০৬:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের আবর্তে রোহিঙ্গা সংকট

ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১ সালের সকালে মিয়ানমারের সদ্য নির্বাচিত সংসদ রাজধানী নেপিদোতে অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। সংসদের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে বিপুল ভোটে বিজয়ী অং সান সু চির পার্টি ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কথা ছিল। বিগত নভেম্বরে মিয়ানমারের নির্বাচনে এনএলডি সংসদের উন্মুক্ত আসনের প্রায় ৮৩ শতাংশ আসন পেয়েছিল। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) ভরাডুবি হয়। এর মানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সংবিধান মোতাবেক সরকারে প্রচুর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অঙ্গনে ইউএসডিপির তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখার অবস্থায় ছিল না।
ইউএসডিপির ভরাডুবির পর থেকেই এনএলডি কর্তৃক নিয়োজিত ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভুয়া ভোটার লিস্টের মাধ্যমে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কয়েক হাজার অভিযোগ দাখিল হয় নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার বা তেমন ব্যবস্থা নিতে পারেনি অথবা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। অবশ্য সামরিক বাহিনীর তরফ থেকেও এরই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের সততা নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়। এর আগেও সামরিক বাহিনী থেকে নভেম্বরের নির্বাচন পেছানোর দাবি উঠলেও তা গৃহীত হয়নি। কথিত যে, মূলত নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগ নিয়ে ক্রমেই সু চি সরকারের সঙ্গে তিক্ততা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তা ছাড়া মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সরাসরি আলোচনা, বিশেষ করে আরাকানে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রথমবারের মতো শান্তি আলোচনা নিয়ে বেসামরিক সরকারের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধানে সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে।
এসব ছাড়াও বর্তমান সামরিক বাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের আগামী জুলাইয়ে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল এবং সু চি সরকার তার মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিল না। অবসর মানে তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় একেবারে ক্ষমতাশূন্য হতে হতো। অন্যদিকে যথেষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের সম্ভাবনাও কম ছিল। শুধু প্রধানই নয়, তার সঙ্গে প্রায় ডজনখানেক জেনারেল- যাদের বিরুদ্ধে কারেন, কাচিন ও সর্বশেষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিধনের অভিযোগ ছিল, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পথে ছিল। এসবসহ অন্য অভ্যন্তরীণ কারণে, বিশেষ করে সু চির শক্তি বৃদ্ধিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সহজভাবে নিতে পারেনি। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সু চি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আনীত রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে খনন করার প্রয়াস নিয়েছিলেন এবং ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের কারণে কথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিতও হয়েছিলেন।
সু চির এনএলডি দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি নিয়ে সংসদে শক্তি প্রদর্শন হয়ত করতে পারত না। কারণ উচ্চ ও নিম্নকক্ষে ২৫ শতাংশ সামরিক বাহিনীর জন্য সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত। তবুও এনএলডির বহুদিনের দাবি ছিল সংবিধানের সংশোধন। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর সরকারের ওপর খবরদারির পরিবর্তন আনতে জনমত গড়ে তুলেছিল। এবারের নির্বাচনে ৩৯৬টি আসন পেয়েছিল। তা ২০১৫ সাল থেকে ৬টি বেশি ছিল। দুই সংসদ মিলিয়ে এনএলডি সংসদে এবং সংসদের বাইরে সংবিধানের পরিবর্তনের দাবি তুলে জনমত গঠন করলে তা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এটি সামরিক বাহিনী কিছুতেই চায়নি।
যাহোক, এরই প্রেক্ষাপটে কয়েকদিনের গুঞ্জনের মধ্যেই সংসদ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে সামরিক বাহিনী এক বছরের জরুরি অবস্থা প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ঘোষণা করিয়ে সর্বময় ক্ষমতা সামরিকপ্রধান সিনিয়র জেনারেল হ্লাইংয়ের হাতে ন্যস্ত করে। উল্লেখ্য, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থেকে সবাইকে, এমনকি নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনকে আটক করা হয়। ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মিনি সামরিক বাহিনীর সাবেক থ্রি-স্টার জেনারেল মিন্ট সোয়েকে প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত করা হয়। কাজেই তিনি সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করেন সিনিয়র জেনারেল হ্লাইংয়ের হাতে। বর্তমান এ ব্যবস্থাকে জরুরি আইনের সময়কাল বলা হলেও কার্যত মার্শাল ল’ বা মিলিটারি শাসনই বলা যায়।
