০৫:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

একুশের গুরুত্ব, একুশের তাৎপর্য

ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে সদ্যগঠিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। সে দাবি উচ্চারিত হয় পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণায়। সে ঘোষণা জিন্নাহ-লিয়াকত থেকে মুসলিম লীগের সব শীর্ষনেতার কণ্ঠে অবাঙালি ও বাঙালির। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশই অখন্ড ভারত থেকে আগত, বাকিরা তাদের অনুসারী।
অখন্ড ভারতীয় রাজনীতিতে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের (হিন্দু-মুসলমান দুই স্বতন্ত্র জাতি, সম্প্রদায় নয়) চাপে এবং শাসক ইংরেজ চাতুর্যে শাসন ক্ষমতা ছেড়ে আসার সময় ভারতবর্ষ বিভক্ত হয় (১৪/১৫ আগস্ট, ১৯৪৭) ‘ভারত’ও পাকিস্তান নামের দুই ডোমিনিয়নে হিন্দু ও মুসলমানের স্বতন্ত্র বাসভূমি হিসেবে।
বঙ্গ ও পাঞ্জাবসহ ভারতবর্ষ এই নীতিতে বিভক্ত হলেও বাস্তবতা সে দাবি মানেনি। ভারতে থেকে যায় কয়েক কোটি মুসলমান এবং পাকিস্তানে বহুসংখ্যক হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। এ সত্য চতুর আইনজীবী জিন্নাহর অজানা ছিল না। তবু কংগ্রেস বিরোধিতার জেদে তার অবাস্তব পাকিস্তান দাবি এবং সেই পাকিস্তানে আরেক অবাস্তব একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা দাবি- যেখানে সব স্বদেশের জাতিগত ভাষাই উর্দু নয়- বরং বাংলা, পাঞ্জাবি, সিঞ্জি, বেলুচ, পশতু ইত্যাদি।
এ জবরদস্তির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নীরব থাকলেও পূর্বাঞ্চলে (পূর্ববঙ্গে-পূর্ব পাকিস্তানে) বাঙালিদের ভাষাসচেতন অংশ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়, মূলত ছাত্র-যুবারা এবং অংশত পেশাজীবী বুদ্ধিজীবী বাঙালি। শিক্ষকদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে কয়েক পা এগিয়ে- যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. আবুল কাসেম, কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক প্রমুখ।
আর আন্দোলনের সূচনাটি বেশ চমকপ্রদ। পাকিস্তান জনপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি বাস্তব দাবি তোলেন, প্রস্তাবটি রাষ্ট্রভাষার নয়, গণপরিষদে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তি- যাতে গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরা স্বচ্ছন্দভাবে নিজ মাতৃভাষা তথা বাংলায় বক্তৃতা করতে পারেন।
এই সাদামাঠা দাবিটুকুই সহ্য হয়নি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীসহ অন্য উর্দুভাষী ও অবাঙালি সদস্যদের। এমনকি কোনো কোনো বাঙালি মুসলিম লীগ নেতার। প্রধানমন্ত্রী তীব্র ভাষায় এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এমনকি প্রসঙ্গক্রমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরোধিতার বিষয়টি উল্লেখ করতে ভোলেন না।
আলোচনা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় এর বিরোধিতায় এবং ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বিরুদ্ধে সমালোচনায় এবং এমন আলোচনায় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা উর্দুরই রয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারির ব্যবহারিক বাংলার প্রস্তাব (১৯৪৮) এভাবে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাঙালি ছাত্র-যুবাদের আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে। শুরু হয় ১১ মার্চের (১৯৪৮) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। মূলত পিকেটিং।
এর পর অনেক ঘটনা। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সমঝোতা প্রস্তাব, ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ইত্যাদি। কারণ একটাই। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর (মার্চ ১৯৪৮) সমস্যামুক্ত ও নিরুপদ্রব করা। লক্ষ্য করার মতো ঘটনা- এ ব্যাপারে তমদ্দুন মজলিস প্রভাবিত সংগ্রাম পরিষদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমুখের আপসবাদী ভূমিকা আন্দোলন স্থগিত করার ক্ষেত্রে। ২. গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঢাকায় এলেন, একাধিক বক্তৃতায় জোর দিয়ে বললেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এ ব্যাপারে যারা ভিন্নকথা বলে তারা পাকিস্তানের দুশমন। জিন্নাহর অভাবিত প্রভাবে এভাবে ১৯৪৮-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পানি ঢালা হলো।
