১২:১৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

স্থানীয়দের বিষফোড়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা

নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের বিষফোড়া হয়ে উঠছে। কক্সবাজারে ইয়াবা, মানবপাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। শিবিরের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আধিপত্য বিস্তারে বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। চলছে অস্ত্রের মহড়া, ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।

গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি তথ্যমতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২০টির বেশি। গত দুই মাসে দুই রোহিঙ্গা নেতাসহ ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সামনের দিনে আরো হত্যাকাণ্ড ও ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও উদ্বিগ্ন।

রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর উপলক্ষে ক্যাম্পে পৃথকভাবে সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে রোহিঙ্গারা। নিজেদের মতো করে প্লেকার্ড, ব্যানার নিয়ে তারা প্রত্যাবাসনের দাবি জানাবেন বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা সূত্র। বিশ্লেষকদের মতে, প্রত্যাবাসন ছাড়া রোহিঙ্গাদের অপরাধী কার্যক্রম থেকে মুক্তির উপায় নেই। তবে পরিকল্পিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা কমানো সম্ভব।

গোয়েন্দা সংস্থা সতর্ক করেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগামীতে আরো বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে। সাম্প্রতিক প্রায় সকল হত্যাকাণ্ডে আলোচিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রুপের হাত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।

রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, মূলত রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মুহিব্বুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের আস্থা হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কথিত রোহিঙ্গা সংগঠন আরকান সালভেশন আর্মি (আরসা)। এ সুযোগে আরসার সন্ত্রাসীসহ ক্যাম্পের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং নগদ টাকা দিয়ে নিজ দলের পরিধি ও আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে সন্ত্রাসীগ্রুপগুলো। যাদের ক্ষমতা বেশি তারাই সিংহভাগ ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। এটা করতে গিয়ে যারা সেই গ্রুপের কথার বাইরে যান, তাদেরকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়। যারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সেদেশের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগাযোগ হয়।

চলমান সময়ে সন্ত্রাসী নবী হোসেনের সঙ্গেই মিয়ানমার সরকারের যোগাযোগ বেশি। মাস দুয়েক আগে বিজিবি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে ধরতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।

গোয়েন্দা তথ্যমতে, আলোচিত মাস্টার মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ, জাবু গ্রুপ, ইসলাম গ্রুপসহ অন্তত দু’ডজনাধিক ছোট বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। ইয়াবাসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি নবী হোসেন সব গ্রুপকে নিয়ে জোট বেঁধেছেন। এখন সব গ্রুপ নবী হোসেনের নির্দেশনায় কাজ করছে। তাদের হাতে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি অস্ত্রের মজুতও রয়েছে।

বিশ্বে মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু সেই মানবতাবোধ এবং স্থানীয়দের সৌহার্দ্যকে পদদলিত করে, সন্ত্রাসীসুলভ কর্মকাণ্ডে স্থানীয়দের অতিষ্ঠ করে তুলেছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয়দের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যাও করছে তারা। অথচ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেক স্থানীয় সহায়-সম্বল, ফসলি জমি, এমনকি ভিটে বাড়ির উঠানও হারিয়েছেন। নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য চোখের পানি ফেলা স্থানীয় বাসিন্দারা আজ বড় অসহায়। রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের কাছে বিষফোড়া হয়ে উঠেছে।

স্থানীয়দের দাবি, তাদের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের পর্যন্ত কারণে-অকারণে রোহিঙ্গারা দলবেঁধে এসে মারধর করে। ক্যাম্পের নিকটস্থ খোলা মাঠে ঠিকমতো খেলতে পারে না স্থানীয় শিশুরা। ক্যাম্পের পাশের মাঠে খেলতে দেখলে তেড়ে এসে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়াটা রোহিঙ্গাদের নিত্যকর্ম। তাদের মাঝে দখলদারিত্বের মনোভাব এখন স্পষ্ট। রোহিঙ্গারা নয়, কক্সবাজারের স্থানীয়রাই তাদের দয়া দাক্ষিণ্যের ওপর যেন বেঁচে আছে!

বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়া কিংবা ভিন্ন কোনো রাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ প্রতিদিন ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মঙ্গলবারও (২৩ আগস্ট) কক্সবাজার বিমানবন্দরে নারীসহ ১১ রোহিঙ্গাকে আটক করে শৃংখলাবাহিনী। এভাবে ক্যাম্প ত্যাগ করে নানাভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বা জেলার চেকপোস্টগুলোতে আটক হয়ে গত পাঁচ বছরে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়েছে বলে দাবি কক্সবাজার জেলা পুলিশের। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প এলাকায় কাঁটাতারের সীমানা বেষ্টনী থাকার পরও রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছেন।

স্থানীয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের ভাষ্য, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে শিবিরগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলা হয়।

পালংখালীর তাজনিমার খোলার বাসিন্দা সাবেক সেনা সদস্য আবুল কালাম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা চরম অকৃতজ্ঞ জাতি। ১৯৯২ সালের পর রোহিঙ্গারা প্রথম দলবেঁধে স্থানীয়দের উপর পাকহানাদার বাহিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সে সময় রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফকে আরাকানের অংশ ও তাদের রাজ্য দাবি করে স্থানীয়দের ৩ দিনের মধ্যে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে আল্টিমেটাম দিয়েছিল। এখন আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের অধিক। গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গারা অনেককে হত্যা করেছে। আহত করেছে অনেককে। তাদের অত্যাচারে স্থানীয়রা একদিন পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে বলে মনে হচ্ছে।’

বালুখালীর স্থানীয় গৃহবধূ আমেনা খাতুন বলেন, ‘অসহায়ের সহায় হলে আল্লাহপাক খুশি হবেন সেই ধর্মীয় ভাবনায় সহায়-সম্বল যা ছিলো তার সবই রোহিঙ্গাদের জন্য দান করেছি। এখন আমাকে ভিটেবাড়ি ছাড়া করতে তারা একমুহূর্তও ভাবে না। মনে হচ্ছে তাদের আশ্রয় দিয়ে চরম ভুল করেছি। তারা অকৃতজ্ঞ।’

স্থানীয় মুদিদোকানি আবু নোমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আচরণ দেখে বুঝলাম, মিয়ানমার সরকার কেন অতিষ্ঠ হয়েছিল। রোহিঙ্গারা আশ্রিত দেশ ধ্বংসে কুণ্ঠাবোধ করে না। স্থানীয়দের সঙ্গে মারামারি ছাড়াও, নিজেদের মাঝেও প্রতিদিন মারামারি করে। স্থানীয় অনেকে সন্তানদের মানুষ করতে এলাকা ত্যাগ করে স্বপরিবারে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার চলে এসেছেন।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ঢলের পর গত পাঁচ বছরে থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে। খুনের মামলা হয়েছে ৯৯টি। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক, চাঁদাবাজি, মানবপাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধের কারণে এসব মামলা হয়েছে। যদিও বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় তথ্যমতে অনন্তপক্ষে ১২০টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের সবধরনের অপরাধ ও বিশৃঙ্খল আচরণ কঠোর হাতে রোধ করা হচ্ছে। ক্যাম্পে এপিবিএন ও বাইরে থানা পুলিশ নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বজায় রাখার চেষ্টা করে। স্থানীয়রা যেভাবে রোহিঙ্গা বিষয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন তাতে রোহিঙ্গা কর্তৃক স্থানীয়দের উপর হামলা ও সংঘর্ষ এখন অনেকাংশে রদ করা সম্ভব হয়েছে। আশা করি সামনেও তা অব্যাহত থাকবে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। স্থানীয়দের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে পুরোনো-নতুন মিলিয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা সোয়া ১১ লাখ। তালিকাভুক্ত প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবনধারণ পণ্য সরবরাহ করা হয়। রোহিঙ্গাদের দেওয়া অনেক পণ্য তারা বাজারে বিক্রিও করে দিচ্ছে। এরপরও গোপনে বা কৌশলে ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে রোহিঙ্গারা। মানবিক আশ্রয় দেওয়ার কারণে সরকার তাদের সঙ্গে নম্র আচরণ করছে। এটার সুযোগ নিলে প্রশাসনকে আরও কঠোরতা দেখাতে হয়।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব

স্থানীয়দের বিষফোড়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত : ১০:৪০:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ অগাস্ট ২০২২

নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের বিষফোড়া হয়ে উঠছে। কক্সবাজারে ইয়াবা, মানবপাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। শিবিরের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আধিপত্য বিস্তারে বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। চলছে অস্ত্রের মহড়া, ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।

গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি তথ্যমতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২০টির বেশি। গত দুই মাসে দুই রোহিঙ্গা নেতাসহ ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সামনের দিনে আরো হত্যাকাণ্ড ও ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও উদ্বিগ্ন।

রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর উপলক্ষে ক্যাম্পে পৃথকভাবে সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে রোহিঙ্গারা। নিজেদের মতো করে প্লেকার্ড, ব্যানার নিয়ে তারা প্রত্যাবাসনের দাবি জানাবেন বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা সূত্র। বিশ্লেষকদের মতে, প্রত্যাবাসন ছাড়া রোহিঙ্গাদের অপরাধী কার্যক্রম থেকে মুক্তির উপায় নেই। তবে পরিকল্পিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা কমানো সম্ভব।

গোয়েন্দা সংস্থা সতর্ক করেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগামীতে আরো বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে। সাম্প্রতিক প্রায় সকল হত্যাকাণ্ডে আলোচিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রুপের হাত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।

রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, মূলত রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মুহিব্বুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের আস্থা হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কথিত রোহিঙ্গা সংগঠন আরকান সালভেশন আর্মি (আরসা)। এ সুযোগে আরসার সন্ত্রাসীসহ ক্যাম্পের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং নগদ টাকা দিয়ে নিজ দলের পরিধি ও আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে সন্ত্রাসীগ্রুপগুলো। যাদের ক্ষমতা বেশি তারাই সিংহভাগ ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। এটা করতে গিয়ে যারা সেই গ্রুপের কথার বাইরে যান, তাদেরকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়। যারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সেদেশের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগাযোগ হয়।

চলমান সময়ে সন্ত্রাসী নবী হোসেনের সঙ্গেই মিয়ানমার সরকারের যোগাযোগ বেশি। মাস দুয়েক আগে বিজিবি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে ধরতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।

গোয়েন্দা তথ্যমতে, আলোচিত মাস্টার মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ, জাবু গ্রুপ, ইসলাম গ্রুপসহ অন্তত দু’ডজনাধিক ছোট বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। ইয়াবাসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি নবী হোসেন সব গ্রুপকে নিয়ে জোট বেঁধেছেন। এখন সব গ্রুপ নবী হোসেনের নির্দেশনায় কাজ করছে। তাদের হাতে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি অস্ত্রের মজুতও রয়েছে।

বিশ্বে মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু সেই মানবতাবোধ এবং স্থানীয়দের সৌহার্দ্যকে পদদলিত করে, সন্ত্রাসীসুলভ কর্মকাণ্ডে স্থানীয়দের অতিষ্ঠ করে তুলেছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয়দের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যাও করছে তারা। অথচ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেক স্থানীয় সহায়-সম্বল, ফসলি জমি, এমনকি ভিটে বাড়ির উঠানও হারিয়েছেন। নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য চোখের পানি ফেলা স্থানীয় বাসিন্দারা আজ বড় অসহায়। রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের কাছে বিষফোড়া হয়ে উঠেছে।

স্থানীয়দের দাবি, তাদের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের পর্যন্ত কারণে-অকারণে রোহিঙ্গারা দলবেঁধে এসে মারধর করে। ক্যাম্পের নিকটস্থ খোলা মাঠে ঠিকমতো খেলতে পারে না স্থানীয় শিশুরা। ক্যাম্পের পাশের মাঠে খেলতে দেখলে তেড়ে এসে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়াটা রোহিঙ্গাদের নিত্যকর্ম। তাদের মাঝে দখলদারিত্বের মনোভাব এখন স্পষ্ট। রোহিঙ্গারা নয়, কক্সবাজারের স্থানীয়রাই তাদের দয়া দাক্ষিণ্যের ওপর যেন বেঁচে আছে!

বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়া কিংবা ভিন্ন কোনো রাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ প্রতিদিন ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মঙ্গলবারও (২৩ আগস্ট) কক্সবাজার বিমানবন্দরে নারীসহ ১১ রোহিঙ্গাকে আটক করে শৃংখলাবাহিনী। এভাবে ক্যাম্প ত্যাগ করে নানাভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বা জেলার চেকপোস্টগুলোতে আটক হয়ে গত পাঁচ বছরে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়েছে বলে দাবি কক্সবাজার জেলা পুলিশের। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প এলাকায় কাঁটাতারের সীমানা বেষ্টনী থাকার পরও রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছেন।

স্থানীয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের ভাষ্য, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে শিবিরগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলা হয়।

পালংখালীর তাজনিমার খোলার বাসিন্দা সাবেক সেনা সদস্য আবুল কালাম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা চরম অকৃতজ্ঞ জাতি। ১৯৯২ সালের পর রোহিঙ্গারা প্রথম দলবেঁধে স্থানীয়দের উপর পাকহানাদার বাহিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সে সময় রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফকে আরাকানের অংশ ও তাদের রাজ্য দাবি করে স্থানীয়দের ৩ দিনের মধ্যে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে আল্টিমেটাম দিয়েছিল। এখন আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের অধিক। গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গারা অনেককে হত্যা করেছে। আহত করেছে অনেককে। তাদের অত্যাচারে স্থানীয়রা একদিন পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে বলে মনে হচ্ছে।’

বালুখালীর স্থানীয় গৃহবধূ আমেনা খাতুন বলেন, ‘অসহায়ের সহায় হলে আল্লাহপাক খুশি হবেন সেই ধর্মীয় ভাবনায় সহায়-সম্বল যা ছিলো তার সবই রোহিঙ্গাদের জন্য দান করেছি। এখন আমাকে ভিটেবাড়ি ছাড়া করতে তারা একমুহূর্তও ভাবে না। মনে হচ্ছে তাদের আশ্রয় দিয়ে চরম ভুল করেছি। তারা অকৃতজ্ঞ।’

স্থানীয় মুদিদোকানি আবু নোমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আচরণ দেখে বুঝলাম, মিয়ানমার সরকার কেন অতিষ্ঠ হয়েছিল। রোহিঙ্গারা আশ্রিত দেশ ধ্বংসে কুণ্ঠাবোধ করে না। স্থানীয়দের সঙ্গে মারামারি ছাড়াও, নিজেদের মাঝেও প্রতিদিন মারামারি করে। স্থানীয় অনেকে সন্তানদের মানুষ করতে এলাকা ত্যাগ করে স্বপরিবারে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার চলে এসেছেন।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ঢলের পর গত পাঁচ বছরে থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে। খুনের মামলা হয়েছে ৯৯টি। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক, চাঁদাবাজি, মানবপাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধের কারণে এসব মামলা হয়েছে। যদিও বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় তথ্যমতে অনন্তপক্ষে ১২০টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের সবধরনের অপরাধ ও বিশৃঙ্খল আচরণ কঠোর হাতে রোধ করা হচ্ছে। ক্যাম্পে এপিবিএন ও বাইরে থানা পুলিশ নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বজায় রাখার চেষ্টা করে। স্থানীয়রা যেভাবে রোহিঙ্গা বিষয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন তাতে রোহিঙ্গা কর্তৃক স্থানীয়দের উপর হামলা ও সংঘর্ষ এখন অনেকাংশে রদ করা সম্ভব হয়েছে। আশা করি সামনেও তা অব্যাহত থাকবে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। স্থানীয়দের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে পুরোনো-নতুন মিলিয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা সোয়া ১১ লাখ। তালিকাভুক্ত প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবনধারণ পণ্য সরবরাহ করা হয়। রোহিঙ্গাদের দেওয়া অনেক পণ্য তারা বাজারে বিক্রিও করে দিচ্ছে। এরপরও গোপনে বা কৌশলে ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে রোহিঙ্গারা। মানবিক আশ্রয় দেওয়ার কারণে সরকার তাদের সঙ্গে নম্র আচরণ করছে। এটার সুযোগ নিলে প্রশাসনকে আরও কঠোরতা দেখাতে হয়।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব