০৩:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পদ্মা সেতু বদলে দেবে অর্থনীতির চালচিত্র

ঢাকা থেকে মাওয়া অভিমুখে সড়কপথে যাত্রা করলে দেখা মেলে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। ঢাকা-মাওয়া হয়ে নদীর ওপারে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। দৃষ্টিনন্দন এ মহাসড়ক দিয়ে যেতে ভ্রমণানন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এ যেন আরেক বাংলাদেশ। মাওয়া পৌঁছালে দেখা মেলে এক অবিরাম কর্মযজ্ঞ। প্রমত্ত পদ্মার দুইতীরের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি এক সময়ের অসম্ভব ভাবনাকে সম্ভব করে তুলছে বাংলাদেশ। আর এ স্বপ্ন সম্ভাবনার আরেক নাম পদ্মা সেতু। কোটি মানুষের স্বপ্ন জড়িয়ে, অর্জনের গৌরব মেখে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের সেতু। এ সেতু বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী সিদ্ধান্তের সোনালি ফসল।
পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ইতোমধ্যে সব স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অপবাদ ঘুচিয়ে আজ মাথা তুলে দাঁড়ানো সেতুর অবকাঠামো বাংলাদেশের সক্ষমতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে তার সাহসী নেতৃত্বে যে কোনো চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সক্ষম।
প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পটি উন্মোচন করতে যাচ্ছে সাফল্য আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। উন্নয়নের সূচকে যোগ করবে নবমাত্রা। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে আশা করা যাচ্ছে, দেশের জিডিপি শতকরা ১ দশমিক ২৬ ভাগ বৃদ্ধি পাবে এবং আঞ্চলিক জিডিপি, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে শতকরা ২ দশমিক ৩ ভাগ। দারিদ্র্যের হার কমবে প্রায় ১ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রকল্পের সার্বিক কাজ ৮৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। নদীশাসন কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। সেতুর ওপর একের পর এক পাটাতনের সংযোগ চলছে। আগামী বছর জুনের মধ্যে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ।
দেশের সব অঞ্চলের মধ্যে সুষ্ঠু ও সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাজিরা ও মাওয়াপ্রান্তে প্রকল্পের নদীশাসন কাজ এবং মূল সেতুর নির্মাণকাজের সূচনা করেন। এর আগে ২০০১ সালে সরকার পরিচালনাকালে শেখ হাসিনার সরকার সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং একই সালের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে সরকারকে। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর সেতু নির্মাণ পড়ে যায় অনিশ্চয়তায়। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধু নিজস্ব অর্থায়নই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশীয় উপকরণ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। স্বপ্নের এ সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ হাজার ৪০০ পরিবারের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং ৩ হাজার পরিবারকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী স্থানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৪৫৫ পরিবারকে পুনর্বাসন এলাকায় বিভিন্ন সাইজের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পুনর্বাসন এলাকায় প্রকল্পের অর্থায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কাঁচাবাজার, সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর আগেই পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান। বনায়নের আওতায় উভয়তীরে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে বন বিভাগের মাধ্যমে চারটি পুনর্বাসন এলাকায় রোপণ করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ গাছের চারা। পদ্মা নদী ও নদী অববাহিকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহায়তায় স্থাপন করা হয়েছে জাদুঘর। পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম এর পানিপ্রবাহ। এটি মূলত পদ্মা-যমুনার সম্মিলিত প্রবাহ। পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে বিশ্বে আমাজন নদীর পরই পদ্মার স্থান। নকশা প্রণয়নে নদীর পানিপ্রবাহ, তলদেশ আগামী ১০০ বছর পর কেমন থাকবে, ভূমিকম্প প্রতিরোধে কী করা হবে- এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চ্যালেঞ্জ অতিক্রমে ৩৮৩ ফুট গভীরে গিয়ে পাইলিং করা হয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘ এ সেতুটি বাঁকানো ইংরেজি ‘এস’ আকৃতির।
নির্মাণাধীন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার এ সেতুটি একটি ডাবল ডেকার বা দোতলা সেতু। সেতুর নিচে ডুয়েলগেজ রেলপথ এবং ওপরে থাকছে ৭২ ফুট প্রশস্ত সড়কপথ। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ রেখে বরিশাল-পটুয়াখালী জাতীয় মহাসড়কে লেবুখালী সেতু ও কালনা সেতুর নির্মাণকাজও এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে পায়রাবন্দরকে সংযুক্ত করে সড়ক উন্নয়ন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতু। বরিশালের সঙ্গে পটুয়াখালীর নিরবচ্ছিন্ন সড়ক সংযোগ প্রতিষ্ঠায় নির্মাণ করা হচ্ছে লেবুখালী সেতু। এ ছাড়া ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল ও খুলনা-মোংলা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এগিয়ে চলেছে কালনা সেতুর নির্মাণকাজ।
সেতু নির্মিত হলে বিভাগীয় শহর খুলনা ও বরিশাল, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সাগরকন্যাখ্যাত কুয়াকাটা ঘিরে বাড়বে পর্যটন সম্ভাবনা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোল ও ভোমরা ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নবদ্বার উন্মোচিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সংযোগ ঘটবে। এতে কাঁচামাল সরবরাহসহ পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। বদলে যাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র।
এরই মধ্যে সেতুর দুইপ্রান্তের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে দুইপ্রান্তের টোল প্লাজা। সেতু দিয়ে গ্যাসলাইন ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এর পাশ দিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। ইস্পাতের কাঠামোর সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকছে আলোকসজ্জা। এতে যে কোনো উৎসব ও জাতীয় দিবসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখা যাবে বর্ণিল আলোর বিচ্ছরণ।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় অর্থনীতিবীদরা দেখিয়েছেন, এ সেতু নির্মিত হলে দেশের মোট শস্য চাহিদা ১০, মাছের চাহিদা ১০, ইউটিলিটি সেবার চাহিদা ৫ ও পরিবহন চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে। অমিত সম্ভাবনা আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী দিনের উন্নয়ন। বদলে যাবে নদী-মেঘলা সবুজ-শ্যামল প্রিয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে নদীতীরের মানুষের জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে উত্তরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সেতু হবে অন্যতম চালিকাশক্তি, সামর্থ্যরে সোনালি ঠিকানা। স্বপ্নের এ সেতু কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

পদ্মা সেতু বদলে দেবে অর্থনীতির চালচিত্র

প্রকাশিত : ১২:০০:২৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১

ঢাকা থেকে মাওয়া অভিমুখে সড়কপথে যাত্রা করলে দেখা মেলে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। ঢাকা-মাওয়া হয়ে নদীর ওপারে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। দৃষ্টিনন্দন এ মহাসড়ক দিয়ে যেতে ভ্রমণানন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এ যেন আরেক বাংলাদেশ। মাওয়া পৌঁছালে দেখা মেলে এক অবিরাম কর্মযজ্ঞ। প্রমত্ত পদ্মার দুইতীরের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি এক সময়ের অসম্ভব ভাবনাকে সম্ভব করে তুলছে বাংলাদেশ। আর এ স্বপ্ন সম্ভাবনার আরেক নাম পদ্মা সেতু। কোটি মানুষের স্বপ্ন জড়িয়ে, অর্জনের গৌরব মেখে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের সেতু। এ সেতু বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী সিদ্ধান্তের সোনালি ফসল।
পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ইতোমধ্যে সব স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অপবাদ ঘুচিয়ে আজ মাথা তুলে দাঁড়ানো সেতুর অবকাঠামো বাংলাদেশের সক্ষমতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে তার সাহসী নেতৃত্বে যে কোনো চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সক্ষম।
প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পটি উন্মোচন করতে যাচ্ছে সাফল্য আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। উন্নয়নের সূচকে যোগ করবে নবমাত্রা। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে আশা করা যাচ্ছে, দেশের জিডিপি শতকরা ১ দশমিক ২৬ ভাগ বৃদ্ধি পাবে এবং আঞ্চলিক জিডিপি, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে শতকরা ২ দশমিক ৩ ভাগ। দারিদ্র্যের হার কমবে প্রায় ১ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রকল্পের সার্বিক কাজ ৮৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। নদীশাসন কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। সেতুর ওপর একের পর এক পাটাতনের সংযোগ চলছে। আগামী বছর জুনের মধ্যে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ।
দেশের সব অঞ্চলের মধ্যে সুষ্ঠু ও সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাজিরা ও মাওয়াপ্রান্তে প্রকল্পের নদীশাসন কাজ এবং মূল সেতুর নির্মাণকাজের সূচনা করেন। এর আগে ২০০১ সালে সরকার পরিচালনাকালে শেখ হাসিনার সরকার সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং একই সালের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে সরকারকে। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর সেতু নির্মাণ পড়ে যায় অনিশ্চয়তায়। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধু নিজস্ব অর্থায়নই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশীয় উপকরণ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। স্বপ্নের এ সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ হাজার ৪০০ পরিবারের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং ৩ হাজার পরিবারকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী স্থানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৪৫৫ পরিবারকে পুনর্বাসন এলাকায় বিভিন্ন সাইজের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পুনর্বাসন এলাকায় প্রকল্পের অর্থায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কাঁচাবাজার, সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর আগেই পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান। বনায়নের আওতায় উভয়তীরে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে বন বিভাগের মাধ্যমে চারটি পুনর্বাসন এলাকায় রোপণ করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ গাছের চারা। পদ্মা নদী ও নদী অববাহিকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহায়তায় স্থাপন করা হয়েছে জাদুঘর। পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম এর পানিপ্রবাহ। এটি মূলত পদ্মা-যমুনার সম্মিলিত প্রবাহ। পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে বিশ্বে আমাজন নদীর পরই পদ্মার স্থান। নকশা প্রণয়নে নদীর পানিপ্রবাহ, তলদেশ আগামী ১০০ বছর পর কেমন থাকবে, ভূমিকম্প প্রতিরোধে কী করা হবে- এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চ্যালেঞ্জ অতিক্রমে ৩৮৩ ফুট গভীরে গিয়ে পাইলিং করা হয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘ এ সেতুটি বাঁকানো ইংরেজি ‘এস’ আকৃতির।
নির্মাণাধীন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার এ সেতুটি একটি ডাবল ডেকার বা দোতলা সেতু। সেতুর নিচে ডুয়েলগেজ রেলপথ এবং ওপরে থাকছে ৭২ ফুট প্রশস্ত সড়কপথ। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ রেখে বরিশাল-পটুয়াখালী জাতীয় মহাসড়কে লেবুখালী সেতু ও কালনা সেতুর নির্মাণকাজও এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে পায়রাবন্দরকে সংযুক্ত করে সড়ক উন্নয়ন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতু। বরিশালের সঙ্গে পটুয়াখালীর নিরবচ্ছিন্ন সড়ক সংযোগ প্রতিষ্ঠায় নির্মাণ করা হচ্ছে লেবুখালী সেতু। এ ছাড়া ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল ও খুলনা-মোংলা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এগিয়ে চলেছে কালনা সেতুর নির্মাণকাজ।
সেতু নির্মিত হলে বিভাগীয় শহর খুলনা ও বরিশাল, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সাগরকন্যাখ্যাত কুয়াকাটা ঘিরে বাড়বে পর্যটন সম্ভাবনা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোল ও ভোমরা ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নবদ্বার উন্মোচিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সংযোগ ঘটবে। এতে কাঁচামাল সরবরাহসহ পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। বদলে যাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র।
এরই মধ্যে সেতুর দুইপ্রান্তের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে দুইপ্রান্তের টোল প্লাজা। সেতু দিয়ে গ্যাসলাইন ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এর পাশ দিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। ইস্পাতের কাঠামোর সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকছে আলোকসজ্জা। এতে যে কোনো উৎসব ও জাতীয় দিবসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখা যাবে বর্ণিল আলোর বিচ্ছরণ।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় অর্থনীতিবীদরা দেখিয়েছেন, এ সেতু নির্মিত হলে দেশের মোট শস্য চাহিদা ১০, মাছের চাহিদা ১০, ইউটিলিটি সেবার চাহিদা ৫ ও পরিবহন চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে। অমিত সম্ভাবনা আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী দিনের উন্নয়ন। বদলে যাবে নদী-মেঘলা সবুজ-শ্যামল প্রিয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে নদীতীরের মানুষের জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে উত্তরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সেতু হবে অন্যতম চালিকাশক্তি, সামর্থ্যরে সোনালি ঠিকানা। স্বপ্নের এ সেতু কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।