এর পর ১৯৫০-এ সরকারি মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে আবার রাষ্ট্রভাষা নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল-সভা- মূলত রাজনীতিবিদদের। সেই সঙ্গে ছাত্র-যুবাদের। এখানেও ওই একই প্রশ্ন নিয়ে প্রতিবাদ ও দাবি- পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা। শেষ পর্যন্ত মূলনীতি কমিটির রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সুপারিশ স্থগিত হয়ে যায়।
৩. এর পর দুবছর প্রস্তুতির পালা রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে। নিঃশব্দে এর বিস্তার ঘটেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছাত্র-যুবাদের চেষ্টায় এবং নানা গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। আবারো সরকার পক্ষে উসকানি। নাজিমুদ্দিন তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। তিনিও ওই এক ডালের পাখি, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে, যেমনটি ১৯৪৮-এ বলেছেন আমাদের কায়দে আজম।
ব্যস, পাথর গড়াতে শুরু করল ছাত্রদের চেষ্টায়- প্রতিবাদ, সভা, সমাবেশ, মিছিল। স্লোগান উঠল- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ কিন্তু এবার এখানেই থেমে থাকে না ১৯৫২ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ। তাদের কণ্ঠে আরেক দাবি, আরো স্লোগান- যেমন ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।’ কারা এই রাজবন্দি? এদের প্রায় সবাই বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও কৃষক-শ্রমিক নেতা। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে এই স্লোগান।
রাজনীতির চরিত্র বদল ঘটেছে। গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী রাজনীতি এবং সেই সঙ্গে মাতৃভাষাভিত্তিক গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ- মূলত ছাত্র-যুবসমাজ এর মুখ্য কারিগর। সেই সঙ্গে পূর্বোক্ত নানা শ্রেণির সচেতন অংশ। প্রশাসনের হঠকারী ভূমিকায় একুশে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি ভুন্ডল করতে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি।
আর সেই ১৪৪ ধারা ভাঙতে বদ্ধপরিকর ছাত্র-জনতার ওপর ২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণ। শহীদ হন রফিক-জব্বার-বরকত প্রমুখ। পটভূমি পাল্টে যায়। সারা প্রদেশে জ্বলে ওঠে আগুন। শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতেই নয়- সেই সঙ্গে স্লোগান ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’ এবং ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক।’
দ্বিতীয় দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তাল রাজপথের মিছিলে আবার গুলি- আবারো শহীদ সফিউর, আউয়াল, কিশোর ওহিউল্লাহ প্রমুখ। শহীদ স্মৃতি অমর করতে ঢাকায় মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে এক রাতে (২৩ ফেব্রুয়ারি) তৈরি হয় শহীদ মিনার- তৈরি হয় দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে প্রতিবাদী ছাত্রদের হাতে। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় গ্রামাঞ্চলে।
এক সময় বন্ধ হয় আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় অর্জিত হয় শুধু অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলাই নয় (১৯৫৬ সংবিধানে), সেই সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ও গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী জাতীয় চেতনার বিকাশ- প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির। একুশে ফেব্রুয়ারি চিহ্নিত হয় ও পালিত হতে থাকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে- শোক দিবস ও প্রতিবাদী সংগ্রামের প্রেরণা দিবস হিসেবে। আর শহীদ মিনার হয়ে ওঠে তার প্রতীক- যেখান থেকে শহীদ দিবস পালনই নয়, সব রকম গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা ও উৎস ‘শহীদ মিনার’, শহীদ দিবস।
সমগ্র জাতির ভাষিক আবেগ, রাজনৈতিক তৎপরতা ও আবেগ কল্লোলিত হয়ে ওঠে শহীদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি এবং শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে- নানা উপলক্ষে, নানা রাজনীতি ঘিরে। রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে এই দুই প্রতীক রাজনৈতিক সংগ্রামের উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
আর এ বিস্ময়কর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এর মর্যাদার স্বীকৃতিতে ইউনেস্কো দিনটিকে ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যা বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ঘটনা গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয় হয়ে থাকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য। এখানেই গুরুত্ব ও তাৎপর্য একুশে ফেব্রুয়ারির।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

