বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ভৌগলিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম বন্দর। তবে স্ক্যানার, জনবলসহ নানা সংকটে ধুকছে সংস্থাটি। আর সেই সুযোগে অসাধু ব্যক্তিরা বারবার মিথ্যে ঘোষণায় পণ্য এনে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট ধরা পড়েছে। সম্প্রতি টানা তিনদিনে পাঁচ কনটেইনার বিদেশি মদ জব্দ করেছে কাস্টমস কর্মকর্তারা।
সিএন্ডএফ এজেন্ট, অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অবৈধভাবে আমদানি করা পণ্য আনতে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর হাতিয়ার বানিয়েছেন ‘স্ক্যানার’ সংকটকে।
অসাধু ব্যবসায়ীরা কেন চট্টগ্রাম বন্দরকে নিরাপদ রুট মনে করছে বা বন্দর দিয়ে কিভাবে বারবার অবৈধভাবে আমদানিকরা পণ্য ছাড় হচ্ছে সেটি বের করে আনতে পিবিআই বা র্যাবকে তদন্তভার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন খোদ সিএন্ডএফ এজেন্ট নেতারা।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ১২টি গেটের মধ্যে স্ক্যানার রয়েছে ৭টিতে। এরমধ্যে বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ১ নম্বর গেট, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ৩ নম্বর গেট, চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ২, ৪ ও ৫ নম্বর গেটে আছে একটি করে ফিক্সড কনটেইনার স্ক্যানার। পাশাপাশি সিসিটি-২ ও জিসিবি-২ নম্বর গেটে একটি করে মোবাইল কনটেইনার রয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বন্দরে প্রতিনিয়ত মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্য বা চোরাচালান জব্দ করে কাস্টমস। চট্টগ্রাম বন্দরে স্ক্যানারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই অসাধু সিএন্ডএফ এজেন্ট ও কিছু কাস্টমস কর্মকর্তা আমদানিকারকদের সাথে হাত মিলিয়ে অবৈধভাবে আনা পণ্যগুলো জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে নেন। পাশাপাশি এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে মাঝে মাঝে ত্রুটি দেখা দেয়। তাই এসব জালিয়াতি রোধ করতে হলে স্ক্যানার মেশিন বসানোর বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পরিমাণ স্ক্যানার মেশিন রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নতুন স্ক্যানার মেশিন বসালে জালিয়াতি কমে আসবে বলে মনে করছেন তারা।
গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি কাগজের নাম দিয়ে ৪৬ লাখ শলাকা ইজি এবং মন্ড ব্রান্ডের সিগারেট আমদানি করে রিয়াজুদ্দিন বাজারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান করিম ট্রেডিং। এ জালিয়াতির মাধ্যমে ১১ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ঘটনার একদিন পরেই চট্টগ্রাম বন্দরে আরেকটি সিগারেটের চালান ধরা পড়ে। ‘পলিয়েস্টার পিইটি স্ট্র্যাপ’ ঘোষণায় ৪৮ লাখ ২৮ হাজার শলাকা বিদেশি সিগারেট আমদানি করেছিল পাবনার ঈশ্বরদী রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) ফুজিয়ান এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।
ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দুই কন্টেইনারে করে মন্ড, ইজি, ডানহিলসহ একাধিক ব্র্যান্ডের সিগারেট আমদানি করে কুমিল্লা ইপিজেডের বাংলাদেশ টেক্সটাইল ফাইবার এন্ড ফেব্রিক্স লিমিটেড নামের একটি কারখানা। বছরের শেষে এসে সিগারেটের আরো একটি বড় চালান জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর আপেল আমদানির ঘোষণা দিয়ে ২২ লাখ ১৯ হাজার শলাকা সিগারেট এনেছিল চট্টগ্রাম ফলমন্ডীর ফল আমদানিকারক মারহাবা ফ্রেশ ফ্রুটস। এ জালিয়াতির মাধ্যমে ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছিল এই আমদানিকারক। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ৫৫ লাখ ৫২ হাজার শলাকা বিদেশি সিগারেট আমদানি করেছিল সূচনা ইন্টারন্যাশনাল নামে চট্টগ্রামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ৭ কোটি ১১ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক মদের চালান ধরা পড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। গত ২০ জুলাই কুমিল্লা ইপিজেডের হেসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেড ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের বিএইচকে টেক্সটাইল লিমিটেডের নামে চীন থেকে দুই কনটেইনারে আসা ৩১ হাজার ৬২৫ লিটার বিদেশি মদ জব্দ করেছে কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা। দুই চালানে ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর ২৪ জুলাই নীলফামারী জেলার উত্তরা ইপিজেডের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) কোম্পানি লিমিটেডের আমদানি করা ১৫ হাজার ২০৪ লিটার বিদেশি মদ জব্দ করেছে কাস্টমসের এআইআর শাখা। এ জালিয়াতির মাধ্যমে ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়। সবশেষ সোমবার (২৫ জুলাই) দুই কনটেইনার বিদেশি মদের চালান জব্দ করেছে কাস্টমস।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে পণ্য আমদানির চেষ্টা করলেও তারা সফল হচ্ছে না। বন্দর প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এখন অনেক এগিয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। পাশাপাশি বন্দরের স্ক্যানার মেশিনগুলোও সচল রয়েছে। প্রতিনিয়ত মেশিনগুলোর কাজ চলছে। আরো স্ক্যানার মেশিন সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনা চলছে। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য চালান আসে। তবে মদের এত বড় চালান দেখে আমরাও অবাক। শেষমেষ আইপি জালিয়াতি করে তারা যে বড় অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিতে চেয়েছিল তা আমরা রুখে দিতে পেরেছি। সামনে বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে আরো বেশি কঠোর হবে। অপরাধীদের আরো কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার (এআইআর শাখা) সাইফুল হক বলেন, মিথ্যা ঘোষণায় হঠাৎ বিদেশি মদের আমদানি কেন বাড়লো তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারবো না। আমার কাজ হলো পণ্য চালান আটক করা। অনেকে লোভের বশবর্তী হয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে। আর আমরা সন্দেহ হলেই ওই চালানটি এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লক করে দিচ্ছি। কাউকেই আমরা ছাড় দিচ্ছি না। আমরা আশা করছি, আর কোন মদের চালান নেই। তবুও আমরা সতর্ক হয়ে পণ্য ছাড় দিচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, বন্দরের স্ক্যানার মেশিন সংকট একটা বড় ধরনের দুর্বলতা। এছাড়া অনেক সময় একটি সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারী বা কাছের কেউ প্রাতিষ্ঠানিক পাসওয়ার্ড জানা থাকলে লোভের বশবর্তী হয়ে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কাজেই এ অপরাধটি আসলে কে করেছে তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন। মদের চোরাচালান কেন বাড়লো, চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন আমদানির নিরাপদ রুট মনে করে ব্যবহার করছে তা খতিয়ে দেখার জন্য পিবিআই বা র্যাব দিয়ে তদন্ত করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ




















