রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলে মনির আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর অফিসে প্রবেশ করে চাঁদা চেয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার নেপথ্যে উঠে এসেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলালের সহযোগীদের নাম। যদিও সন্ত্রাসীরা গুলি করার সময় বারবার ‘ক্যাপ্টেন ইমন’-এর নাম বলেছিল। ঘটনার তিনদিন আগে একটি বিদেশি নম্বর থেকে ব্যবসায়ীকে ফোন করে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্যাপ্টেন ইমনের পরিচয় দিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়।
ঘটনার আগের দিন তিনবার একই নম্বর থেকে ফোন করা হয়। ওই আবাসন ব্যবসায়ী ফোন না ধরায় পরদিন অর্থাৎ ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ইফতারের পর তিনজন মুখোশ পরে মোটরসাইকেলে করে অফিসে এসে সরাসরি গুলি চালায়। এরপরও চাঁদা না দেওয়ায় ২৮ এপ্রিল দিনদুপুরে দুজন মোটরসাইকেলে এসে সেই আবাসন ব্যবসায়ীর বাসায় ফের গুলি চালায়। তবে, ওই দুই ঘটনায় কেউ গুলিবিদ্ধ হননি।
প্রথম ঘটনায় জাহিদ হোসেন মোড়লের অন্যতম সহযোগী জাভেদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। জাভেদ শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় গুলির ঘটনায় গত ৮ মে টাউন হল এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন জাহিদ হোসেন মোড়লের আরেক সহযোগী মোহাম্মদ হাসান মাহমুদ।
শুধু টাউন হল নয়, ওই ঘটনার আগে অর্থাৎ ১৬ মার্চ বিকেল ৩টার পর একই গ্রুপের সদস্যরা লালমাটিয়ার জাকির হোসেন রোডের মাঠের পাশে একটি ইন্টারনেট অফিস দখলে নিতে গুলি চালায়। চাঁদা না দেওয়ায় লালমাটিয়ার ময়লার লাইনও (ময়লা সংগ্রহের কাজ) গুলি করে দখলে নেয় জাহিদ মোড়ল। তবে, ওই দুই ঘটনায় থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগ না হওয়ায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
পিচ্চি হেলালের মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় সাম্রাজ্য দেখভাল করেন জাহিদ মোড়ল, লিটন মাহমুদ বাবু ওরফে তেরেনাম বাবু, মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসান, ওয়াহিদুল হাসান দিপু, মফিজ উদ্দিন মফি, মজিদ ওরফে ভাঙারি মজিদ, দোলন, রিয়াজ, সালাউদ্দিন, ভাগনে শুভ, গিট্টু রানা, সাব্বির, চিকু শাকিল, দিপু, হাসান, জুয়েল, রাসেল, ইউসুফ, পেটকা তুহিন, ফালান, দিদার, মো. জুয়েল ও রফিক। শেরশাহ সুরি রোডে গুলির ওই ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল লালমাটিয়ার স্বপ্নপুরীর পাশের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত জাভেদকে গ্রেপ্তার করে।
গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে মোহাম্মদপুরের টাউন হলের শেরশাহ সুরি রোডের আবাসন ব্যবসায়ীর অফিসে ঢুকে মুখোশ পরে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় আসে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা। মোহাম্মদপুর এলাকায় এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ভাঙিয়ে অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের এমন কর্মকাণ্ডে পুরো এলাকাজুড়ে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
জানা যায়, গত ২০ মার্চ রাত ১২টা ৭ মিনিটে একটি বিদেশি নম্বর (+৯৭৪৬৬৬৩৭…) থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে মনির আহমেদ নামে ওই ব্যবসায়ীকে ‘ক্যাপ্টেন ইমন’ পরিচয় দিয়ে ঈদের সালামি চাওয়া হয়। ২২ মার্চ আবারও কয়েক দফায় সেই নম্বর থেকে ফোন করা হয়। সেই সময় ফোন না ধরায় ২৪ মার্চ (সোমবার) সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে একটি মোটরসাইকেলে তিনজনের একটি সন্ত্রাসী দল ওই ব্যবসায়ীর অফিসে এসে প্রকাশ্যে গুলি করে। তিনি মোহাম্মদপুর এলাকার চন্দ্রিমা হাউজিং নামে একটি আবাসন ব্যবসার পরিচালক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শেরশাহ সুরি রোডে ওই ব্যবসায়ীর বাসার নিচতলার অফিসে এসে গুলি করা ব্যক্তিরা শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলালের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত জাহিদ মোড়লের লোক। তারা মোটরসাইকেলে করে আসেন এবং অফিসে প্রবেশ করে গুলি করেন। গুলি করা ব্যক্তির নাম রুবেল এবং গুলি করার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করেন কালো গেঞ্জি পরিহিত শাওন। এছাড়া মোটরসাইকেলে বসে বাইরে অপেক্ষা করেন জাভেদ। তারা জাহিদ মোড়লের সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
