১০:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

রাশিয়ার থেকে সরকার বেশি দামে গম কিনছে

রাশিয়ার কাছ থেকে সরকার যে পাঁচ লাখ টন গম কিনছে, টনপ্রতি দর প্রায় ৫০ মার্কিন ডলার বেশি পড়ছে।

রাশিয়ার কাছ থেকে সরকার যে পাঁচ লাখ টন গম কিনছে, টনপ্রতি দর প্রায় ৫০ মার্কিন ডলার বেশি পড়ছে। সরকারি পর্যায়ে চুক্তির ভিত্তিতে (জিটুজি) খাদ্য অধিদপ্তর রাশিয়ার গম কিনছে প্রতি টন ৪৩০ ডলার দরে। যদিও বাজারদর এখন ৩৮০ ডলারের মতো।

সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টন গম কেনার অনুমোদন দেয়, যা ধাপে ধাপে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশে আসার কথা। টনপ্রতি ৫০ ডলার বেশি ব্যয় হলে পাঁচ লাখ টন গম আমদানিতে সরকারের ২৪০ কোটি টাকার মতো বেশি খরচ হবে।

মজুত কমে যাওয়ায় সরকার রাশিয়া থেকে গম আমদানি করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে দেশটির (রাশিয়ার) সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যাহত হয়। গত জুলাই মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেন খাদ্য রপ্তানির চুক্তি করার পর ওই অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু হয়েছে।

রাশিয়া থেকে কেন বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে, জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন গত শুক্রবার বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার সঙ্গে ২৪ আগস্ট গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই দিন দাম ছিল ৪৩০ ডলার। সেই দাম ধরেই আমদানির চুক্তি হতে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের সংকটের এই সময়ে রাশিয়া আমাদের কাছে ৫ লাখ টন গম রপ্তানি করবে, এটা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সুখবর। কারণ, সরকারি গমের মজুত বেশ কমে এসেছে।’
খাদ্যসচিব আরও জানান, চুক্তি সইয়ের ৪০ দিনের মাথায় রাশিয়ার গমের প্রথম চালান দেশে আসবে। পুরো পাঁচ লাখ টন গম আসবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে।

সরকারিভাবে গম আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও বেসরকারি খাত এখনো রাশিয়া থেকে আমদানি শুরু করেনি। বেসরকারি খাতের চারটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার গমের দাম কমছে। আরেকটু অপেক্ষা করলে দাম আরও কমে পাওয়া যাবে। সাধারণত পড়তির বাজারে বেসরকারি আমদানিকারকেরা মূল্য স্থির হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানির ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়াও প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় একজন আমদানিকারক বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, তাঁদের কাছে সরবরাহকারীরা রাশিয়ার প্রতি টন গমের দাম চাচ্ছেন ৩৭০ ডলারের কাছাকাছি। এই দর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছানো পর্যন্ত ব্যয় ধরে। সরকারি দর হয় একেবারে বন্দরে পৌঁছানোর ব্যয় ধরে। সে ক্ষেত্রে প্রতি টন ১০ ডলার বেশি পড়ে। তিনি বলেন, বন্দরে পৌঁছানোর ব্যয় ধরে রাশিয়ার গম এখন ৩৮০ ডলারের আশপাশের দামে কেনা যায়।

সরকারি হিসাবে দর ৩৭২ ডলার
গম আমদানির সিদ্ধান্তের আগে গত ১১ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মান্টিটস্কি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে গম রপ্তানির আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময় প্রাথমিকভাবে ৩ লাখ টন গম কেনার বিষয়ে সম্মত হয় দুই দেশ। খাদ্যমন্ত্রী রাশিয়ার গম রপ্তানির আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সূত্র জানায়, এরপর গত ২৪ আগস্ট রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জেএসসি প্রডিনটর্গের কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গম আমদানি বিষয়ে একটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেন। সেখানে প্রতি টন ৪৩০ ডলারে গম আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্মত হয়।