একুশের গুরুত্ব, একুশের তাৎপর্য

প্রকাশিত : ১২:০০:১৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১

ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে সদ্যগঠিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। সে দাবি উচ্চারিত হয় পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণায়। সে ঘোষণা জিন্নাহ-লিয়াকত থেকে মুসলিম লীগের সব শীর্ষনেতার কণ্ঠে অবাঙালি ও বাঙালির। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশই অখন্ড ভারত থেকে আগত, বাকিরা তাদের অনুসারী।
অখন্ড ভারতীয় রাজনীতিতে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের (হিন্দু-মুসলমান দুই স্বতন্ত্র জাতি, সম্প্রদায় নয়) চাপে এবং শাসক ইংরেজ চাতুর্যে শাসন ক্ষমতা ছেড়ে আসার সময় ভারতবর্ষ বিভক্ত হয় (১৪/১৫ আগস্ট, ১৯৪৭) ‘ভারত’ও পাকিস্তান নামের দুই ডোমিনিয়নে হিন্দু ও মুসলমানের স্বতন্ত্র বাসভূমি হিসেবে।
বঙ্গ ও পাঞ্জাবসহ ভারতবর্ষ এই নীতিতে বিভক্ত হলেও বাস্তবতা সে দাবি মানেনি। ভারতে থেকে যায় কয়েক কোটি মুসলমান এবং পাকিস্তানে বহুসংখ্যক হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। এ সত্য চতুর আইনজীবী জিন্নাহর অজানা ছিল না। তবু কংগ্রেস বিরোধিতার জেদে তার অবাস্তব পাকিস্তান দাবি এবং সেই পাকিস্তানে আরেক অবাস্তব একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা দাবি- যেখানে সব স্বদেশের জাতিগত ভাষাই উর্দু নয়- বরং বাংলা, পাঞ্জাবি, সিঞ্জি, বেলুচ, পশতু ইত্যাদি।
এ জবরদস্তির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নীরব থাকলেও পূর্বাঞ্চলে (পূর্ববঙ্গে-পূর্ব পাকিস্তানে) বাঙালিদের ভাষাসচেতন অংশ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়, মূলত ছাত্র-যুবারা এবং অংশত পেশাজীবী বুদ্ধিজীবী বাঙালি। শিক্ষকদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে কয়েক পা এগিয়ে- যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. আবুল কাসেম, কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক প্রমুখ।
আর আন্দোলনের সূচনাটি বেশ চমকপ্রদ। পাকিস্তান জনপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি বাস্তব দাবি তোলেন, প্রস্তাবটি রাষ্ট্রভাষার নয়, গণপরিষদে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তি- যাতে গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরা স্বচ্ছন্দভাবে নিজ মাতৃভাষা তথা বাংলায় বক্তৃতা করতে পারেন।
এই সাদামাঠা দাবিটুকুই সহ্য হয়নি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীসহ অন্য উর্দুভাষী ও অবাঙালি সদস্যদের। এমনকি কোনো কোনো বাঙালি মুসলিম লীগ নেতার। প্রধানমন্ত্রী তীব্র ভাষায় এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এমনকি প্রসঙ্গক্রমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরোধিতার বিষয়টি উল্লেখ করতে ভোলেন না।
আলোচনা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় এর বিরোধিতায় এবং ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বিরুদ্ধে সমালোচনায় এবং এমন আলোচনায় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা উর্দুরই রয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারির ব্যবহারিক বাংলার প্রস্তাব (১৯৪৮) এভাবে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাঙালি ছাত্র-যুবাদের আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে। শুরু হয় ১১ মার্চের (১৯৪৮) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। মূলত পিকেটিং।
এর পর অনেক ঘটনা। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সমঝোতা প্রস্তাব, ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ইত্যাদি। কারণ একটাই। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর (মার্চ ১৯৪৮) সমস্যামুক্ত ও নিরুপদ্রব করা। লক্ষ্য করার মতো ঘটনা- এ ব্যাপারে তমদ্দুন মজলিস প্রভাবিত সংগ্রাম পরিষদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমুখের আপসবাদী ভূমিকা আন্দোলন স্থগিত করার ক্ষেত্রে। ২. গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঢাকায় এলেন, একাধিক বক্তৃতায় জোর দিয়ে বললেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এ ব্যাপারে যারা ভিন্নকথা বলে তারা পাকিস্তানের দুশমন। জিন্নাহর অভাবিত প্রভাবে এভাবে ১৯৪৮-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পানি ঢালা হলো।