সামরিক শাসন মিয়ানমারে নতুন নয়। ১৯৬২ সালে প্রথম জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করেন। নে উইন মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জেনারেল অং সাংয়ের নেতৃত্বে ৩০ কমরেডের একজন ছিলেন। ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বে আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোয় সামরিক শাসনকে বিশ্বের শক্তিধর কথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোও বহুবিধ কারণে গ্রহণ করেছিল। উল্লেখ্য, ওই সময় দ্বিমেরুর বিশ্বে দুই পরাশক্তির আধিপত্যের আঙ্গিকেই এসব ঔপনিবেশিক শাসন-উত্তর দেশে সামরিক অভ্যুত্থানগুলো টিকে গেলে সহজে স্বীকৃতি অর্জন করত। প্রায় দুই যুগ নে উইন ছিলেন কঠিন সামরিক শাসক (১৯৬২-৮৮)। এর পর পরই তার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন হন জেনারেল সা মং।
যাহোক, এক কথায় মিয়ানমার ২০১১ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনে ছিল। এত বছরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী শুধু শক্তিশালীই নয়, সংবিধান রচনা করে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যত সহযোগিতা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ বছর বন্দি থাকার পর সু চি গত পাঁচ বছর সামরিক বাহিনীর অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে সরকারপ্রধান ছিলেন। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের ইতিহাসের জঘন্যতম নরহত্যা ও নরযজ্ঞ সংঘটিত হয় রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত। এ কারণেই মিয়ানমারের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় পরোক্ষভাবে প্রভাবিত।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণেই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত হলে সামরিক বাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিপরীতে তেমন শক্ত অবস্থানে থাকতে পারেনি। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অনেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসনকালে ওই সময়কালের রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল মন্তব্য করেন। তাদের মতে, এবারও সামরিক সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ আলোচনা চালাবে এবং আশা করছে কিছু ফল পাওয়া যাবে। এমনটিই আমাদের সম্মানিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন। তিনি আশাবাদী। আমরাও আশাবাদী হতে চাই। তবে বাস্তবতা হলো রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ ও গণহত্যার জন্য সু চি ধিকৃত হলে মূল হোতা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। কাজেই ওই বাহিনী এবং বাহিনীপ্রধান ক্ষমতার অধিশ্বর হয়ে রোহিঙ্গাদের সম্মানে ফেরত নিয়ে মূল দাবি নাগরিকত্ব প্রদান করবে- এমন মনে হয় না। বস্তুতপক্ষে অন্তত এক বছরের মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যা সবচেয়ে তলানিতেই থাক- যদি থাকে।
অন্যদিকে এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক অঙ্ক আরও জটিল হবে। এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন যতখানি জোরালো বক্তব্য রেখেছে- তেমনটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ানভুক্ত দেশ বা জাপান থেকে শোনা যায়নি। মিয়ানমারে চীনের পর জাপানের লগ্নি। আসিয়ান দেশগুলো মেম্বার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খুব সোচ্চার নয়। থাইল্যান্ড এ পরিবর্তনকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবৃতি দিয়েছে। লক্ষণীয় হলো মিয়ানমারের প্রতিবেশী দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত ও চীনের প্রতিক্রিয়া। চীন ইদানীং মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল- যার এবং অন্যান্য কারণে মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। চীন এ পরিবর্তনে শুধু পর্যবেক্ষণ করছে বলে বিবৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত ‘উদ্বিঘ্ন’ এবং গণতন্ত্রে ফেরার তাগিদ দিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগেই মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে চীনের মধুর সম্পর্ক ছিল এখনো তেমনই হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তা হলে মিয়ানমারের একমাত্র ত্রাণকর্তা হবে চীন।