সবকিছু ঠিক হওয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিষয়টি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ওঠে গত বৃহস্পতিবার। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানানো হয়, রাশিয়া থেকে সরকারি পর্যায়ে পাঁচ লাখ টন গম আমদানিতে ব্যয় হবে ২১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে)। প্রতি টনের দাম পড়বে ৪৩০ ডলার। প্রতি কেজি গমের মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ টাকা ৮৫ পয়সা।

খাদ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার রপ্তানিকারক সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে কম কেনার চুক্তি হবে।সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি যে দর অনুমোদন দেয়, সেটাই চূড়ান্ত মূল্য।

খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন খাদ্যশস্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। মন্ত্রণালয়টি যেদিন রাশিয়ার কাছ থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় (২৪ আগস্ট), সেদিনের খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার গমের দর প্রতি টন ৩৩০ ডলার। বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছাতে ব্যয় দাঁড়াবে প্রতি টন ৩৮৭ ডলার। গত ৩১ আগস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার গমের দাম আরও কমে ৩৭২ ডলারে নেমেছে।

নিজেদের প্রতিবেদনেই কম দাম উল্লেখ করে বেশি দরে আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব বিজনেস বাংলাদেশকে বলেছিলেন, প্রতিবেদনটিতে ভুল রয়েছে। গতকাল রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি আর দেখা যায়নি।

এদিকে আরও কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে গম কিনছে। যেমন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে গত ২৩ আগস্ট জানানো হয়, মিসর রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ২ লাখ ৪০ হাজার টন গম কিনেছে। সব খরচসহ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট বা সিএফআর পদ্ধতিতে) দাম পড়েছে ৩৬৮ ডলার।

মিসরের দামটির বিষয়ে বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা বলছেন, মিসরের চেয়ে বাংলাদেশে গম আনার ভাড়া একটু বেশি পড়বে। তবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের দামের তুলনায় মিসর অনেক কমে পেয়েছে।

সরকারের মজুত সামান্য
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তথ্য বলছে, দেশে বছরে গমের চাহিদা ৭০ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে ৬০ লাখ টনই আমদানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মোট গমের ৪৫ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে, ২৩ শতাংশ কানাডা থেকে, ১৭ শতাংশ ভারত থেকে এবং বাকিটা অন্য কয়েকটি দেশ থেকে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশ গমের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ভারত গত মে মাসের মাঝামাঝি নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর দেশের বাজারে গমের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন খোলা আটার দাম প্রতি কেজি ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে প্যাকেটজাত আটার দাম প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে দাম বেশি ৫৯ শতাংশ।

সরকারের কাছেও গমের মজুত কম। খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে এখন গম আছে ১ লাখ ৪০ হাজার টনের মতো, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৭ হাজার টন কম।

‘দর যাচাই-বাছাই করা উচিত’
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার–এর তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে গমের দাম কমছে। গত ১৭ মে টনপ্রতি দাম ছিল ৪৩৮ ডলার। এরপর থেকে কমতির দিয়ে রয়েছে দর, যা গত শুক্রবার ৩২৪ ডলারে নেমেছে। উল্লেখ্য, এই দামের সঙ্গে ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় যোগ হবে। বিশ্ববাজারে দর আরও কমার পূর্বাভাস রয়েছে, কারণ রাশিয়ায় এবার গমের উৎপাদন বেশ ভালো হবে। সাধারণত কানাডার গমের দাম বেশি পড়ে। কারণ, সে দেশের গমে আমিষ বেশি থাকে। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারতের গমে আমিষ কম থাকে বলে দামও কম হয়।

সরকারিভাবে বেশি দামে চাল ও গম আমদানির অভিযোগ আগেও উঠেছিল। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের সময় বেশি দামে পচা গম আমদানির ঘটনায় সমালোচনা হয়েছিল সরকারের।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গম আমদানির ক্ষেত্রে দর আরও যাচাই-বাছাই করা উচিত। কারণ, এর আগেও বিদেশ থেকে বেশি দামে চাল ও গম আমদানির অভিযোগ ছিল। তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তির পর বিশ্ববাজারে দাম কমছে। রাশিয়া থেকে কেন খাদ্য মন্ত্রণালয় বেশি দামে গম কিনছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব

বীরগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

রাশিয়ার থেকে সরকার বেশি দামে গম কিনছে

প্রকাশিত : ১০:৪৩:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

রাশিয়ার কাছ থেকে সরকার যে পাঁচ লাখ টন গম কিনছে, টনপ্রতি দর প্রায় ৫০ মার্কিন ডলার বেশি পড়ছে। সরকারি পর্যায়ে চুক্তির ভিত্তিতে (জিটুজি) খাদ্য অধিদপ্তর রাশিয়ার গম কিনছে প্রতি টন ৪৩০ ডলার দরে। যদিও বাজারদর এখন ৩৮০ ডলারের মতো।

সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টন গম কেনার অনুমোদন দেয়, যা ধাপে ধাপে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশে আসার কথা। টনপ্রতি ৫০ ডলার বেশি ব্যয় হলে পাঁচ লাখ টন গম আমদানিতে সরকারের ২৪০ কোটি টাকার মতো বেশি খরচ হবে।

মজুত কমে যাওয়ায় সরকার রাশিয়া থেকে গম আমদানি করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে দেশটির (রাশিয়ার) সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যাহত হয়। গত জুলাই মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেন খাদ্য রপ্তানির চুক্তি করার পর ওই অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু হয়েছে।

রাশিয়া থেকে কেন বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে, জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন গত শুক্রবার বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার সঙ্গে ২৪ আগস্ট গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই দিন দাম ছিল ৪৩০ ডলার। সেই দাম ধরেই আমদানির চুক্তি হতে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের সংকটের এই সময়ে রাশিয়া আমাদের কাছে ৫ লাখ টন গম রপ্তানি করবে, এটা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সুখবর। কারণ, সরকারি গমের মজুত বেশ কমে এসেছে।’
খাদ্যসচিব আরও জানান, চুক্তি সইয়ের ৪০ দিনের মাথায় রাশিয়ার গমের প্রথম চালান দেশে আসবে। পুরো পাঁচ লাখ টন গম আসবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে।

সরকারিভাবে গম আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও বেসরকারি খাত এখনো রাশিয়া থেকে আমদানি শুরু করেনি। বেসরকারি খাতের চারটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার গমের দাম কমছে। আরেকটু অপেক্ষা করলে দাম আরও কমে পাওয়া যাবে। সাধারণত পড়তির বাজারে বেসরকারি আমদানিকারকেরা মূল্য স্থির হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানির ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়াও প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় একজন আমদানিকারক বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, তাঁদের কাছে সরবরাহকারীরা রাশিয়ার প্রতি টন গমের দাম চাচ্ছেন ৩৭০ ডলারের কাছাকাছি। এই দর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছানো পর্যন্ত ব্যয় ধরে। সরকারি দর হয় একেবারে বন্দরে পৌঁছানোর ব্যয় ধরে। সে ক্ষেত্রে প্রতি টন ১০ ডলার বেশি পড়ে। তিনি বলেন, বন্দরে পৌঁছানোর ব্যয় ধরে রাশিয়ার গম এখন ৩৮০ ডলারের আশপাশের দামে কেনা যায়।

সরকারি হিসাবে দর ৩৭২ ডলার
গম আমদানির সিদ্ধান্তের আগে গত ১১ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মান্টিটস্কি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে গম রপ্তানির আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময় প্রাথমিকভাবে ৩ লাখ টন গম কেনার বিষয়ে সম্মত হয় দুই দেশ। খাদ্যমন্ত্রী রাশিয়ার গম রপ্তানির আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সূত্র জানায়, এরপর গত ২৪ আগস্ট রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জেএসসি প্রডিনটর্গের কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গম আমদানি বিষয়ে একটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেন। সেখানে প্রতি টন ৪৩০ ডলারে গম আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্মত হয়।

