কুষ্টিয়ায় লালন ধামে সারা দিন লালন ভক্ত আর সাধারণ মানুষসহ লাখো মানুষের ভীড়ে লালন চত্বর যেন কানাই কানাই পরিপূর্ণ। বিকেলের পর এ ভীড় অতীতের সকল রেকর্ড ছড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বানের পানির মত মানুষের স্রোত নামেছে লালন আঁখড়া বাড়িমুখী সকল সড়কে। গান শোনার পাশাপাশি বাউলদের আচার দেখতে ভীড় ছিল লালন ভক্ত আর সাধারণ দর্শাকরা।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। এরপর থেকে তার অনুসারী ভক্ত বাউল সাধকরা এ দিনটিকে লালন তিরোধান দিবস হিসেবে পালন শুরু করেন। সেই ধারা আজও ধরে রেখেছেন তার অনুসারী বাউল-বৈষ্ণবরা। তবে এবারের লালন তিরোধান দিবসে স্মরণকালের সর্বোচ্চ লোকসমাগম হয়েছে। বিকেলের আগে থেকেই মানুষের স্রোত গিয়ে মিশতে থাকে বাউল তীর্থ আখড়া বাড়িতে। কেউবা চলেছেন পায়ে হেঁটে কেউ বিভিন্ন যানবাহনে।
আখড়া বাড়ির মূল আঙ্গিনা এবং মরা কালিগঙ্গা নদীর তীরে বিস্তীর্ণ মাঠ উপছে সহজ মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়েছে আখড়া বাড়ির প্রবেশ মুখগুলোর দীর্ঘ রাস্তা আর অলিতে গলিতে।
তবে লৌকিক অনুষ্ঠানের বাইরে লালনভক্তরা এই অনুষ্ঠানে নিজস্ব কিছু রীতিনীতি পালন করেন। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী শুক্রবার সন্ধ্যায় অধিবাসের মধ্যদিয়ে তাদের এই কর্মকান্ড শুরু হয়। শনিবার (১৮ অক্টোবর) সকালে বাল্যসেবা অর্থাৎ দই ও চিড়া নাশতা দেওয়া হবে বাউলদের। এরপর দুপুরে তাদের দেওয়া হবে পূর্ণসেবা। এই সেবার আওতায় বাউলরা খাবেন ভাত, ডাল, পঞ্চব্যঞ্জন ও মাছ। এ ছাড়া লালন মতে নতুন করে দীক্ষিতদের খেলাফত (শিষ্যত্ব) প্রদান করবেন তাদের নিজ নিজ গুরুরা।
এবারের উৎসবে যোগ দিতে উৎসব শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার বাউল জড়ো হয়েছেন ছেঁউড়িয়ার লালন ধামে। এই মানুষগুলো আধুনিক সামাজিক লোকাচারের বাইরে থেকে ঈশ্বরকে পাওয়া আর আত্মশুদ্ধির সাধনা করেন বাউলতীর্থ ছেঁউড়িয়ায় এসে। ভাবগান আর বাউল আচারের যজ্ঞ পালন ছাড়াও বাউল পথ ও মতের দীক্ষাও নিচ্ছেন অনেকে। তিরোধান মানেই বাউল ফকিরদের মহাসম্মেলন। এখানে আগত বাউলরা ভাবপরম্পরা বিনিময় করেন আপন মনে, নিজস্ব রীতিতে। গুরুবাদী এই ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে গুরুই সব। গুরুর নির্দেশিত পথে সাধন-ভজন এবং রস আস্বাদনের সব পথই উন্মুক্ত। আর এই যজ্ঞ সম্পাদনের মধ্যদিয়েই সীমার মাঝে অসীম খুঁজে ফেরেন এই মতে বিশ্বাসীরা। লালনের মাজারের আশপাশে ও মরা কালীগঙ্গা নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে। সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন তার গাওয়া গান গেয়ে। ধামের পাশে বিশাল মাঠের খোলা প্রান্তরে গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের সন্ধানে আকুল ভক্তদের চলছে নাচে-গানে দিন-রাত ভাবের খেলা। আখড়াবাড়িতে কথা হয় কুষ্টিয়ার মিরপুরের বাউল ফারুক মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সহজ মানুষ খোঁজা আর ভজার কাজে দীক্ষা নিয়েছি। এই পথেই সারা জীবন কাটাতে চাই।’
লালন অনুসারীরা বলেন, তার মূল চিন্তায় থাকে মানুষের কল্যাণ কামনা করা, মানুষের মঙ্গল চাওয়া। তাই তো লালন বলে গেছেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। উৎসবের মূল আকর্ষণ লালনের গান। এ গান শুনতেই আসেন অনেকে। খালি গলায়, একতারা হাতে গান করেন বেশিরভাগ বাউল।
