০৩:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অনলাইন ব্যবসা ও নারীর কর্মসংস্থান

পেন্ডামিকের এ সময়টায় ‘অনলাইন ব্যবসা’ চমৎকার একটি জায়গা করে নিয়েছে। আগে থেকেই সামান্য কলবরে হলেও কঠিন এ সময়টায় আমাদের দেশে এই ব্যবসা বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে। গৃহকর্মীরাও এখন শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। জিজ্ঞেস করে- ‘কে আইনা দিল, কৈ পাইলেন, অনলাইন?’ অনলাইনে সালোয়ার-কামিজ বেচাকেনার কথা ওরাও জানে। না কিনলেও ছবি দেখে মজা পায়। এভাবেই খুব ধীরে ধীরে অনলাইন ব্যবসা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত হয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের লড়াই করে বেঁচে থাকার পথ করে দিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে মানুষ লড়াই করেই আজকের সভ্যতায় পৌঁছেছে। এই পেন্ডামিকের সময় বাঁচা-মরা নিয়ে যখন মানুষ দিশাহারা, জীবন-জীবিকা নিয়ে দিশাহারা- অনলাইন ব্যবসা তখন অনেককেই আশার আলো দেখিয়েছে। প্রতিদিনের চাহিদাগুলো অনলাইনের অর্ডারে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে নিজেরাও বেঁচেছেন। বিশেষ করে বয়স্ক যারা ভয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন না বা এখনো হন না কিংবা বের হওয়াও বিপজ্জনক ছিল, তাদের জন্য অনলাইনের কেনাকাটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যারা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন বা দেন, তারাও দুই পয়সা আয় করে নিজেদের বাঁচিয়েছেন। আমার চেনা-জানা বহু মানুষ অনলাইনে মাছসহ অন্যান্য জিনিস কেনাকাটা এখনো করে। না, এই ব্যবসায় শুধু যে পুরুষরা অধিকার করে আছে- তা নয়, বহু নারী এখন এর সঙ্গে জড়িত। নারীরাও পুরুষশাসিত এ সমাজে লড়াই করেই তাদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। যারা কোনোদিন ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ভাবতেও পারেননি, তারা এই দুর্দিনে ঘরের পুরুষদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থানের এ বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে হ্যাঁ, যারা স্বল্পপুঁজি নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন কিংবা এখনো নতুন করে শুরু করার কথা ভাবছেন- তারা কিছু বিষয় মাথায় রেখে শুরু করলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আমার মনে হয়, প্রথমেই কোন পণ্যটির চাহিদা বাজারে সবচেয়ে বেশি- এ বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে পারলে ভালো হয়। আমার এক অতি আহ্লাদি ছোট বোন ফোনে একদিন তার অনলাইন ব্যবসা শুরু করার কথা জানালে খুব আশ্চর্য না হয়ে খুব খুশি হয়েছি। তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই শুধু প্রয়োজন না থাকলেও পণ্যটি কিনেছি। সম্ভবত কট্টর পুরুষও এখন বুঝতে পেরেছেন যে, নারীর নিজস্ব কিছু আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন আছে। মানুষ হিসেবে বাঁচার প্রয়োজন আছে। অর্থই মানুষকে সাহস জোগায়। অর্থ না থাকলে মানসিকভাবে মানুষ দুর্বল হয়ে যায়। আর ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সবলরা দুর্বলের প্রতি অত্যাচার চালায়। আসলে মানসিকভাবে দুর্বল হলে শারীরিকভাবেও মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের পাশাপাশি প্রত্যেক নারীরও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজন আছে। এতে দুজনের মিলিত আয়-উপার্জনে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ বজায় থাকে। শুধু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই বা কেন বলি, নারীর সম্মানের বিষয়টিও এখানে জড়িত থাকে। নারী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে পরিবারেও তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এই যুগে সন্তানরাও মায়ের আর্থিক মর্যাদার বিষয়টি বোঝে। উপার্জনহীন মাকে সন্তানরাও দুর্বল মনে করে অবহেলার চোখে দেখে। ব্যাংক-ব্যালান্সহীন মায়ের একটু বেশি বয়স হলে দেখাশোনাও করতে চায় না। তাই নিজের মর্যাদা রক্ষায় প্রত্যেক নারীর স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। আর্থিক সঙ্গতি থাকা জরুরি। বিশ্বব্যাপী নারীরা বর্তমানে কর্মমুখর হয়ে উঠলেও বাংলাদেশে এখনো তেমনভাবে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অনেকটাই পিছিয়ে আছি আমরা। এখনো কর্মজগতে ঢোকার আগে দ্বিধায় ভুগতে হয় আমাদের। তবে আশার