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক ইদানীং নিবিড় হয়েছে, বিশেষ করে ভারতে পূর্বনীতি ও কালাদান প্রকল্পের কারণে। তা ছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যে বিদ্রোহীদের বিশেষ করে নাগা ও উলফার সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গভীরভাবে সহযোগিতা করেছে। উল্লেখ্য, উলফার পরেশ বড়ুয়া ও মিয়ানমার ভারত-চীন সীমান্তপাড়ে রয়েছে। কিছুদিন আগেই মিয়ানমারের সহযোগিতাতে দৃষ্টি রাজখোয়া ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তা ছাড়া ভারত মিয়ানমারকে ‘ডুবোজাহাজ’ বা সাবমেরিনসহ প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ভারতের সেনাপ্রধান মাত্র মাসখানেক আগে মিয়ানমার সফর করে সম্পর্ক আরও গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। স্মরণযোগ্য, এ অঞ্চলে ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণে ভারতের সঙ্গে চীনের যে প্রতিযোগিতা চলমান, এতে ভারত সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে এবং অং সান সু চির পক্ষে বস্তুতপক্ষে তেমন কোনো পদক্ষেপেই যাবে না- যেমনটি চীনও যাবে না। মিয়ানমার আর্মির জেনারেলরা এ পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্য সব ধরনের অঙ্ক কষেই ক্ষমতা দখল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো মিযানমারের জেনারেলদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে জেনারেলদের অর্থনৈতিক লেনদেনেও। তবে মিয়ানমারের ওপর এসব নিষেধাজ্ঞা নাও আসতে পারে। অবশ্য অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর বৈদেশিক লগ্নির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এতে মিয়ানমারের বিশেষ অসুবিধা হয়নি, বরং মিয়ানমার ক্রমেই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিল। এ অবস্থা থেকে মিয়ানমার বের হতে পারেনি। বর্তমানে চীনের ইকোনমিক করিডোরে মিয়ানমারের প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার লগ্নি রয়েছে। তাই পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর নিষেধাজ্ঞা বহাল করলে মিয়ানমার চীন ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপরই আরও নির্ভরশীল হবে। অন্যদিকে চীনকে চ্যালেঞ্জ করতে ভারতও তৎপর হয়ে পড়বে। কাজেই মিয়ানমার সামরিক সরকার এসব নিয়ে বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১১ লাখ রোহিঙ্গার রাখাইনে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। এর মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবার ঘুঁটি হয়ে উঠতে পারে। কাজেই উ™ূ¢ত নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনীতিবিদদের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। তা মোকাবিলা করার জন্য কঠিন পরিকল্পনায় যেতে হবে।
লেখক : নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

 

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের আবর্তে রোহিঙ্গা সংকট

প্রকাশিত : ১২:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১

ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১ সালের সকালে মিয়ানমারের সদ্য নির্বাচিত সংসদ রাজধানী নেপিদোতে অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। সংসদের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে বিপুল ভোটে বিজয়ী অং সান সু চির পার্টি ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কথা ছিল। বিগত নভেম্বরে মিয়ানমারের নির্বাচনে এনএলডি সংসদের উন্মুক্ত আসনের প্রায় ৮৩ শতাংশ আসন পেয়েছিল। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) ভরাডুবি হয়। এর মানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সংবিধান মোতাবেক সরকারে প্রচুর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অঙ্গনে ইউএসডিপির তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখার অবস্থায় ছিল না।
ইউএসডিপির ভরাডুবির পর থেকেই এনএলডি কর্তৃক নিয়োজিত ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভুয়া ভোটার লিস্টের মাধ্যমে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কয়েক হাজার অভিযোগ দাখিল হয় নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার বা তেমন ব্যবস্থা নিতে পারেনি অথবা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। অবশ্য সামরিক বাহিনীর তরফ থেকেও এরই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের সততা নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়। এর আগেও সামরিক বাহিনী থেকে নভেম্বরের নির্বাচন পেছানোর দাবি উঠলেও তা গৃহীত হয়নি। কথিত যে, মূলত নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগ নিয়ে ক্রমেই সু চি সরকারের সঙ্গে তিক্ততা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তা ছাড়া মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সরাসরি আলোচনা, বিশেষ করে আরাকানে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রথমবারের মতো শান্তি আলোচনা নিয়ে বেসামরিক সরকারের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধানে সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে।
এসব ছাড়াও বর্তমান সামরিক বাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের আগামী জুলাইয়ে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল এবং সু চি সরকার তার মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিল না। অবসর মানে তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় একেবারে ক্ষমতাশূন্য হতে হতো। অন্যদিকে যথেষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের সম্ভাবনাও কম ছিল। শুধু প্রধানই নয়, তার সঙ্গে প্রায় ডজনখানেক জেনারেল- যাদের বিরুদ্ধে কারেন, কাচিন ও সর্বশেষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিধনের অভিযোগ ছিল, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পথে ছিল। এসবসহ অন্য অভ্যন্তরীণ কারণে, বিশেষ করে সু চির শক্তি বৃদ্ধিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সহজভাবে নিতে পারেনি। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সু চি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আনীত রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে খনন করার প্রয়াস নিয়েছিলেন এবং ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের কারণে কথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিতও হয়েছিলেন।
সু চির এনএলডি দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি নিয়ে সংসদে শক্তি প্রদর্শন হয়ত করতে পারত না। কারণ উচ্চ ও নিম্নকক্ষে ২৫ শতাংশ সামরিক বাহিনীর জন্য সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত। তবুও এনএলডির বহুদিনের দাবি ছিল সংবিধানের সংশোধন। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর সরকারের ওপর খবরদারির পরিবর্তন আনতে জনমত গড়ে তুলেছিল। এবারের নির্বাচনে ৩৯৬টি আসন পেয়েছিল। তা ২০১৫ সাল থেকে ৬টি বেশি ছিল। দুই সংসদ মিলিয়ে এনএলডি সংসদে এবং সংসদের বাইরে সংবিধানের পরিবর্তনের দাবি তুলে জনমত গঠন করলে তা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এটি সামরিক বাহিনী কিছুতেই চায়নি।
যাহোক, এরই প্রেক্ষাপটে কয়েকদিনের গুঞ্জনের মধ্যেই সংসদ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে সামরিক বাহিনী এক বছরের জরুরি অবস্থা প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ঘোষণা করিয়ে সর্বময় ক্ষমতা সামরিকপ্রধান সিনিয়র জেনারেল হ্লাইংয়ের হাতে ন্যস্ত করে। উল্লেখ্য, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থেকে সবাইকে, এমনকি নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনকে আটক করা হয়। ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মিনি সামরিক বাহিনীর সাবেক থ্রি-স্টার জেনারেল মিন্ট সোয়েকে প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত করা হয়। কাজেই তিনি সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করেন সিনিয়র জেনারেল হ্লাইংয়ের হাতে। বর্তমান এ ব্যবস্থাকে জরুরি আইনের সময়কাল বলা হলেও কার্যত মার্শাল ল’ বা মিলিটারি শাসনই বলা যায়।
সামরিক শাসন মিয়ানমারে নতুন নয়। ১৯৬২ সালে প্রথম জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করেন। নে উইন মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জেনারেল অং সাংয়ের নেতৃত্বে ৩০ কমরেডের একজন ছিলেন। ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বে আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোয় সামরিক শাসনকে বিশ্বের শক্তিধর কথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোও বহুবিধ কারণে গ্রহণ করেছিল। উল্লেখ্য, ওই সময় দ্বিমেরুর বিশ্বে দুই পরাশক্তির আধিপত্যের আঙ্গিকেই এসব ঔপনিবেশিক শাসন-উত্তর দেশে সামরিক অভ্যুত্থানগুলো টিকে গেলে সহজে স্বীকৃতি অর্জন করত। প্রায় দুই যুগ নে উইন ছিলেন কঠিন সামরিক শাসক (১৯৬২-৮৮)। এর পর পরই তার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন হন জেনারেল সা মং।
যাহোক, এক কথায় মিয়ানমার ২০১১ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনে ছিল। এত বছরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী শুধু শক্তিশালীই নয়, সংবিধান রচনা করে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যত সহযোগিতা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ বছর বন্দি থাকার পর সু চি গত পাঁচ বছর সামরিক বাহিনীর অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে সরকারপ্রধান ছিলেন। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের ইতিহাসের জঘন্যতম নরহত্যা ও নরযজ্ঞ সংঘটিত হয় রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত। এ কারণেই মিয়ানমারের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় পরোক্ষভাবে প্রভাবিত।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণেই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত হলে সামরিক বাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিপরীতে তেমন শক্ত অবস্থানে থাকতে পারেনি। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অনেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসনকালে ওই সময়কালের রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল মন্তব্য করেন। তাদের মতে, এবারও সামরিক সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ আলোচনা চালাবে এবং আশা করছে কিছু ফল পাওয়া যাবে। এমনটিই আমাদের সম্মানিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন। তিনি আশাবাদী। আমরাও আশাবাদী হতে চাই। তবে বাস্তবতা হলো রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ ও গণহত্যার জন্য সু চি ধিকৃত হলে মূল হোতা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। কাজেই ওই বাহিনী এবং বাহিনীপ্রধান ক্ষমতার অধিশ্বর হয়ে রোহিঙ্গাদের সম্মানে ফেরত নিয়ে মূল দাবি নাগরিকত্ব প্রদান করবে- এমন মনে হয় না। বস্তুতপক্ষে অন্তত এক বছরের মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যা সবচেয়ে তলানিতেই থাক- যদি থাকে।
অন্যদিকে এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক অঙ্ক আরও জটিল হবে। এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন যতখানি জোরালো বক্তব্য রেখেছে- তেমনটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ানভুক্ত দেশ বা জাপান থেকে শোনা যায়নি। মিয়ানমারে চীনের পর জাপানের লগ্নি। আসিয়ান দেশগুলো মেম্বার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খুব সোচ্চার নয়। থাইল্যান্ড এ পরিবর্তনকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবৃতি দিয়েছে। লক্ষণীয় হলো মিয়ানমারের প্রতিবেশী দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত ও চীনের প্রতিক্রিয়া। চীন ইদানীং মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল- যার এবং অন্যান্য কারণে মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। চীন এ পরিবর্তনে শুধু পর্যবেক্ষণ করছে বলে বিবৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত ‘উদ্বিঘ্ন’ এবং গণতন্ত্রে ফেরার তাগিদ দিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগেই মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে চীনের মধুর সম্পর্ক ছিল এখনো তেমনই হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তা হলে মিয়ানমারের একমাত্র ত্রাণকর্তা হবে চীন।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক ইদানীং নিবিড় হয়েছে, বিশেষ করে ভারতে পূর্বনীতি ও কালাদান প্রকল্পের কারণে। তা ছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যে বিদ্রোহীদের বিশেষ করে নাগা ও উলফার সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গভীরভাবে সহযোগিতা করেছে। উল্লেখ্য, উলফার পরেশ বড়ুয়া ও মিয়ানমার ভারত-চীন সীমান্তপাড়ে রয়েছে। কিছুদিন আগেই মিয়ানমারের সহযোগিতাতে দৃষ্টি রাজখোয়া ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তা ছাড়া ভারত মিয়ানমারকে ‘ডুবোজাহাজ’ বা সাবমেরিনসহ প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ভারতের সেনাপ্রধান মাত্র মাসখানেক আগে মিয়ানমার সফর করে সম্পর্ক আরও গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। স্মরণযোগ্য, এ অঞ্চলে ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণে ভারতের সঙ্গে চীনের যে প্রতিযোগিতা চলমান, এতে ভারত সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে এবং অং সান সু চির পক্ষে বস্তুতপক্ষে তেমন কোনো পদক্ষেপেই যাবে না- যেমনটি চীনও যাবে না। মিয়ানমার আর্মির জেনারেলরা এ পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্য সব ধরনের অঙ্ক কষেই ক্ষমতা দখল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো মিযানমারের জেনারেলদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে জেনারেলদের অর্থনৈতিক লেনদেনেও। তবে মিয়ানমারের ওপর এসব নিষেধাজ্ঞা নাও আসতে পারে। অবশ্য অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর বৈদেশিক লগ্নির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এতে মিয়ানমারের বিশেষ অসুবিধা হয়নি, বরং মিয়ানমার ক্রমেই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিল। এ অবস্থা থেকে মিয়ানমার বের হতে পারেনি। বর্তমানে চীনের ইকোনমিক করিডোরে মিয়ানমারের প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার লগ্নি রয়েছে। তাই পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর নিষেধাজ্ঞা বহাল করলে মিয়ানমার চীন ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপরই আরও নির্ভরশীল হবে। অন্যদিকে চীনকে চ্যালেঞ্জ করতে ভারতও তৎপর হয়ে পড়বে। কাজেই মিয়ানমার সামরিক সরকার এসব নিয়ে বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১১ লাখ রোহিঙ্গার রাখাইনে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। এর মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবার ঘুঁটি হয়ে উঠতে পারে। কাজেই উ™ূ¢ত নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনীতিবিদদের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। তা মোকাবিলা করার জন্য কঠিন পরিকল্পনায় যেতে হবে।
লেখক : নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)