বাউল দলিল ফকির বলেন, ‘এদিন শোকের। আমরা শোক পালন করি। গুরুকে স্মরণ করি তার গানের মাধ্যমে। উৎসবে তাদের দাওয়াতের প্রয়োজন হয় না। মনের মধ্যে আগে থেকেই দিনটি গাঁথা থাকে। তার টানেই চলে আসি।’ বাউল সাধুদের পাশাপাশি আখড়াবাড়ির তিরোধান দিবসে যোগ দিয়েছেন হাজারো দর্শনার্থী। আখড়াবাড়িতে কথা হয় সিরাজগঞ্জ শহরের একদল বাউলের সঙ্গে। তারা বলেন, এখানে এলে মানুষের আলাদা একটা রূপ চোখে পড়ে। মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র শেখা যায়। ঢাকা থেকে আসা দর্শনার্থী জুলহাস কবির বলেন, ‘উৎসব দেখতে এসেছি। লোকজনের প্রচুর ভিড়। গান শুনতে ভালো লাগছে।
ফকির লালনের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব। বিকেলে ৪টায় বসে আলোচনা সভা। প্রথমবারের মতো জাতীয় দিবস হিসেবে আয়োজিত এদিন সন্ধ্যায় আখড়াবাড়ির মরা কালীগঙ্গা নদীর তীরে উন্মুক্ত মঞ্চে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে তিন দিনের উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মুস্তাফা সরয়ার ফারুকী। এছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। মুখ্য আলোচক ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসান মোহাম্মদ আরেফিন।
মুখ্য আলোচক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন,‘ লালন ফকির ছিলেন একজন অস্প্রদায়িক চেনতার মানুষ। যিনি সব কিছুর উর্দ্ধে মানুষকে স্থান দিয়েছেন, মানুষকে ভালোবেসেছেন। লালন তার চিন্তা- চেতনাকে বিশ্ব পরিমন্ডলে মানুষের ভাবনা-চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন। এ মাটিতে লালন শুয়ে আছেন।
চিন্তক কবি লেখক ফরহাদ মজহার বলেন,‘ এবার জাতীয়ভাবে লালনের তিরোধান দিবস পালন হচ্ছে। এটা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও মিশে গেছে। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এ মাটিতে আসার মাধ্যমে এবার লালন দিবস আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চলে গেছে। লালনকে নিয়ে গবেষনার অনেক কিছু বাকি আছে। এ ধরনের একটি আন্তর্জতিক মানের গবেষনা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে মানুষ তার চিন্তার জগতকে পরিবর্তন করতে পারে। মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন,‘ আমরা বারবার এ মাটিতে ফিরে আসি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আসব। ফরিদা পারভীনকে স্মরণ করে বলেন,‘ আজ ফরিদা পারভীন আমাদের মাঝে নেই। তিনি লালনের গানকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।’ সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মুস্তাফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘লালন ছিলেন একজন সহজ মানুষ। তাকে সারা বিশ্বের মানুষ আজ চেনে। এবার জাতীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে। এটা আগামীতে আরো বড় পরিসরে পালন হবে।’ আলোচনা অনুষ্ঠানের পর ঢাকা থেকে আসা শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবসের দ্বিতীয় দিনটি কুষ্টিয়ার পাশাপাশি ঢাকাতেও আয়োজন রয়েছে। কুষ্টিয়ায় লালন আখড়াবাড়ীতে আজ শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় আলোচনা অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ রশিদুজ্জামান। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন কুষ্টিয়া- আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি, কুষ্টিয়া সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহবায়ক কুতুব উদ্দীন, সদস্য সচিব প্রকৌঃ জাকির হোসেন সরকার, এনসিপি কুষ্টিয়ার সমন্বয়ক জান্নাতুল ফেরদৌস টনি, গণঅধিকার পরিষদ কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ রাশেদুজ্জামান।
ডিএস./