কথা, নিরক্ষর নারীদের এত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার সুযোগ নেই- ভাত-পানি জোগাড় করার লড়াইটাই তাদের মুখ্য। যে কোনো কাজ পাওয়া ও কাজ করাটাই মুখ্য। এজন্য দেখা গেছে, নিরক্ষর ও গ্রামীণ নারীদের চেয়ে শিক্ষিত নারীদের বেকারত্বের হার বেশি। কারণ কর্মসংস্থানের অভাব। আমাদের দেশে শিক্ষিত নারীর উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও খুব জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নারীর কর্মসংস্থান ৩৩ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার সিংহভাগ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থান। আসলে গ্রামের খোলা জায়গায় নানা উদ্যোগের সুযোগ রয়েছে। শহরের নারী ও শিক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থান ২০১৩ সালে ছিল ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। তা ২০১৪-১৫ সালে কমে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৮ শতাংশে। ২০১৬-১৭ সালে সামান্য কিছু বাড়ে। এদিকে শিক্ষিত নারীর হার বেড়ে গেলেও সেভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই শিক্ষিত নারী বেকারত্বের সংখ্যা কম নয়। শিক্ষিত নারী তথ্যপ্রযুক্তিতেও এগিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে এবং দক্ষতা বৃদ্ধি না পেলে সবই বিফলে যাবে। এজন্য যত প্রতিবন্ধকতাই থাকুক না কেন, তা দূর করেই এ খাতে দক্ষতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। এখন যেহেতু দেশের প্রায় অর্ধেক অফিস-আদালতের কাজ অনলাইনেই হচ্ছে, বাড়িতে বসেই হচ্ছে- সেহেতু তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশি বেশি নারীর দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। হয়তো এমন একটা সময় আসবে- যখন অফিস-আদালতে দু-চারজন গেলেই চলবে, বাকি সব কাজ অনলাইনেই হবে। আশা করি- তখন নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে আসবে, বিশেষ করে মজুরির ক্ষেত্রে। তখন শুধু কাজের মান বিবেচ্য হবে, জেন্ডার নয়। আমরা জানি, অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের নারীরা মজুরিতে বৈষম্যের শিকার সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলছে, অর্থনীতিতে নারীর অগ্রগতির ফলে নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশ আগের চেয়ে এগিয়েছে। এর সঙ্গে মজুরির ব্যবধানও কমে এসেছে। প্রকৃত পরিসংখ্যান তা নয়। তবে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে নারীদের অবস্থান আগের তুলনায় সামান্য বেশি হলেও নেপাল (৮০%) ও ভিয়েতনামের (৭৭%) চেয়ে অনেক কম। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে বাংলাদেশে শ্রমের দক্ষতা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা। তাই এ খাতে সরকার বা এনজিওগুলোর আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির মঙ্গল এতেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নারীর ভূমিকা কেমন হতে পারে, তা ভাবার সময় এখনই। গার্মেন্টে আমাদের হাজারো নারী শ্রমিক যুক্ত হয়েছেন বলেই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের রপ্তানি এখন ঈর্ষণীয়। সত্তরের দশকের শেষদিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটে। ২০১৩ সালে এ দেশের নারী শ্রমিকের অগ্রসরতার কারণে আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রা দাঁড়ায় ১৯ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বের সর্বাধিক রপ্তানিকৃত দেশ হিসেবে এখন চীনের পর বাংলাদেশের স্থান। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। তেমনি তথ্যপ্রযুক্তিতে যদি বেশি বেশি নারীদের যুক্ত করে দক্ষ করে তোলা যায়, তা হলে আরও একটি শিল্পবিপ্লব হবে বলে আশা করা যেতে পারে। পেন্ডামিকের কারণে নারীরা আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন- তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে বটে তবে সবাইকেই এগিয়ে আসতে ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিত্তবানদেরও ব্যাংকে অলস টাকা ফেলে না রেখে নারী-পুরুষ সবার জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরির আইডিয়া বের করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। নতুন আইডিয়া বের করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন প্রজন্মকে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার আহ্বান জানাই।

ট্যাগ :

