সম্প্রতি সাতক্ষীরার শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে রোড শিরিস গাছের ডাল ভাঙার হিরিক পড়েছে। নারী-পুরুষসহ শিশুদের গাছে উঠে ডাল ভাঙতে দেখা যাচ্ছে। রোড শিরিস গাছের এই পোকাকে ছাতরা পোকা হিসেবে অভিহিত করে এই প্রকার আক্রমণে শিশু গাছ মরে যায় দাবি করে একটি চক্র এই ডাল সংগ্রহ করছে ২৫০ থেকে ৩০০টাকা কেজি দরে।
আর ওই চক্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষেরা অল্পসময়ে বেশি মুনাফা লাভের আশায় প্রতিদিন জেলার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত বেরিয়ে পড়ছে রোড শিরিস গাছের কথিত এই ভাইরাস পোকার সন্ধানে। বর্তমানে খেটে খাওয়া মানুষের এখন অনিশ্চিত উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।এ দিকে গুজব ও প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কয়েক কোটি টাকারও বেশি মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছেন সাতক্ষীরার জনগণ। নিত্যদিন ২০ লাখেরও বেশি টাকার সম্পদ গুজবকারীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তারা। আর এই গুজব-প্রতারণার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জিরো থেকে লাখপতি বনে যাচ্ছেন জেলার অনেক চোরাকারবারী। আর নিজেদের অজান্তে চোরাকারকারীদের সহায়তা করে চলেছেন জেলার কয়েক হাজার খেটে খাওয়া মানুষেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় কলারোয়ার চান্দুড়িয়া বাজার, আশাশুনির বুধহাটা কুল্যার মোড়সহ জেলার অনেক জায়গায় এই রোড শিরিস গাছের পোকা লাগানো ডাল বিক্রির হাট বসে। আবার অনেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে নিজ বাসা থেকে এই ডাল গুলো স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে কেজি প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন।
যেটা হাত বদলের মাধ্যমে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে এই পোকা লাগানো ডাল থেকে আঠা তুলে নিয়ে একটি চক্র ভারতে পাচার করছে। তবে, এর মূল ক্রেতা কারা আর কেনইবা কিনছে আর তারা বিকৃত আকৃতির এই পোকা কিনে করছেটাইবা কি? এবিষয়ে স্থানীয়দের কৌতূহল থাকলেও চাহিদার ভীঁড়ে রীতিমত চাপা পড়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন।
এবিষয়ে অনুসন্ধানে জানাগেছে, রোড শিরিস গাছের যে পোকাকে ছাতরা পোকা হিসেবে বলা হচ্ছে সেটা আসলে ছাতরা পোকা না। এই পোকাকে লাক্ষা বলে। যেটার চাষাবাদ বাংলাদেশে হয়ে থাকে। আর এই পোকার আক্রমণে কোন গাছ মারা যায়না। বিষয়টি স্বযং নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের একমাত্র লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মোকলেসুর রহমান।
কৃষি প্রযুক্তি বিষয় একাধিক বইয়ে দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, লাক্ষা এক ধরণের ক্ষুদ্র পোকা। এ পোকার ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে আঠালো রস নিঃসৃত হয়, যা ক্রমশ শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। পোষক গাছের ডালের এই আবরণই লাক্ষা নামে পরিচিত।
লবণাক্ত পানি থেকে জাহাজের তলদেশ রক্ষা বা লবণাক্ততায় নষ্ট হওয়া লৌহ ঠিক করার কাজে, অস্ত্র ও রেল কারখানার কাজে, কাঠের আসবাবপত্র ও পিতল বার্নিশ করা, স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণ, ঔষধের ক্যাপসুলের কোটিং, চকলেট ও চুইংগামের কোটিং, ডাকঘরের চিঠি বা পার্সেল সিলমোহরের কাজ, পুতুল, খেলনা, টিস্যু পেপার তৈরির কাজেসহ কমপক্ষে একশ ধরনের কাজে লাক্ষা পোকার আঠা ব্যবহার হয়।বর্তমান বিশ্বে ভারত একচেটিয়াভাবে লাক্ষার উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজার দখল করে রেখেছে। পৃথিবীর শতকরা ৭০ ভাগ লাক্ষাই ভারতে উৎপাদিত হয়। ভারতের পশ্চিমবাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও আসাম প্রদেশেই বেশীরভাগ লাক্ষা উৎপাদন হয়।
বর্তমানে আধুনিক বিশ্বে লাক্ষার নানাবিধ ব্যবহার বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগেও দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এর ব্যবহারের গুরুত্বের দিকটি ব্যাপক জনগোষ্ঠির নজরে না আসার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে গুজব সৃষ্টি করে অনেকে প্রতারণার মাধ্যমে একটি কুচক্রী মহল এটি অধিক মুনাফা লাভের আশায় ভারতে পাচার করতে পারে। একারণে স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি করেছেন উদ্ভিদবিদরা।
ভাইরাস পোকা ব্যবসায়ী মিঠুর কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানাতে অস্বীকার করে বলেন, আমি অন্যকে বলে দিলে আমার ব্যবসায় ক্ষতি হবে। এছাড়াও আরো দুই-তিনজন এই ব্যবসায় প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। তবে কেউ স্বীকার করছেন না কোথায় যাচ্ছে ভাইরাস পোকা।
এলাকাবাসী বলছেন, যারা মূলত জানে তারাই গোপনে এগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে বাজারে। এতে অনেককেই আবার লোকসান গুনতে হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, বর্তমানে কুষ্টিয়া, বগুড়া, ফেনীতে পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ভাইরাস পোকা। কিন্তু এই ভাইরাস পোকা দিয়ে কী হচ্ছে তা কেউ জানে না।
এত ভাইরাস পোকা কোন মোকামে পাঠায় ব্যবসায়ীরা, বা এগুলো কি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, পিকআপ-ট্রাক ভর্তি করে এগুলো বগুড়া ও কুষ্টিয়াতে পাঠায় বলে ব্যবসায়ীদের থেকে শুনেছেন তারা। তবে আসলে ঠিক কোথায় যায় আর কি কাজে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে তা তাদের জানা নেই। তবে লোক মুখে এগুলো দিয়ে এক ধরণের আঠা ও আসবাবপত্রের রং তৈরি হচ্ছে বলে শুনেছেন তারা।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি ও উড টেকনোলজি বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. আসাদুজ্জামান বিভিন্ন গবেষণা করেছেন। তিনি জানান, খুলনা সাতক্ষীরার কয়েকটি উপজেলায় রেইনট্রি গাছের উপর গবেষণা করে এবং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে জানতে পারেন ডাইব্যাগ বা আগামরা রোগ থেকে গাছের ডাল মারা যাচ্ছে, এমনকি গাছও মারা যাচ্ছে। এই সমস্যা খুলনা অঞ্চলে প্রথম দেখা দেয় ২০১৬-১৭ সালে।
তিনি জানান, পানিতে লবণ বেশি থাকায় বা গাছের নিচে পানি জমে থাকায় এই রোগ দেখা দিতে পারে।
হঠাৎ রোড শিরিস গাছের ডালে এপোকা দেখা দেওয়ার কারণ কী হতে পারে? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আম, বরই, বাবলা ও কড়ই গাছে সাধারণত লাক্ষা দেখা যায়। কিন্তু, লাক্ষা সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাবে কৃষকরা গাছে নানাবিধ কীটনাশক ব্যবহার করাই লাক্ষা তাদের আবাস্থল হারাচ্ছে। আর একারনে হয়তোবা এ পোকাটি রোড শিরিস গাছে দেখা যাচ্ছে বলে জানান তিনি।অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শিল্পজাত পণ্য লাক্ষা পোকার চাষ সম্প্রসারণের বিরাট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দেশের শুধুমাত্র রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জের ভিতরে লাক্ষা চাষ সীমাবদ্ধ রয়েছে।
তিনি জানান, অনেক সময় এই ধরনের গাছে আঠালো কেমিক্যাল কম্পাউন্ড পাওয়া যায় যেটা অনেকেই সংগ্রহ করে তবে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু সেটা জানা নেই। তবে এসকল বিষয় নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব






















