনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তাহলে বাংলাদেশে কী রোগ হয়, কীরকম রোগ হয়, সেই রোগটি মানুষের মধ্যে কীরকম ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন তৈরি করে, কি প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন হয়, তার জন্য কি ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে – এই বিষয়গুলোতে যদি বাংলাদেশের নিজস্ব তথ্য-উপাত্ত না থাকে, সেটি যদি আমাদের চিকিৎসকগণ সম্যকভাবে না জানেন, তাহলে দেশের মানুষের উপযোগী সেবামূলক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এজন্যই জাতির পিতা চিকিৎসা নিয়ে উচ্চতর গবেষণার ওপর অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পঙ্গু হাসপাতাল নির্মাণ, ডায়বেটিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতাল নির্মাণে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছিলেন। সদ্যস্বাধীন দেশের সীমিত বাজেট দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার যতটুকু উন্নয়ন করা যায় তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের অনেক অনেক সাফল্য রয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ একটি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরন হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে সেটি বিশ্বের সকল নেতৃবৃন্দই স্বীকার করছেন এবং তাদের বক্তব্যেও তা বার বার বলছেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দিয়ে ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অঙ্গীকার ছিল, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছিলেন ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কোটি কোটি মানুষ কষ্ট স্বীকার করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। সেই শহীদদের ত্যাগের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের যে অবদান, সেগুলো যদি আমরা স্মরণ রাখি তাহলে আমাদের অবশ্যই ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। চিকিৎসা একটি সেবামূলক পেশা। এখানে ব্যবসার কোনও সুযোগ নেই। রাষ্ট্র চিকিৎসার জন্য যতটুকু ব্যয় করতে এটা জনগণের অর্থ। সুতরাং জনগণের অর্থে যে চিকিৎসা হবে সেটা হবে কল্যাণধর্মী চিকিৎসা। বঙ্গবন্ধুর নামে যে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (বিএসএমএমইউ) এটাকে অবশ্যই হতে হবে ‘ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলফেয়ার’। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই এখানকার চিকিৎসকদের কাজ করতে হবে; এর কোন বিকল্প নেই।

স্বাধীনতার ৫০ দশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে – এমন প্রশ্নের জবাবে এই সমাজসচেতন চিকিৎসক বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমি কতগুলো বিষয়ে খুব সাফল্য রয়েছে বলে মনে করি। পাকিস্তান আমলে এই ভূখন্ডে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া কঠিন ছিল। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত গাওয়া কঠিন ছিল। পহেলা বৈশাখ উদযাপন সহ বাঙালির আবহমান যেসব সাংস্কৃতিক চর্চা, সেই চর্চা অবাধে করার সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, এখানে উদার সংস্কৃতির চর্চা করা যাবে না; বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় কাজ করা যাবে না। এখানে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক চেতনার যেসব কর্মকান্ড পরিচালিত হতো সেটি পঁচাত্তরের পর আমরা দীর্ঘদিন দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর ক্ষমতায় আসার ফলে আমরা হাটি হাটি পা পা করে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় আবার দেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশের শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীÑ সকলেই মুক্ত চিন্তা করার সুযোগ লাভ করছে এবং উদার জাতীয়তাবাদী চেতনায় আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। কিন্তু সোনার বাংলা নির্মাণের জন্য আমাদের আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে; আরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। গোজামিলের চেতনায় কিন্তু মহৎ জিনিস অর্জন করা সম্ভব নয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেতনভূক্ত ছিলেন না; তাঁরা নিয়মিত সৈনিকও ছিলেন না। তাঁরা দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। একইভাবে আপনি যদি শুধু বেতনভূক্ত কর্মচারীর মতো কাজ করেন – এটা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও সত্য, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও সত্য, সরকারি আমলাদের ক্ষেত্রেও সত্য, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সত্য – তাহলে দেশ গড়ে তোলা যাবে না। এই দেশ গড়ে তুলতে হবে; আর এজন্য আপনাকে ত্যাগের মনোভাব অর্জন করতে হবে, আদর্শবান হতে হবে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য বলেছিলেন ‘আমার সোনার ছেলে লাগবে’। সেই সোনার ছেলে কী করে হবে যদি আপনার মনের মধ্যে ত্যাগের মনোবৃত্তি না থাকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আপনাকে সবসময় তাড়িত না করে! প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে আপনি যদি সেই প্রেরণা অনুভব না করেন তাহলে সোনার বাংলা বিনির্মাণ করা সম্ভব নয়।

একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি হিসেবে আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান – এমন প্রশ্নের জবাবে এই স্বনামধন্য চিকিৎসা গবেষক বলেন, আমি আগামীর বাংলাদেশকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাই। আজ সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, কানাডা, জাপান মানবিক সমৃদ্ধির জায়গাতে যেখানে পৌঁছেছে বাংলাদেশকে সেখানে দেখতে চাই। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় শুধু ৭০ হাজার মার্কিন ডলার হলে হবে না, বাংলার মানুষকে সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হতে হবে। আরেকজনেরটা লুট করতে হবে, চুরি করে ভাত খেতে হবেÑ এই বাংলাদেশ দরকার নেই। আগামীর বাংলাদেশ হবে সৎ-মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ হতে হবে রুচীবোধসম্পন্ন মানুষের বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ সংস্কৃতির চেতনায় পরিপুষ্ট মানুষের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে রাস্তায় লক্ষ টাকা পড়ে থাকলেও মানুষ নেবে না। যে বাংলাদেশে চুরি হবে না, রাহাজানি হবে না, মেয়েরা প্রয়োজনে রাস্তায় রাত ১২টায়ও ঘুরে বেড়াতে পারবে নির্দ্বিধায়, কোন অসামাজিক কর্মকাণ্ড যে বাংলাদেশে হবেনা। এই জায়গাটা আমরা চাই। সেজন্যইতো মুক্তিযুদ্ধ। এমন বাংলাদেশ বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে উচ্চ মানবিক বোধসম্পন্ন এই চিকিৎসক বলেন, এমন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের কাছে ফিরে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেমন মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর লোভ ত্যাগ করেছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য – আমাদেরকেও তেমনিভাবে লোভ ত্যাগ করতে হবে; আমাদেরকে ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ কেন এক হতে পারছেন না – এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, এটি আমাদের একটি সামাজিক দৈনতা। এটা একটি সামাজিক সংকট। সামাজিক সংকট এ কারণে, বাংলাদেশ শত শত বছর বিজাতীয়দের দ্বারা শাসিত হয়েছে। যে কারণে বাঙালির মধ্যে মজ্জাগত একটি পশ্চাদপদতা রয়েছে। দেশ শাসন করতে হলে, দেশ গড়ে তুলতে হলে যে উদার মানবিক মন লাগে, নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে যে নিজের শ্রমের ওপর নির্ভর করতে হবেÑ এই চেতনা বাঙালি ভুলে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জাতিকে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ফিরিয়ে নিয়ে আসা সেই চেতনাটা আমাদের শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী সমাজকে ঠিকমতো উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। বুদ্ধিজীবী সমাজকে, শিক্ষিত সমাজকে সৎ হতে হবে, ন্যায়পরায়ণ হতে হবে, মানবিক হতে হবে, দেশের প্রতি মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকতে হবে, কর্মের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের ঋণ শোধ করতে হবে।

ট্যাগ :

পরশুরামে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদ্বোধনে আলোচনা, র‍্যালি ও পোনা অবমুক্ত

বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য বাংলাদেশ নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে -অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার

প্রকাশিত : ০১:০২:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ মার্চ ২০২১

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে আজকের বিজনেস বাংলাদেশ-কে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিএসএমএমইউ’র সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই প্রখ্যাত চিকিৎসক কথা বলেছেন জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার গোড়াপত্তন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা বিনির্মাণে সফল অগ্রযাত্রা ও আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে। সোনার বাংলা বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে দিয়েছেন গভীর দিকনির্দেশনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরাধ্য সোনার বাংলা নির্মাণে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার। তিনি বলেছেন, সোনার বাংলা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি এটা সত্য। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নত হয়েছে, কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব হয়েছে, শিল্প উৎপাদন বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। এই সূচকগুলো নির্দেশ করে যে সোনার বাংলা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সোনার বাংলা আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা তৈরি করতে আজকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকলকে কাজ করতে হবে। প্রত্যেককে যার যার অবস্থানে থেকে নিবেদিতভাবে কাজ করতে হবে। যার যেই যোগ্যতা আছে দেশ নির্মাণে সেই যোগ্যতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ অবদান রাখতে হবে। কূপমন্ডুকতা থেকে আমাদের বেড়িয়ে যেতে হবে। উদার চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে।

চিকিৎসা সেবার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেছেন, চিকিৎসা সেবার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়, আন্তরিক এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ করেছিলেন। সকল মানুষের জন্য ন্যূনতম চিকিৎসাসেবার লক্ষ্য ছিলো বঙ্গবন্ধুর সদ্য স্বাধীন দেশেই। তিনি প্রতিটি থানায় ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ স্থাপন করেন। থানা পর্যায়ে মেডিক্যাল অফিসার ও বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাস্থ্য খাতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকাতার প্রমাণ হলো তিনি চিকিৎসকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা থেকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করেছিলেন। প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করার লক্ষ্য কেবল বেতন বাড়ানো ছিলো না, বরং চিকিৎসকদেরকে একটি সন্তোষজন স্থান দেওয়া। পাশাপশি তিনি নার্সদের বেতন বাড়িয়েছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করেছেন। এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহকারি পদ সৃষ্টি করেছেন। সন্তান অসুস্থ হলে পিতা যেমন তার সেবার বিষয়টি চিন্তা করেন, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু মানুষের চিকিৎসার বিষয়টি চিন্তা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, চিকিৎসকদেরকে সেবক হিসেবে কাজ করতে। এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ কবজের উপর নির্ভরশীল ছিলো। তারা আধুনিক চিকিৎসা সেবা পায়নি। সেখানে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পণ্য হিসেবে চিকিৎসা সেবাকে নিলে হবে না। সেবা এবং সেবকের মনবৃত্তি নিয়ে কল্যাণের কাজ হিসেবে নিতে হবে। একজন চিকিৎসক একটি সার্টিফিকেট অর্জন করলেন এটা বিক্রি করে ব্যবসা করবেন, এটা হবে না। এটা কোনও পুঁজি নয়। এ কথাটি বঙ্গবন্ধু বারবার চিকিৎসক সমাজকে স্মরণ করিয়েছেন। স্বধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি এমন সময় তাঁরই কন্যা সরকারপ্রধানের আসনে বসে আছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর মত হৃদয় দিয়ে মানুষকে ভালোবাসেন। তিনি যেমনভাবে দেশের উন্নয়ন, শিক্ষা, ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রত্যাশা করেন ঠিক তেমনিভাবেই প্রতিটি মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চান। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি তিনি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রেরণ করেছেন। প্রায় ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক যেখানে অগ্রাধিকারভিত্তিতে তিনি মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করেছেন। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের এ বিষয়গুলি বঙ্গবন্ধু কন্যা নিশ্চিত করেছেন। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবাও রয়েছে। আমাদেরকে সব খাত এগিয়ে নেবার সঙ্গে চিকিৎসা সেবাকেও সমনা তালে এগিয়ে নিতে হবে। একজন কৃষক, শ্রমিক-বৃদ্ধ সবার স্বাস্থ্যসেবার দিকে সমান ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা কি স্বাস্থ্যখাতে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি – এমন প্রশ্নের জবাবে খ্যাতনামা এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জিত না হলেও এই সময়ে আমরা যথেষ্ট অর্জন করেছি বলে মনে করি। বাংলাদেশে আমাদের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭২ বছর। অথচ যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন গড় আয়ু ছিলো ৩৬ বছর। দ্বিগুনের মত গড় আয়ু বৃদ্ধি স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন না হলে সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি স্বাস্থ্য খাতের বাজেটও বৃদ্ধি করেছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাঁর কন্যাও তেমনি নার্সদেরকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করেছেন। কারণ তারাও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। চিকিৎসা সেবায় বঙ্গবন্ধুর অবদান তুলে ধরে ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, বঙ্গবন্ধু চিকিৎসকদের চাকরিকে যেমন জাতীয়করণ করেছিলেন, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষ যাতে ওষুধ পায় সেজন্য ওষুধের পরিত্যাক্ত কারখানাগুলো চালু করেছিলেন এবং ওষুধ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। শহর এবং গ্রামে বিভিন্ন হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুতো দীর্ঘদিন ধরে এই ভূখণ্ডের মানুষের চিকিৎসার বঞ্চনা দেখেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, গ্রামে যদি আমি চিকিৎসকদের না রাখতে পারি, তাহলে গ্রামের মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাবে না। তিনি চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেছেন, “আপনারা মনে রাখবেন, আপনারা সাধারণ মানুষের অর্থে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হয়েছেনে। তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আপনাদের গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।” বঙ্গবন্ধু এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কিছু বিধিবিধানও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাতবরন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলার মানুষ অনেক আগেই ন্যূনতম চিকিৎসা সেবাটি পেতেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও বাংলার প্রতিটি মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায়ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিপুল বিনিয়োগ করছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামনের দিনে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও উন্নত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই প্রখ্যাত শিক্ষক বলেন, চিকিৎসার উচ্চতর গবেষণার বিষয় যদি বলি, এক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর বিরাট অবদান। চিকিৎসা গবেষণার জন্য বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শাহবাগ হোটেলে আইপিজিএমআর প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উচ্চতর গবেষণার সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য আইপিজিএমআর’কে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেছেন। আমরা হয়তো চিকিৎসা সেবার আরাধ্য জায়গায় পৌঁছতে পারিনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তাহলে বাংলাদেশে কী রোগ হয়, কীরকম রোগ হয়, সেই রোগটি মানুষের মধ্যে কীরকম ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন তৈরি করে, কি প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন হয়, তার জন্য কি ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে – এই বিষয়গুলোতে যদি বাংলাদেশের নিজস্ব তথ্য-উপাত্ত না থাকে, সেটি যদি আমাদের চিকিৎসকগণ সম্যকভাবে না জানেন, তাহলে দেশের মানুষের উপযোগী সেবামূলক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এজন্যই জাতির পিতা চিকিৎসা নিয়ে উচ্চতর গবেষণার ওপর অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পঙ্গু হাসপাতাল নির্মাণ, ডায়বেটিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতাল নির্মাণে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছিলেন। সদ্যস্বাধীন দেশের সীমিত বাজেট দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার যতটুকু উন্নয়ন করা যায় তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের অনেক অনেক সাফল্য রয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ একটি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরন হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে সেটি বিশ্বের সকল নেতৃবৃন্দই স্বীকার করছেন এবং তাদের বক্তব্যেও তা বার বার বলছেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দিয়ে ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অঙ্গীকার ছিল, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছিলেন ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কোটি কোটি মানুষ কষ্ট স্বীকার করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। সেই শহীদদের ত্যাগের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের যে অবদান, সেগুলো যদি আমরা স্মরণ রাখি তাহলে আমাদের অবশ্যই ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। চিকিৎসা একটি সেবামূলক পেশা। এখানে ব্যবসার কোনও সুযোগ নেই। রাষ্ট্র চিকিৎসার জন্য যতটুকু ব্যয় করতে এটা জনগণের অর্থ। সুতরাং জনগণের অর্থে যে চিকিৎসা হবে সেটা হবে কল্যাণধর্মী চিকিৎসা। বঙ্গবন্ধুর নামে যে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (বিএসএমএমইউ) এটাকে অবশ্যই হতে হবে ‘ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলফেয়ার’। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই এখানকার চিকিৎসকদের কাজ করতে হবে; এর কোন বিকল্প নেই।

স্বাধীনতার ৫০ দশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে – এমন প্রশ্নের জবাবে এই সমাজসচেতন চিকিৎসক বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমি কতগুলো বিষয়ে খুব সাফল্য রয়েছে বলে মনে করি। পাকিস্তান আমলে এই ভূখন্ডে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া কঠিন ছিল। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত গাওয়া কঠিন ছিল। পহেলা বৈশাখ উদযাপন সহ বাঙালির আবহমান যেসব সাংস্কৃতিক চর্চা, সেই চর্চা অবাধে করার সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, এখানে উদার সংস্কৃতির চর্চা করা যাবে না; বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় কাজ করা যাবে না। এখানে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক চেতনার যেসব কর্মকান্ড পরিচালিত হতো সেটি পঁচাত্তরের পর আমরা দীর্ঘদিন দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর ক্ষমতায় আসার ফলে আমরা হাটি হাটি পা পা করে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় আবার দেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশের শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীÑ সকলেই মুক্ত চিন্তা করার সুযোগ লাভ করছে এবং উদার জাতীয়তাবাদী চেতনায় আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। কিন্তু সোনার বাংলা নির্মাণের জন্য আমাদের আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে; আরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। গোজামিলের চেতনায় কিন্তু মহৎ জিনিস অর্জন করা সম্ভব নয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেতনভূক্ত ছিলেন না; তাঁরা নিয়মিত সৈনিকও ছিলেন না। তাঁরা দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। একইভাবে আপনি যদি শুধু বেতনভূক্ত কর্মচারীর মতো কাজ করেন – এটা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও সত্য, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও সত্য, সরকারি আমলাদের ক্ষেত্রেও সত্য, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সত্য – তাহলে দেশ গড়ে তোলা যাবে না। এই দেশ গড়ে তুলতে হবে; আর এজন্য আপনাকে ত্যাগের মনোভাব অর্জন করতে হবে, আদর্শবান হতে হবে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য বলেছিলেন ‘আমার সোনার ছেলে লাগবে’। সেই সোনার ছেলে কী করে হবে যদি আপনার মনের মধ্যে ত্যাগের মনোবৃত্তি না থাকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আপনাকে সবসময় তাড়িত না করে! প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে আপনি যদি সেই প্রেরণা অনুভব না করেন তাহলে সোনার বাংলা বিনির্মাণ করা সম্ভব নয়।

একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি হিসেবে আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান – এমন প্রশ্নের জবাবে এই স্বনামধন্য চিকিৎসা গবেষক বলেন, আমি আগামীর বাংলাদেশকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাই। আজ সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, কানাডা, জাপান মানবিক সমৃদ্ধির জায়গাতে যেখানে পৌঁছেছে বাংলাদেশকে সেখানে দেখতে চাই। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় শুধু ৭০ হাজার মার্কিন ডলার হলে হবে না, বাংলার মানুষকে সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হতে হবে। আরেকজনেরটা লুট করতে হবে, চুরি করে ভাত খেতে হবেÑ এই বাংলাদেশ দরকার নেই। আগামীর বাংলাদেশ হবে সৎ-মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ হতে হবে রুচীবোধসম্পন্ন মানুষের বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ সংস্কৃতির চেতনায় পরিপুষ্ট মানুষের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে রাস্তায় লক্ষ টাকা পড়ে থাকলেও মানুষ নেবে না। যে বাংলাদেশে চুরি হবে না, রাহাজানি হবে না, মেয়েরা প্রয়োজনে রাস্তায় রাত ১২টায়ও ঘুরে বেড়াতে পারবে নির্দ্বিধায়, কোন অসামাজিক কর্মকাণ্ড যে বাংলাদেশে হবেনা। এই জায়গাটা আমরা চাই। সেজন্যইতো মুক্তিযুদ্ধ। এমন বাংলাদেশ বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে উচ্চ মানবিক বোধসম্পন্ন এই চিকিৎসক বলেন, এমন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের কাছে ফিরে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেমন মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর লোভ ত্যাগ করেছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য – আমাদেরকেও তেমনিভাবে লোভ ত্যাগ করতে হবে; আমাদেরকে ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ কেন এক হতে পারছেন না – এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, এটি আমাদের একটি সামাজিক দৈনতা। এটা একটি সামাজিক সংকট। সামাজিক সংকট এ কারণে, বাংলাদেশ শত শত বছর বিজাতীয়দের দ্বারা শাসিত হয়েছে। যে কারণে বাঙালির মধ্যে মজ্জাগত একটি পশ্চাদপদতা রয়েছে। দেশ শাসন করতে হলে, দেশ গড়ে তুলতে হলে যে উদার মানবিক মন লাগে, নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে যে নিজের শ্রমের ওপর নির্ভর করতে হবেÑ এই চেতনা বাঙালি ভুলে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জাতিকে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ফিরিয়ে নিয়ে আসা সেই চেতনাটা আমাদের শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী সমাজকে ঠিকমতো উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। বুদ্ধিজীবী সমাজকে, শিক্ষিত সমাজকে সৎ হতে হবে, ন্যায়পরায়ণ হতে হবে, মানবিক হতে হবে, দেশের প্রতি মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকতে হবে, কর্মের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের ঋণ শোধ করতে হবে।