অনলাইন ব্যবসা ও নারীর কর্মসংস্থান

প্রকাশিত : ১২:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২১

পেন্ডামিকের এ সময়টায় ‘অনলাইন ব্যবসা’ চমৎকার একটি জায়গা করে নিয়েছে। আগে থেকেই সামান্য কলবরে হলেও কঠিন এ সময়টায় আমাদের দেশে এই ব্যবসা বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে। গৃহকর্মীরাও এখন শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। জিজ্ঞেস করে- ‘কে আইনা দিল, কৈ পাইলেন, অনলাইন?’ অনলাইনে সালোয়ার-কামিজ বেচাকেনার কথা ওরাও জানে। না কিনলেও ছবি দেখে মজা পায়। এভাবেই খুব ধীরে ধীরে অনলাইন ব্যবসা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত হয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের লড়াই করে বেঁচে থাকার পথ করে দিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে মানুষ লড়াই করেই আজকের সভ্যতায় পৌঁছেছে। এই পেন্ডামিকের সময় বাঁচা-মরা নিয়ে যখন মানুষ দিশাহারা, জীবন-জীবিকা নিয়ে দিশাহারা- অনলাইন ব্যবসা তখন অনেককেই আশার আলো দেখিয়েছে। প্রতিদিনের চাহিদাগুলো অনলাইনের অর্ডারে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে নিজেরাও বেঁচেছেন। বিশেষ করে বয়স্ক যারা ভয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন না বা এখনো হন না কিংবা বের হওয়াও বিপজ্জনক ছিল, তাদের জন্য অনলাইনের কেনাকাটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যারা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন বা দেন, তারাও দুই পয়সা আয় করে নিজেদের বাঁচিয়েছেন। আমার চেনা-জানা বহু মানুষ অনলাইনে মাছসহ অন্যান্য জিনিস কেনাকাটা এখনো করে। না, এই ব্যবসায় শুধু যে পুরুষরা অধিকার করে আছে- তা নয়, বহু নারী এখন এর সঙ্গে জড়িত। নারীরাও পুরুষশাসিত এ সমাজে লড়াই করেই তাদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। যারা কোনোদিন ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ভাবতেও পারেননি, তারা এই দুর্দিনে ঘরের পুরুষদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থানের এ বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে হ্যাঁ, যারা স্বল্পপুঁজি নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন কিংবা এখনো নতুন করে শুরু করার কথা ভাবছেন- তারা কিছু বিষয় মাথায় রেখে শুরু করলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আমার মনে হয়, প্রথমেই কোন পণ্যটির চাহিদা বাজারে সবচেয়ে বেশি- এ বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে পারলে ভালো হয়। আমার এক অতি আহ্লাদি ছোট বোন ফোনে একদিন তার অনলাইন ব্যবসা শুরু করার কথা জানালে খুব আশ্চর্য না হয়ে খুব খুশি হয়েছি। তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই শুধু প্রয়োজন না থাকলেও পণ্যটি কিনেছি। সম্ভবত কট্টর পুরুষও এখন বুঝতে পেরেছেন যে, নারীর নিজস্ব কিছু আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন আছে। মানুষ হিসেবে বাঁচার প্রয়োজন আছে। অর্থই মানুষকে সাহস জোগায়। অর্থ না থাকলে মানসিকভাবে মানুষ দুর্বল হয়ে যায়। আর ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সবলরা দুর্বলের প্রতি অত্যাচার চালায়। আসলে মানসিকভাবে দুর্বল হলে শারীরিকভাবেও মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের পাশাপাশি প্রত্যেক নারীরও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজন আছে। এতে দুজনের মিলিত আয়-উপার্জনে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ বজায় থাকে। শুধু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই বা কেন বলি, নারীর সম্মানের বিষয়টিও এখানে জড়িত থাকে। নারী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে পরিবারেও তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এই যুগে সন্তানরাও মায়ের আর্থিক মর্যাদার বিষয়টি বোঝে। উপার্জনহীন মাকে সন্তানরাও দুর্বল মনে করে অবহেলার চোখে দেখে। ব্যাংক-ব্যালান্সহীন মায়ের একটু বেশি বয়স হলে দেখাশোনাও করতে চায় না। তাই নিজের মর্যাদা রক্ষায় প্রত্যেক নারীর স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। আর্থিক সঙ্গতি থাকা জরুরি। বিশ্বব্যাপী নারীরা বর্তমানে কর্মমুখর হয়ে উঠলেও বাংলাদেশে এখনো তেমনভাবে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অনেকটাই পিছিয়ে আছি আমরা। এখনো কর্মজগতে ঢোকার আগে দ্বিধায় ভুগতে হয় আমাদের। তবে আশার কথা, নিরক্ষর নারীদের এত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার সুযোগ নেই- ভাত-পানি জোগাড় করার লড়াইটাই তাদের মুখ্য। যে কোনো কাজ পাওয়া ও কাজ করাটাই মুখ্য। এজন্য দেখা গেছে, নিরক্ষর ও গ্রামীণ নারীদের চেয়ে শিক্ষিত নারীদের বেকারত্বের হার বেশি। কারণ কর্মসংস্থানের অভাব। আমাদের দেশে শিক্ষিত নারীর উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও খুব জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নারীর কর্মসংস্থান ৩৩ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার সিংহভাগ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থান। আসলে গ্রামের খোলা জায়গায় নানা উদ্যোগের সুযোগ রয়েছে। শহরের নারী ও শিক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থান ২০১৩ সালে ছিল ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। তা ২০১৪-১৫ সালে কমে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৮ শতাংশে। ২০১৬-১৭ সালে সামান্য কিছু বাড়ে। এদিকে শিক্ষিত নারীর হার বেড়ে গেলেও সেভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই শিক্ষিত নারী বেকারত্বের সংখ্যা কম নয়। শিক্ষিত নারী তথ্যপ্রযুক্তিতেও এগিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে এবং দক্ষতা বৃদ্ধি না পেলে সবই বিফলে যাবে। এজন্য যত প্রতিবন্ধকতাই থাকুক না কেন, তা দূর করেই এ খাতে দক্ষতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। এখন যেহেতু দেশের প্রায় অর্ধেক অফিস-আদালতের কাজ অনলাইনেই হচ্ছে, বাড়িতে বসেই হচ্ছে- সেহেতু তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশি বেশি নারীর দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। হয়তো এমন একটা সময় আসবে- যখন অফিস-আদালতে দু-চারজন গেলেই চলবে, বাকি সব কাজ অনলাইনেই হবে। আশা করি- তখন নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে আসবে, বিশেষ করে মজুরির ক্ষেত্রে। তখন শুধু কাজের মান বিবেচ্য হবে, জেন্ডার নয়। আমরা জানি, অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের নারীরা মজুরিতে বৈষম্যের শিকার সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলছে, অর্থনীতিতে নারীর অগ্রগতির ফলে নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশ আগের চেয়ে এগিয়েছে। এর সঙ্গে মজুরির ব্যবধানও কমে এসেছে। প্রকৃত পরিসংখ্যান তা নয়। তবে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে নারীদের অবস্থান আগের তুলনায় সামান্য বেশি হলেও নেপাল (৮০%) ও ভিয়েতনামের (৭৭%) চেয়ে অনেক কম। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে বাংলাদেশে শ্রমের দক্ষতা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা। তাই এ খাতে সরকার বা এনজিওগুলোর আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির মঙ্গল এতেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নারীর ভূমিকা কেমন হতে পারে, তা ভাবার সময় এখনই। গার্মেন্টে আমাদের হাজারো নারী শ্রমিক যুক্ত হয়েছেন বলেই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের রপ্তানি এখন ঈর্ষণীয়। সত্তরের দশকের শেষদিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটে। ২০১৩ সালে এ দেশের নারী শ্রমিকের অগ্রসরতার কারণে আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রা দাঁড়ায় ১৯ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বের সর্বাধিক রপ্তানিকৃত দেশ হিসেবে এখন চীনের পর বাংলাদেশের স্থান। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। তেমনি তথ্যপ্রযুক্তিতে যদি বেশি বেশি নারীদের যুক্ত করে দক্ষ করে তোলা যায়, তা হলে আরও একটি শিল্পবিপ্লব হবে বলে আশা করা যেতে পারে। পেন্ডামিকের কারণে নারীরা আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন- তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে বটে তবে সবাইকেই এগিয়ে আসতে ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিত্তবানদেরও ব্যাংকে অলস টাকা ফেলে না রেখে নারী-পুরুষ সবার জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরির আইডিয়া বের করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। নতুন আইডিয়া বের করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন প্রজন্মকে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার আহ্বান জানাই।