সবকিছু ঠিক হওয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিষয়টি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ওঠে গত বৃহস্পতিবার। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানানো হয়, রাশিয়া থেকে সরকারি পর্যায়ে পাঁচ লাখ টন গম আমদানিতে ব্যয় হবে ২১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে)। প্রতি টনের দাম পড়বে ৪৩০ ডলার। প্রতি কেজি গমের মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ টাকা ৮৫ পয়সা।

খাদ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার রপ্তানিকারক সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে কম কেনার চুক্তি হবে।সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি যে দর অনুমোদন দেয়, সেটাই চূড়ান্ত মূল্য।

খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন খাদ্যশস্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। মন্ত্রণালয়টি যেদিন রাশিয়ার কাছ থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় (২৪ আগস্ট), সেদিনের খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার গমের দর প্রতি টন ৩৩০ ডলার। বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছাতে ব্যয় দাঁড়াবে প্রতি টন ৩৮৭ ডলার। গত ৩১ আগস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার গমের দাম আরও কমে ৩৭২ ডলারে নেমেছে।

নিজেদের প্রতিবেদনেই কম দাম উল্লেখ করে বেশি দরে আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব বিজনেস বাংলাদেশকে বলেছিলেন, প্রতিবেদনটিতে ভুল রয়েছে। গতকাল রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি আর দেখা যায়নি।

এদিকে আরও কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে গম কিনছে। যেমন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে গত ২৩ আগস্ট জানানো হয়, মিসর রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ২ লাখ ৪০ হাজার টন গম কিনেছে। সব খরচসহ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট বা সিএফআর পদ্ধতিতে) দাম পড়েছে ৩৬৮ ডলার।

মিসরের দামটির বিষয়ে বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা বলছেন, মিসরের চেয়ে বাংলাদেশে গম আনার ভাড়া একটু বেশি পড়বে। তবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের দামের তুলনায় মিসর অনেক কমে পেয়েছে।

সরকারের মজুত সামান্য
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তথ্য বলছে, দেশে বছরে গমের চাহিদা ৭০ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে ৬০ লাখ টনই আমদানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মোট গমের ৪৫ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে, ২৩ শতাংশ কানাডা থেকে, ১৭ শতাংশ ভারত থেকে এবং বাকিটা অন্য কয়েকটি দেশ থেকে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশ গমের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ভারত গত মে মাসের মাঝামাঝি নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর দেশের বাজারে গমের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন খোলা আটার দাম প্রতি কেজি ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে প্যাকেটজাত আটার দাম প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে দাম বেশি ৫৯ শতাংশ।

সরকারের কাছেও গমের মজুত কম। খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে এখন গম আছে ১ লাখ ৪০ হাজার টনের মতো, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৭ হাজার টন কম।

‘দর যাচাই-বাছাই করা উচিত’
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার–এর তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে গমের দাম কমছে। গত ১৭ মে টনপ্রতি দাম ছিল ৪৩৮ ডলার। এরপর থেকে কমতির দিয়ে রয়েছে দর, যা গত শুক্রবার ৩২৪ ডলারে নেমেছে। উল্লেখ্য, এই দামের সঙ্গে ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় যোগ হবে। বিশ্ববাজারে দর আরও কমার পূর্বাভাস রয়েছে, কারণ রাশিয়ায় এবার গমের উৎপাদন বেশ ভালো হবে। সাধারণত কানাডার গমের দাম বেশি পড়ে। কারণ, সে দেশের গমে আমিষ বেশি থাকে। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারতের গমে আমিষ কম থাকে বলে দামও কম হয়।

সরকারিভাবে বেশি দামে চাল ও গম আমদানির অভিযোগ আগেও উঠেছিল। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের সময় বেশি দামে পচা গম আমদানির ঘটনায় সমালোচনা হয়েছিল সরকারের।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গম আমদানির ক্ষেত্রে দর আরও যাচাই-বাছাই করা উচিত। কারণ, এর আগেও বিদেশ থেকে বেশি দামে চাল ও গম আমদানির অভিযোগ ছিল। তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তির পর বিশ্ববাজারে দাম কমছে। রাশিয়া থেকে কেন খাদ্য মন্ত্রণালয় বেশি দামে গম কিনছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব