কিছুতেই স্বস্তি ফিরছে না লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজারে; সপ্তাহ ব্যবধানে অস্থির হয়ে ওঠেছে আবারও। দাম বেড়ে গেছে মাছ ও শাক-সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কদিনের টানা বৃষ্টিতে ব্যাহত হয়েছে সরবরাহব্যবস্থা। এতেই সব নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ও আগানগর এবং রাজধানীর নয়াবাজার ও কারওয়ান বাজারসহ বেশ কটি কাঁচাবাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়।
গত কদিনের টানা বৃষ্টিতে লাগামছাড়া রাজধানীর সবজির বাজার। হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া কেজিপ্রতি ৫-১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে প্রায় প্রতিটি সবজির দাম। বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন ৮০-১০০ টাকা, করলা ৬০-৭০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৫০ টাকা, বরবটি ৮০-১০০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, লতি ৬০-৮০ টাকা, কহি ৬০ টাকা ও পটোল ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি পেঁপে ২৫-৩০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, গাজর ১৬০ টাকা, কচুরমুখী ৮০ টাকা, টমেটো ১৬০ টাকা, শিম ২৫০-৩০০ টাকা ও শসা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়।
এছাড়া প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়, আর প্রতি পিস ফুলকপি ৭০ টাকা ও প্রতি পিস লাউয়ের জন্য গুনতে হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা। বাজারে লালশাকের আঁটি ২০ টাকা, পাটশাক ১৫ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা, লাউশাক ৪০ টাকা, মুলাশাক ২০ টাকা, ডাঁটাশাক ২০ টাকা, কলমিশাক ১০-১৫ টাকা ও পালংশাক ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, সম্প্রতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বাজারে সরবরাহ কমায় দাম বাড়তি। রাজধানীর নয়াবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. সোলাইমান বলেন, বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষেত ডুবে গেছে। তাছাড়া, পর্যাপ্ত পণ্যও আসতে পারেনি গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে। ফলে দাম কিছুটা বাড়তিই।
আর ক্রেতারা জানান, সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। ফয়সাল নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, সবজির দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রায় সব কটির দামই সেঞ্চুরি হাঁকাবে। ব্যবসায়ীরা শুধু অজুহাত খোঁজেন দাম বাড়ানোর। এতে যে ভোক্তার কষ্ট হয়, সেটি তারা বিবেচনা করেন না।
আরেক ক্রেতা আলমগীর বলেন, চাঁদাবাজি কমলেও সরকার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি এখনও। তারাই নানা ছুতোয় কলকাঠি নাড়ছে। এতে বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কষ্ট।
কাঁচামরিচের দাম ওঠানামা করছে। গত সপ্তাহে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কাঁচামরিচের দাম নেমে এসেছিল ১৬০-১৮০ টাকায়। এ সপ্তাহে সেটি আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০-২৪০ টাকায়।
মরিচ ব্যবসায়ী হাসনাত বলেন, গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে আবারও বাড়তে শুরু করেছে কাঁচামরিচের দাম। খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৬০-৮০ টাকা পর্যন্ত। আর পাইকারিতে বর্তমানে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) মরিচ ৮০০-৯০০ টাকায় কেনাবেচা চলছে।
তবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই মাছের দামে। বেশিরভাগ মাছ বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। প্রতি কেজি রুই বিক্রি হচ্ছে ৩৬০-৩৮০ টাকায়। এছাড়া, চাষের পাঙাশ প্রতি কেজি ২০০-২২০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০-২৫০ টাকা, চাষের কৈ ২৪০-২৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০-৬০০ টাকা, কোরাল ৭০০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, বোয়াল ৭০০ টাকা, আইড় ৭৫০-৮০০ টাকা ও পাবদা ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাজারে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজি হারে ২২০০-২৩০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৭০০-১৮০০। আর ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিতে ১৫০০-১৬০০ টাকা ও ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের জন্য কেজিতে গুনতে হচ্ছে ১২০০-১৩০০ টাকা পর্যন্ত।
মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে ইলিশ রফতানি ও সামনের মাসে ইলিশ ধরা বন্ধকে কেন্দ্র করে মজুত শুরু করেছেন আড়তদাররা। এজন্য দাম কমছে না ইলিশের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ বলেন, অনেকেই এখন ইলিশ মজুত করা শুরু করেছেন। সামনে দুর্গাপূজা, আর আগামী মাস থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে ২২ দিনের জন্য। মাছটি মজুতের প্রবণতা শুরু হওয়ায় বাজারে কমছে এর সরবরাহ; ফলে দাম বাড়ছে।
বাজারে বেড়ে গেছে আদা-রসুনের দামও। প্রতি কেজিতে ৫-১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন ২৪০ টাকা, আমদানি করা রসুন ২৬০ টাকা ও মানভেদে আদা বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৮০ টাকায়।
আর পাইকারিতে কেজিতে ২-৩ টাকা দাম কমলেও বড় সুখবর নেই খুচরা পেঁয়াজের বাজারে। কয়েকটি দোকানে কিছুটা কমে বিক্রি হলেও বেশিরভাগ দোকানেই বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকায়। এছাড়া, ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা ও পাকিস্তানি পেঁয়াজ ৯৫-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে মাত্র আসতে শুরু করেছে ভারতীয় পেঁয়াজ। তবে চাহিদা তেমন একটা নেই। মানুষ দেশি পেঁয়াজের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। তাই দামে এখনও তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। তবে সামনে দাম কমবে।
এদিকে, সরকার ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেয়ার পর আরও চড়েছে বাজার। বিক্রেতারা বলছেন, দাম নির্ধারণের আগে বাজারে কম দামেই বিক্রি হয়েছে ডিম ও মুরগি। কিন্তু দাম বেঁধে দেয়ার পর খামারিরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর প্রভাবে বাজারও চড়া।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী দিদার বলেন, বাজারে কোনো ঘাটতি নেই। সরকার দাম বেঁধে দেয়ার পর থেকেই পাইকারি বাজার ঊর্ধ্বমুখী। কারণ দাম বেঁধে দেয়ার পর খামারিরাও লাভের আশায় দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর প্রভাবে খুচরা বাজারেও দাম বেড়েছে। তবে চলতি সপ্তাহে দাম কিছুটা স্থিতিশীল মনে হচ্ছে।
বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০-১৯০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৫০-২৮০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৪০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়। এছাড়া, জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৬০০ টাকায়।
অপরিবর্তিত আছে গরু ও খাসির মাংসের দাম। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়। এছাড়া, প্রতি কেজি খাসির মাংস ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা এবং ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়।
এদিকে, ডজনে ৫ টাকা বেড়েছে ডিমের দাম। বাজারে মুরগির প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা, আর সাদা ডিম ১৬০ টাকায়। আর প্রতি ডজন হাঁসের ডিম ২৩০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই চড়া চালের দাম। বর্তমানে মিনিকেট ৭১-৭২ টাকা, আটাশ চাল ৫৭-৫৮ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকা, পাইজাম ৫৬-৬০ টাকা, সুগন্ধী চিনিগুঁড়া পোলাওর চাল ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী রাকিব বলেন, গত এক-দেড় মাস ধরেই চড়া চালের বাজার। নতুন করে না বাড়লেও দাম কমেনি।
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পান।
আর বিক্রেতারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।