৫ আগস্টের পরই তো বটেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এত বড় সমাবেশ করলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সারাদেশ থেকে শনিবার (১৯ জুলাই) দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মী জড়ো হন এই সমাবেশে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি তাদের বড় অর্জন হলেও দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন দিকে প্রবাহিত হয় সেটিই এখন দেখার বিষয়।
সমাবেশ থেকে সাত দফা বাস্তবায়ন দাবি
পিআর পদ্ধতিতে ভোট, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টসহ অন্যান্য সময় সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্রের সব স্তরে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও ভোটের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাসহ আরও বেশকিছু দাবি তুলে ধরেন বক্তারা।
দুপুরে শুরু হয় সমাবেশের মূল পর্ব। এর আগেই মঞ্চে এসে উপস্থিত হন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে মঞ্চে উঠেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। বক্তব্যের এক পর্যায়ে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় উঠে দাঁড়ালেও আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে যান তিনি। পরে বসেই বক্তব্য শেষ করেন জামায়াত আমির।
সমাবেশ থেকে যে বার্তা দিলো জামায়াত
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন জনগণের জন্য লড়াই অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ আমাদের যদি সুযোগ দেন তাহলে মালিক হবো না, সেবক হবো। আমরা ঘোষণা দিচ্ছি, জামায়াত থেকে আগামীতে যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, তারা কোনো সরকারি উপহার নেবেন না। এমপি-মন্ত্রীরা সরকারি প্লট বরাদ্দ নেবেন না, ট্যাক্সবিহীন গাড়িতেও চড়বেন না। নিজ হাতে সরকারি বরাদ্দের টাকা চালাচালিও করবেন না’।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘তারা (জামায়াতের এমপি-মন্ত্রী) নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে তার বিবরণ তুল ধরতে বাধ্য হবেন। চাঁদা আমরা নেবো না, দুর্নীতি আমরা করবো না। চাঁদা নিতে দেবো না, দুর্নীতি আমরা সহ্য করবো না’।
সমাবেশে এলেন যারা
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী, সমর্থক তো ছিলই সমাবেশে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও। দলটি সমমনা বিভিন্ন দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানান এই সমাবেশে। তাদের অনেকে বক্তব্যও রাখেন বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে। তবে একসময়ের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি সমাবেশে।
সমাবেশ থেকে যে বার্তা দিলো জামায়াত
সমাবেশে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের অনেকেই জামায়াতের সাত দফার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
সমাবেশে উপস্থিত ছিল না একসময়ের জোটসঙ্গি বিএনপি
১৯৯৯ সালের পর সখ্যতা বাড়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট গঠন করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত একসঙ্গে সরকার পরিচালনা করে দল দুটি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতার ভিত্তিতে দুই দল আলাদা হয়ে যায়। গতবছর জুলাই অভ্যুত্থানে দল দুটি অংশ নিলেও ৫ আগস্টের পর মোড় পাল্টে যায়।
এই সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ নিশ্চিত করেন। অন্যদিকে, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, পিআরের পক্ষে থাকা দলগুলোকে কেবল এই সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
স্পষ্টতই বিএনপি এই পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। অথচ জামায়াতে ইসলামী শনিবারের সমাবেশ থেকে এই পদ্ধতিতেই ভোটের পক্ষে তার অবস্থান আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে।
সমাবেশ থেকে যে বার্তা দিলো জামায়াত
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান বলেন, যারা দেশে সত্যিকার অর্থে সংস্কার চায়, নির্বাচনকে অর্থবহ করতে চায়, তারা একমঞ্চে এসেছেন। তার ভাষায়, কিছু রাজনৈতিক দল কেবলমাত্র ক্ষমতার স্বার্থে নির্বাচন চায়। তার বিরুদ্ধে এই সমাবেশ গুরুত্ব বহন করে।
সমাবেশ থেকে যে বার্তা দিলো জামায়াত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান ডয়েচে ভেলেকে বলেন, জামায়াত আগে থেকেই চাইছে একটি সম্মিলিত বিরোধী দল গড়ে তুলতে, যার প্রধান ফোর্স হবে ইসলামী দলগুলো। ফলে যেসব কওমি মাদরাসাভিত্তিক দলের সঙ্গে তাদের বিরোধিতা ছিল তাদের কাছে টানছে। এর বাইরে এনসিপির মতো আরও কিছু দলকে তারা সঙ্গে নিতে চায়। এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে জামায়াত তার অবস্থানের কথা জানান দিলো।
৫ আগস্টের পর নারীদের বিষয়ে জামায়াতের কৌশলগত অবস্থান দেখা গেলেও এত বড় সমাবেশে তাদের অনুপস্থিতির বিষয়টিও নজরে এসেছে অনেকের। যদিও দলটির এক নেতা জানান, মহিলাদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় তারা আসেননি। তবে বিপুলসংখ্যক নারী সমর্থক রয়েছে তাদের এবং ভবিষ্যতে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে।
ডিএস.