এর পর ১৯৫০-এ সরকারি মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে আবার রাষ্ট্রভাষা নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল-সভা- মূলত রাজনীতিবিদদের। সেই সঙ্গে ছাত্র-যুবাদের। এখানেও ওই একই প্রশ্ন নিয়ে প্রতিবাদ ও দাবি- পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা। শেষ পর্যন্ত মূলনীতি কমিটির রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সুপারিশ স্থগিত হয়ে যায়।
৩. এর পর দুবছর প্রস্তুতির পালা রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে। নিঃশব্দে এর বিস্তার ঘটেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছাত্র-যুবাদের চেষ্টায় এবং নানা গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। আবারো সরকার পক্ষে উসকানি। নাজিমুদ্দিন তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। তিনিও ওই এক ডালের পাখি, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে, যেমনটি ১৯৪৮-এ বলেছেন আমাদের কায়দে আজম।
ব্যস, পাথর গড়াতে শুরু করল ছাত্রদের চেষ্টায়- প্রতিবাদ, সভা, সমাবেশ, মিছিল। স্লোগান উঠল- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ কিন্তু এবার এখানেই থেমে থাকে না ১৯৫২ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ। তাদের কণ্ঠে আরেক দাবি, আরো স্লোগান- যেমন ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।’ কারা এই রাজবন্দি? এদের প্রায় সবাই বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও কৃষক-শ্রমিক নেতা। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে এই স্লোগান।
রাজনীতির চরিত্র বদল ঘটেছে। গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী রাজনীতি এবং সেই সঙ্গে মাতৃভাষাভিত্তিক গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ- মূলত ছাত্র-যুবসমাজ এর মুখ্য কারিগর। সেই সঙ্গে পূর্বোক্ত নানা শ্রেণির সচেতন অংশ। প্রশাসনের হঠকারী ভূমিকায় একুশে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি ভুন্ডল করতে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি।
আর সেই ১৪৪ ধারা ভাঙতে বদ্ধপরিকর ছাত্র-জনতার ওপর ২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণ। শহীদ হন রফিক-জব্বার-বরকত প্রমুখ। পটভূমি পাল্টে যায়। সারা প্রদেশে জ্বলে ওঠে আগুন। শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতেই নয়- সেই সঙ্গে স্লোগান ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’ এবং ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক।’
দ্বিতীয় দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তাল রাজপথের মিছিলে আবার গুলি- আবারো শহীদ সফিউর, আউয়াল, কিশোর ওহিউল্লাহ প্রমুখ। শহীদ স্মৃতি অমর করতে ঢাকায় মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে এক রাতে (২৩ ফেব্রুয়ারি) তৈরি হয় শহীদ মিনার- তৈরি হয় দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে প্রতিবাদী ছাত্রদের হাতে। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় গ্রামাঞ্চলে।
এক সময় বন্ধ হয় আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় অর্জিত হয় শুধু অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলাই নয় (১৯৫৬ সংবিধানে), সেই সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ও গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী জাতীয় চেতনার বিকাশ- প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির। একুশে ফেব্রুয়ারি চিহ্নিত হয় ও পালিত হতে থাকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে- শোক দিবস ও প্রতিবাদী সংগ্রামের প্রেরণা দিবস হিসেবে। আর শহীদ মিনার হয়ে ওঠে তার প্রতীক- যেখান থেকে শহীদ দিবস পালনই নয়, সব রকম গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা ও উৎস ‘শহীদ মিনার’, শহীদ দিবস।
সমগ্র জাতির ভাষিক আবেগ, রাজনৈতিক তৎপরতা ও আবেগ কল্লোলিত হয়ে ওঠে শহীদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি এবং শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে- নানা উপলক্ষে, নানা রাজনীতি ঘিরে। রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে এই দুই প্রতীক রাজনৈতিক সংগ্রামের উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
আর এ বিস্ময়কর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এর মর্যাদার স্বীকৃতিতে ইউনেস্কো দিনটিকে ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যা বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ঘটনা গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয় হয়ে থাকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য। এখানেই গুরুত্ব ও তাৎপর্য একুশে ফেব্রুয়ারির।