যশোরের চৌগাছায় ভরা আমন মৌসুমে সার নিয়ে নয় ছয় শুরু হয়েছে। সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করায় চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ইউরিয়া, এমওপি, টিএসপি ও ডিএপি সার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি বস্তায় ৩০০-৪০০ টাকা বেশি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ডিলারদের জন্য বরাদ্দ করা ভর্তুকির সার সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে আমদানিকারকদের কাছ থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তুলে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তাঁদের হাত থেকে সেই সার চলে যাচ্ছে অননুমোদিত খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। এর ফলে ভর্তুকির সার কৃষকদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোনো তদারকি নেই বলে কৃষকেরা অভিযোগ করেছেন। ফলে চলতি আমন আবাদ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন চাষিরা। আমন চাষীদের অভিযোগ,খুচরা পর্যায়ে বস্তা প্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে সার। ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধির কারণ কি জানতে চাইলে চৌগাছার একজন সার ডিলার জানান, চৌগাছায় চাহিদার তুলনায় সার দেওয়া হয়েছে অর্ধেক। তিনি বলেন, গত মাসে তিনি নিজে বরাদ্দ পেয়েছেন ৬১.২৫ মেট্রিক টন । অথচ তার এলাকায় সারের চাহিদা রয়েছে ৯০/১০০ মেট্রিক টন ।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিসিআইসি’র তালিকাভুক্ত ১৬ জন সার ডিলার রয়েছেন। গত আগস্ট মাসে ইউরিয়া সারের চাহিদা ছিল ২০৫০ মে. টন বিপরীতে পেয়েছেন ৯৮০ মে.টন, টিএসপি চাহিদা ছিল ৪০০ মে.টন বিপরীতে পেয়েছেন ১৩২ মে.টন, ডিএপি ৮৫০ মে.টন বিপরীতে পেয়েছেন ২৯৭ মে.টন,এমওপি ১৫০০ মে.টনের বিপরীতে পেয়েছেন ২১৭ মে.টন।
স্বরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক পর্যায়ে সরকার-নির্ধারিত প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ইউরিয়া সারের খুচরা মূল্য ১ হাজার ১০০ টাকা হলেও খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩০০থেকে ১৪০০ টাকা, টিএসপি সারের খুচরা মূল্য ১ হাজার ১০০ টাকা হলেও খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা, এমওপি খুচরা মূল্য ৭৫০ টাকা হলেও খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০ এবং ডিএপি ৮০০ টাকা হলেও খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চৌগাছা উপজেলার কৃষকদের মাঝে সুষ্ঠভাবে সার বন্টনের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক সরকার কর্তৃক ১৬ জন ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ডিলাররা হলো পাতিবিলা বাজার এলাকার জন্য মেসার্স ফরিদুল ইসলাম, নারায়ণপুর এলাকার জন্য মেসার্স ইউনুচ আলী, পাশাপোল এলাকার জন্য মেসার্স মেহেদী মাসুদ চৌধুরী , স্বরুপদাহ এলাকার জন্য মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্স, ফুলসারা এলাকার জন্য মেসার্স চৌধুরী ট্রেডার্স , জগদীশপুর এলাকার জন্য মেসার্স শোভন এন্টারপ্রাইজ, সিংহঝুলী এলাকার জন্য মেসার্স দিপু ট্রেডার্স,সুখপুকুরিয়া এলাকার জন্য মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজ, ফুলসারা এলাকার জন্য মেসার্স আবদুল্লাহ ট্রেডার্স, ধূলিয়ানী এলাকায় মেসার্স রহমত স্টোর, স্বরুপদাহ এলাকায় মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, হাকিমপুর এলাকায় মেসার্স নওয়াপাড়া ট্রেডিং, চৌগাছা এলাকার জন্য মেসার্স রানী এন্টারপ্রাইজ,ইছাপুর এলাকার জন্য মৃধা ট্রেডার্স,পাশাপোল এলাকার জন্য মেসার্স মনোয়ারা ট্রেডিং, পৌরসভার এলাকার জন্য মেসার্স শয়ন ট্রেডার্স।
সূত্র মতে, এসব ডিলারের মাধ্যমে উপজেলার কৃষকদের সারের চাহিদা মেটাতে বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। অভিযোগ উঠেছে, কিছু কিছু ডিলারেরা সার উত্তোলন না করে আইন ভেঙ্গে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরেও অধিক মুনাফার লোভে সার বিক্রি করা হয়ে থাকে। যে কারণে উপজেলার কৃষকরা চাহিদা অনুযায়ী সার পান না। একারণে অতিরিক্তি দাম দিয়ে সার কিনতে হয়। এছাড়া ধূলিয়ানী বাজারের লাভলু নামের খুচরা সার ব্যবসায়ী বীরদর্পে ৮০০টাকার ডিএপি সার ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এসব বিষয় দেখভাল করার জন্য উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস থাকলেও তারা দেখেও না দেখার ভান করে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, নিয়মিত ডিলারদের গোডাউন সহ দোকান পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তা করা হয় না। যে কারণে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
উপজেলার পুড়াপাড়া গ্রামের কৃষক ফজের আলী জানান, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ইউরিয়া সার ১ হাজার ১০০ টাকা হলেও ইউরিয়া ১২৫০ টাকা বস্তা এবং ডিএপি ৮০০ টাকা হলেও ১১০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া বেলেদাড়ি গ্রামের গোলাম মোস্তফা এক বস্তা ডিএপি এক হাজার ২৫০ টাকায় কিনেছেন বলে জানিয়েছেন।
একই উপজেলার পাতিবিলা গ্রামের কৃষক আহসান উল্লাহ জানান, এক বস্তা ইউরিয়া সার তিনি ১ হাজার ৩০০ টাকায় এবং এক বস্তা ডিএপি ১১০০ টাকায় কিনেছেন।কয়ারপাড়া গ্রামের কৃষক রফিউদ্দীন বলেন, কিছু দিন আগে তিনি ডিএপি এক হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চৌগাছায় ১১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিপরীতে সারের ডিলারশিপ আছে ১৬জন এবং সাব ডিলার রয়েছেন ৭৩জন । এই সকল সার ডিলার যদি তাদের বরাদ্দ এলাকায় ডেলিভারি পয়েন্টগুলোতে নিয়ম মাফিক সার বিক্রয় করে তাহলে সার নিয়ে কৃষকের কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয় ।
তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, চৌগাছায় দীর্ঘদিন ধরে যাদের নামে সারের ডিলারশিপ রয়েছে তাদের অনেকেই স্থানীয় নয় বা চৌগাছার অধিবাসী নয়। তাদের ডিলারশিপ বিভিন্ন প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হয় এবং অনেকেই প্রকৃত সার ব্যবসায়ীও নয়। রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে তারা সারের ডিলারশিপ ধরে রেখে শুধু ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) বিক্রি করেই কামিয়ে নিচ্ছে মুনাফা। একটি অর্থশালী ব্যবসায়ী চক্র সার ডিলারদের কাছ থেকে ডিও কিনেই প্রতিবছর হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা । এতে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন উৎপাদক চাষিরা।বিষয়টি নিয়ে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমরেণ বিশ্বাস বলেন, কৃষকদের চাহিদার তুলনায় সারের সরবরাহ কম থাকায় একটু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে সরকারের বরাদ্দকৃত সার সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসকল ব্যবসায়ীরা কৃষকদের ঠকিয়ে বেশীমূল্যে সার বিক্রয় করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব