০৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

আজ ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস

আজ ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রংপুরের বীর-জনতার অবিস্মরণীয় দিন।

১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার মাত্র এক দিন পর আজকের এই দিনে বাঁশের লাঠি ও বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করেছিলেন শত শত সাধারণ মানুষ। সেদিন রংপুরের বীরজনতা জীবনবাজি রেখে বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক হাতে ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগানে সজ্জিত পাক সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে রংপুর ক্যন্টনমেন্ট ঘেরাও করে শুধু ইতিহাসই সৃষ্টি করেনি, জন্ম দিয়েছিলেন এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনার। তাদের বীরত্বগাথা পৃথিবীর সব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অবাক করে দিয়েছিল তারা। এদিন ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে এসে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন রংপুরের অগণিত মুক্তিকামী বীর জনতা।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের মানুষ প্রস্তুতি শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রামের। এরই অংশ হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও-এর মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষ। দিনক্ষণও ঠিক হয় ২৮ মার্চ। সেই ঘেরাও অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রীতিমতো বিভিন্ন হাটবাজারে ঢোল পেটানো হয়। এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়াও মেলে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারদিকে। ৭১-এর ২৫ মার্চ দেশজুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নিরীহ বাঙালিদের হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর প্রতিবাদে সারাদেশে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা দেয়, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের মধ্য দিয়ে। এই দিন রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ যেন একেকজন ‘নুরুল দীনের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বেলা ১১টার দিকে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে একত্রিত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, মানজাই, রানীপুকুরহাট, রূপসী, তামপাট, জয়রাম আনোয়ার, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গণেশপুর, দামোদরপুর, বড়বাড়ি, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জ ও বাহার কাছনাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের একটাই দাবি, তারা ক্যান্টনমেন্ট দখল করবেন। এদিন সবচেয়ে মারমুখি ভূমিকা ছিল মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর এলাকার আদিবাসী মুক্তিকামী সাঁওতালদের। তাদের তীর, ধনুক, বল্লমের শাণিত ফলা ভর দুপুরের রোদে চকচক করছিল। বিক্ষুব্ধ জনতাকে সেদিন কেউ ঠেকাতে পারেনি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সেই সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কমর্রত ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সেদিনের বর্ণনায় লিখেছেন, যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা চমকে যাওয়ার মতোই। দক্ষিণ দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ সারি বেধে এগিয়ে আসছে সেনা ছাউনির দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দা-কাঁচি, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লমের মতো অতি সাধারণ সব অস্ত্র। বেশ বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্থানীয়। সারি বাধা মানুষ পিঁপড়ার মতো লাঠিসোঠা বল্লম হাতে ক্রমেই এগিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। মাত্র ৫ মিনিটে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। লাশের পর লাশ পড়ে থাকে মাঠে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনেহিঁচড়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তখনো যারা বেঁচে ছিল তাদের গোঙ্গানিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবি জান্তারা। এ অবস্থাকে আয়ত্বে আনার জন্য বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরতরে তাদের থামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

তিনি বর্ণনায় আরও লিখেছেন, আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশ মতো ৫ থেকে ৬০০ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আগুনে পুড়ে যায় স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানব সন্তান।

ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনে মূল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন সেই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি সিদ্দিক হোসেন (প্রয়াত)। এ ছাড়া এ আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, নুরুল হক এমপিএ (প্রয়াত), আবদুল গণি (প্রয়াত), ইসাহাক চৌধুরী (শহীদ), আলতাফ হোসেন (প্রয়াত), শেখ আমজাদ (প্রয়াত), তৈয়বুর রহমান (প্রয়াত), মজিবর রহমান মাস্টার, হামিদুজ্জামান (প্রয়াত), এমপিএ, গাজী রহমান এমপিএ (প্রয়াত), নুরুল ইসলাম (প্রয়াত), মজিবর রহমান মতি মিয়া (প্রয়াত), গোলাম কিবরিয়া (প্রয়াত), ডা. আফতাব তালুকদার (প্রয়াত), লোকমান উদ্দিন ঠিকাদার (প্রয়াত), সাংবাদিক নোয়েজস হোসেন খোকা (প্রয়াত), আবদুল মান্নান খলিফা (প্রয়াত), শেখ আমজাদ হোসেন (প্রয়াত) প্রমুখ।

এছাড়াও ছাত্রলীগ নেতামের মধ্যে রফিকুল ইসলাম গোলাপ (প্রয়াত), হারেস উদ্দিন সরকার (প্রয়াত), ইলিয়াস আহমেদ, অলক সরকার, আবদুল আউয়াল টুকু (প্রয়াত), মুখতার ইলাহী (শহীদ), নুরুল হাসান (প্রয়াত), আকবর আলী (প্রয়াত), জায়েদুল হক (প্রয়াত), ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের মধ্যে নুর আহমেদ টুলু (প্রয়াত), ভাসানী ন্যাপ নেতাদের মধ্যে অন্যতম ভূমিকা রাখেন মাহফুজ আলী জররেজ মিয়া (শহীদ), ছয়ের উদ্দিন (প্রয়াত) প্রমুখ।

সেই বীরত্বগাথা ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ১৯৯৮ সালের ২৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবসে শহীদদের স্মরণে শহরের উপকণ্ঠ ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ এলাকায় ‘রক্ত গৌরব’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান রংপুরের সন্তান জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বীরবিক্রম ওই স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন।

প্রতি বছর জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় এলাকাবাসীর নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। রংপুরবাসী এই দিনে ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে সাহসী বীর বাঙালি শহীদদের ফুল দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে।

২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক সেদিনের শত শত দেশপ্রেমী জনতার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি আজও মেলেনি। প্রতি বছর ২৮ মার্চ এলে অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে এসব বীর শহীদদের আত্মত্যাগ। তাই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারগুলো।

এ বিষয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনের নেতা প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমানের সন্তান রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সেদিনের রংপুরবাসীর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের স্বীকৃতি আজও মেলেনি। আমরা আশা করবো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় আছে। তাই এই সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি উদযাপনের আহবান জানাই।

বিজনেস বাংলাদেশ/একে

আজ ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস

প্রকাশিত : ০৪:১৩:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

আজ ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রংপুরের বীর-জনতার অবিস্মরণীয় দিন।

১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার মাত্র এক দিন পর আজকের এই দিনে বাঁশের লাঠি ও বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করেছিলেন শত শত সাধারণ মানুষ। সেদিন রংপুরের বীরজনতা জীবনবাজি রেখে বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক হাতে ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগানে সজ্জিত পাক সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে রংপুর ক্যন্টনমেন্ট ঘেরাও করে শুধু ইতিহাসই সৃষ্টি করেনি, জন্ম দিয়েছিলেন এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনার। তাদের বীরত্বগাথা পৃথিবীর সব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অবাক করে দিয়েছিল তারা। এদিন ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে এসে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন রংপুরের অগণিত মুক্তিকামী বীর জনতা।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের মানুষ প্রস্তুতি শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রামের। এরই অংশ হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও-এর মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষ। দিনক্ষণও ঠিক হয় ২৮ মার্চ। সেই ঘেরাও অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রীতিমতো বিভিন্ন হাটবাজারে ঢোল পেটানো হয়। এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়াও মেলে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারদিকে। ৭১-এর ২৫ মার্চ দেশজুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নিরীহ বাঙালিদের হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর প্রতিবাদে সারাদেশে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা দেয়, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের মধ্য দিয়ে। এই দিন রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ যেন একেকজন ‘নুরুল দীনের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বেলা ১১টার দিকে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে একত্রিত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, মানজাই, রানীপুকুরহাট, রূপসী, তামপাট, জয়রাম আনোয়ার, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গণেশপুর, দামোদরপুর, বড়বাড়ি, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জ ও বাহার কাছনাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের একটাই দাবি, তারা ক্যান্টনমেন্ট দখল করবেন। এদিন সবচেয়ে মারমুখি ভূমিকা ছিল মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর এলাকার আদিবাসী মুক্তিকামী সাঁওতালদের। তাদের তীর, ধনুক, বল্লমের শাণিত ফলা ভর দুপুরের রোদে চকচক করছিল। বিক্ষুব্ধ জনতাকে সেদিন কেউ ঠেকাতে পারেনি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সেই সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কমর্রত ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সেদিনের বর্ণনায় লিখেছেন, যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা চমকে যাওয়ার মতোই। দক্ষিণ দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ সারি বেধে এগিয়ে আসছে সেনা ছাউনির দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দা-কাঁচি, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লমের মতো অতি সাধারণ সব অস্ত্র। বেশ বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্থানীয়। সারি বাধা মানুষ পিঁপড়ার মতো লাঠিসোঠা বল্লম হাতে ক্রমেই এগিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। মাত্র ৫ মিনিটে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। লাশের পর লাশ পড়ে থাকে মাঠে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনেহিঁচড়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তখনো যারা বেঁচে ছিল তাদের গোঙ্গানিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবি জান্তারা। এ অবস্থাকে আয়ত্বে আনার জন্য বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরতরে তাদের থামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

তিনি বর্ণনায় আরও লিখেছেন, আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশ মতো ৫ থেকে ৬০০ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আগুনে পুড়ে যায় স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানব সন্তান।

ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনে মূল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন সেই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি সিদ্দিক হোসেন (প্রয়াত)। এ ছাড়া এ আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, নুরুল হক এমপিএ (প্রয়াত), আবদুল গণি (প্রয়াত), ইসাহাক চৌধুরী (শহীদ), আলতাফ হোসেন (প্রয়াত), শেখ আমজাদ (প্রয়াত), তৈয়বুর রহমান (প্রয়াত), মজিবর রহমান মাস্টার, হামিদুজ্জামান (প্রয়াত), এমপিএ, গাজী রহমান এমপিএ (প্রয়াত), নুরুল ইসলাম (প্রয়াত), মজিবর রহমান মতি মিয়া (প্রয়াত), গোলাম কিবরিয়া (প্রয়াত), ডা. আফতাব তালুকদার (প্রয়াত), লোকমান উদ্দিন ঠিকাদার (প্রয়াত), সাংবাদিক নোয়েজস হোসেন খোকা (প্রয়াত), আবদুল মান্নান খলিফা (প্রয়াত), শেখ আমজাদ হোসেন (প্রয়াত) প্রমুখ।

এছাড়াও ছাত্রলীগ নেতামের মধ্যে রফিকুল ইসলাম গোলাপ (প্রয়াত), হারেস উদ্দিন সরকার (প্রয়াত), ইলিয়াস আহমেদ, অলক সরকার, আবদুল আউয়াল টুকু (প্রয়াত), মুখতার ইলাহী (শহীদ), নুরুল হাসান (প্রয়াত), আকবর আলী (প্রয়াত), জায়েদুল হক (প্রয়াত), ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের মধ্যে নুর আহমেদ টুলু (প্রয়াত), ভাসানী ন্যাপ নেতাদের মধ্যে অন্যতম ভূমিকা রাখেন মাহফুজ আলী জররেজ মিয়া (শহীদ), ছয়ের উদ্দিন (প্রয়াত) প্রমুখ।

সেই বীরত্বগাথা ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ১৯৯৮ সালের ২৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবসে শহীদদের স্মরণে শহরের উপকণ্ঠ ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ এলাকায় ‘রক্ত গৌরব’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান রংপুরের সন্তান জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বীরবিক্রম ওই স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন।

প্রতি বছর জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় এলাকাবাসীর নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। রংপুরবাসী এই দিনে ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে সাহসী বীর বাঙালি শহীদদের ফুল দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে।

২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক সেদিনের শত শত দেশপ্রেমী জনতার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি আজও মেলেনি। প্রতি বছর ২৮ মার্চ এলে অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে এসব বীর শহীদদের আত্মত্যাগ। তাই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারগুলো।

এ বিষয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনের নেতা প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমানের সন্তান রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সেদিনের রংপুরবাসীর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের স্বীকৃতি আজও মেলেনি। আমরা আশা করবো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় আছে। তাই এই সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি উদযাপনের আহবান জানাই।

বিজনেস বাংলাদেশ/একে