০৬:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কর্ণফুলী টানেলে আমূল পরিবর্তন আসবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার

  • নাজমুল ইসলাম
  • প্রকাশিত : ০৮:২১:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • 46

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলের উদ্বোধন হবে আগামী ২৮ অক্টোবর। উদ্বোধনের পরদিনই টানেলের ভেতরে যান চলাচল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। চার লেনবিশিষ্ট দেশের প্রথম এই টানেলে যানবাহন চলাচলের অপেক্ষা মাত্র।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ‘সুড়ঙ্গপথ’ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর চেয়ে অনেক কম খরচে কর্ণফুলীর ওপর দিয়ে সেতু করা যেত। কিন্তু সেটি না করে কেন টানেল করতে হলো? এই প্রশ্নের জবাবে সম্ভাব্য তিনটি কারণের কথা জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রকৌশলীরা বলছেন, টানেলের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হলে সবার আগে এর ভৌগলিক অবস্থানটা মাথায় নিতে হবে। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তে টানেলটি শুরু হয়েছে নেভাল একাডেমির পাশ থেকে। শেষ হয়েছে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে। সেখানে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে টানেলটি নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে টানেলটি অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে। এই সুড়ঙ্গপথটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হবে। টানেলটি চালু হলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া ও চন্দনাইশসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার জেলার যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক আমূল পরিবর্তন আসবে।

সেতু না করে টানেল নির্মাণের যুক্তি তুলে ধরতে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এটা এমন একটা স্থান, যেখান দিয়ে চট্রগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচল করে। এখান দিয়ে সেতু হলে তা জাহাজ চলাচলে অবশ্যই বিঘ্ন ঘটাবে। অর্থাৎ, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশমুখে একটা সেতু থাকা বেশ ঝামেলার ব্যাপার।

আরেকটি বিষয় হলো, কর্নফুলী নদীর ওপর একাধিক সেতু রয়েছে। অধিকাংশ সেতু চট্টগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। কক্সবাজারগামী যানবাহনকেও এসব সেতু ব্যবহার করতে হয়, যা সড়কে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। তাই এই ট্যানেল ও এর সংযোগ সড়ক শহরের বাইরে সমুদ্রতীরে স্থাপন করা হয়েছে যেন শহরের উপর থেকে দুরপাল্লার যানবাহনের চাপ কমে। অনেকেই মনে করেন, টানেল করার পেছনে নান্দনিক বিষয়ও আছে। সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক দৃষ্টিনন্দন সেতু স্থাপন করেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও নদীর নিচে এত বড় কোনো ট্যানেল তৈরি হয়নি। সুতরাং টানেলটি বাংলাদেশের জন্যে গর্বের ও সম্মানের হবে।

সেতু না করে টানেল নির্মাণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বিজনেস বাংলাদশকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে শাহ আমানত সেতু রয়েছে। আরেকটি সেতু আছে কালুর ঘাটে। সেই সেতু দুটির প্রভাবে নদীতে পলি জমে নাব্য সংকট তৈরি হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নতুন করে যেন নদীর ক্ষতি না হয়, সে জন্যই টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে।’

আমিরুল হক আরও বলনে, ‘প্রকল্পটির কথা চিন্তা করে দক্ষিণ চট্টগ্রামে নদীটির অপর প্রান্তে আনোয়ারা অংশে ৭২টি ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর প্রভাবে ওই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এ টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে চীনের সহায়তা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ২ শতাংশ হারে এ ঋণ দিয়েছে। চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
দুটি টিউব সম্বলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টানেলটি দুটি টিউবে চার লেনবিশিষ্ট। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটারের ওভারব্রিজ রয়েছে।

২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এক নির্বাচনী সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। ২০১৭ সালে শুরু হয় মূল টানেল নির্মাণকাজ।

বিজনেস বাংলাদেশ/এনআই

জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

কর্ণফুলী টানেলে আমূল পরিবর্তন আসবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার

প্রকাশিত : ০৮:২১:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলের উদ্বোধন হবে আগামী ২৮ অক্টোবর। উদ্বোধনের পরদিনই টানেলের ভেতরে যান চলাচল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। চার লেনবিশিষ্ট দেশের প্রথম এই টানেলে যানবাহন চলাচলের অপেক্ষা মাত্র।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ‘সুড়ঙ্গপথ’ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর চেয়ে অনেক কম খরচে কর্ণফুলীর ওপর দিয়ে সেতু করা যেত। কিন্তু সেটি না করে কেন টানেল করতে হলো? এই প্রশ্নের জবাবে সম্ভাব্য তিনটি কারণের কথা জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রকৌশলীরা বলছেন, টানেলের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হলে সবার আগে এর ভৌগলিক অবস্থানটা মাথায় নিতে হবে। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তে টানেলটি শুরু হয়েছে নেভাল একাডেমির পাশ থেকে। শেষ হয়েছে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে। সেখানে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে টানেলটি নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে টানেলটি অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে। এই সুড়ঙ্গপথটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হবে। টানেলটি চালু হলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া ও চন্দনাইশসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার জেলার যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক আমূল পরিবর্তন আসবে।

সেতু না করে টানেল নির্মাণের যুক্তি তুলে ধরতে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এটা এমন একটা স্থান, যেখান দিয়ে চট্রগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচল করে। এখান দিয়ে সেতু হলে তা জাহাজ চলাচলে অবশ্যই বিঘ্ন ঘটাবে। অর্থাৎ, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশমুখে একটা সেতু থাকা বেশ ঝামেলার ব্যাপার।

আরেকটি বিষয় হলো, কর্নফুলী নদীর ওপর একাধিক সেতু রয়েছে। অধিকাংশ সেতু চট্টগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। কক্সবাজারগামী যানবাহনকেও এসব সেতু ব্যবহার করতে হয়, যা সড়কে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। তাই এই ট্যানেল ও এর সংযোগ সড়ক শহরের বাইরে সমুদ্রতীরে স্থাপন করা হয়েছে যেন শহরের উপর থেকে দুরপাল্লার যানবাহনের চাপ কমে। অনেকেই মনে করেন, টানেল করার পেছনে নান্দনিক বিষয়ও আছে। সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক দৃষ্টিনন্দন সেতু স্থাপন করেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও নদীর নিচে এত বড় কোনো ট্যানেল তৈরি হয়নি। সুতরাং টানেলটি বাংলাদেশের জন্যে গর্বের ও সম্মানের হবে।

সেতু না করে টানেল নির্মাণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বিজনেস বাংলাদশকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে শাহ আমানত সেতু রয়েছে। আরেকটি সেতু আছে কালুর ঘাটে। সেই সেতু দুটির প্রভাবে নদীতে পলি জমে নাব্য সংকট তৈরি হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নতুন করে যেন নদীর ক্ষতি না হয়, সে জন্যই টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে।’

আমিরুল হক আরও বলনে, ‘প্রকল্পটির কথা চিন্তা করে দক্ষিণ চট্টগ্রামে নদীটির অপর প্রান্তে আনোয়ারা অংশে ৭২টি ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর প্রভাবে ওই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এ টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে চীনের সহায়তা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ২ শতাংশ হারে এ ঋণ দিয়েছে। চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
দুটি টিউব সম্বলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টানেলটি দুটি টিউবে চার লেনবিশিষ্ট। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটারের ওভারব্রিজ রয়েছে।

২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এক নির্বাচনী সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। ২০১৭ সালে শুরু হয় মূল টানেল নির্মাণকাজ।

বিজনেস বাংলাদেশ/এনআই