জানা যায়, পিচ্চি হেলালের মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় সাম্রাজ্য দেখভাল করেন জাহিদ মোড়ল, লিটন মাহমুদ বাবু ওরফে তেরেনাম বাবু, মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসান, ওয়াহিদুল হাসান দিপু, মফিজ উদ্দিন মফি, মজিদ ওরফে ভাঙারি মজিদ, দোলন, রিয়াজ, সালাউদ্দিন, ভাগনে শুভ, গিট্টু রানা, সাব্বির, চিকু শাকিল, দিপু, হাসান, জুয়েল, রাসেল, ইউসুফ, পেটকা তুহিন, ফালান, দিদার, মো. জুয়েল ও রফিক। শেরশাহ সুরি রোডে গুলির ওই ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল লালমাটিয়ার স্বপ্নপুরীর পাশের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত জাভেদকে গ্রেপ্তার করে।
গুলির ওই ঘটনায় অনুসন্ধানে আজকের বিজনেস বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাভেদের ব্যবহৃত মোবাইলে আবাসন ব্যবসায়ী মনির আহমেদকে যেই বিদেশি নম্বর (+৯৭৪৬৬৬৩৭…) থেকে ফোন দেওয়া হয়েছিল সেই নম্বরটির সঙ্গে একাধিকবার কথা হয় গ্রেপ্তার জাহিদ মোড়লের অন্যতম সহযোগী জাভেদের। জাভেদের ফোনে সেই বিদেশি নম্বরটি ‘ThE FiNaL CoUnT dOwN’ দিয়ে সেভ করা রয়েছে।
ওই বিদেশি নম্বরের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে জাভেদের কথা বলার স্ক্রিনশটও এসেছে সাংবাদিকের হাতে। বর্তমানে জাভেদ কারাগারে এ বিষয়ে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, আবাসন ব্যবসায়ী মনিরের কাছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্যাপ্টেন ইমন পরিচয়ে চাঁদা দাবি করে বিদেশি একটি নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল আসে। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পরে অর্থাৎ ঘটনা ঘটার ঠিক ২০ মিনিট পরে একজন ডিশ লাইন ব্যবসায়ীর নম্বর থেকে কল আসে ব্যবসায়ী মনিরের মোবাইলে।
অপর প্রান্তে থাকা ওই ডিশ ব্যবসায়ী বলেন, ‘মনির ভাই, আপনি জাহিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেন।’ পরে জাহিদ মোড়লের সঙ্গে কথা বলেন আবাসন ব্যবসায়ী মনির। কথার একপর্যায়ে মনির বলেন, ‘আমি একটু ঝামেলায় আছি, পরে কথা বলব।’ তখন অপরপ্রান্ত থেকে জাহিদ মোড়ল বলেন, ‘কী সমস্যা হয়েছে?’ তিনি (মনির) বলেন, ‘ভাই আমার অফিসে এসে কারা যেন গুলি করেছে।
বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। মূলত জাহিদ মোড়ল তার (মনির আহমেদ) বাসায় গুলি করা হয়েছে কি না, বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকজনের নম্বর দিয়ে মনির আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন। এতেই বোঝা যায় গুলির ঘটনাটি জাহিদ মোড়লই ঘটিয়েছেন— মনে করেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে, আবাসন ব্যবসায়ীর বাসায় চাঁদার দাবিতে গুলির ঘটনায় গ্রেপ্তার জাভেদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। বর্তমানে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ তদন্ত করছেন।
দ্বিতীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. মোশারফ জানান, মোহাম্মদপুরের টাউন হল শেরশাহ সুরি রোডের ব্যবসায়ী মনির আহমদের বাসায় গুলির ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি মো. হাসানকে গাঁজা ও মদের বোতলসহ গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনীর একটি দল। পরে তাকে মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মাদকসহ আরও কয়েকটি মামলা হয়। গুলির ঘটনায়ও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
গুলির ঘটনায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হবে— বলেও জানান তিনি।
ডিএস./