০৬:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

টিকা নিতে কোনো দ্বিধা নয়

  • আ ব ম ফারুক
  • প্রকাশিত : ১২:০০:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • 35

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন থেকে শুরু হলো বাংলাদেশে গণমানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার জাতীয় কর্মসূচি। এদিন সম্মুখসারির যোদ্ধাসহ সারা দেশে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ টিকা নিয়েছে, যাদের মধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারাও ছিলেন। তাঁরা নিজেরা টিকা নিয়ে অন্যদেরও টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এটি খুবই ভালো একটি উদ্যোগ এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা দ্বিধান্বিত, তারা ভরসা পাবে যে সরকারের উচ্চ কর্মকর্তারাও টিকা নিতে যখন এগিয়ে এসেছেন, তখন ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন। পৃথিবীর প্রায় ২০০ দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৪টি দেশে করোনার টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে, যদিও এদের সবার কাছে এটি চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত টিকা নেই। আমাদের আছে। কারণ বাংলাদেশের হাতে এই মুহূর্তেই আছে ৭০ লাখ টিকা, যা জার্মানি, কানাডার মতো উন্নত দেশেও নেই।
জার্মানির বায়োএনটেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজারের সঙ্গে মিলে করোনার টিকা আবিষ্কার করলেও নিজের দেশের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে তারা টিকা দেওয়া শুরু করলেও এখন জার্মান সরকারের হাতে কোনো মজুদ না থাকায় তাদের টিকা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। জার্মান সরকার বাধ্য হয়ে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভরসায় বসে না থেকে এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বারস্থ হয়েছে। এদের সঙ্গে জার্মানির আগে থেকেই টিকা সরবরাহের একটি চুক্তি ছিল। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনেকা চুক্তির মাত্র শতকরা চার ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করতে পেরেছে। এর বেশি তারা পারবে না বলে জানিয়েছেও। জার্মান সরকার এখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে হুমকি দিয়েছে।
উন্নত বিশ্বের আরেকটি অন্যতম দেশ কানাডার অবস্থা আরো করুণ। তারা প্রথম দিকেই অর্থাৎ টিকার গবেষণা চলার সময়ই বিভিন্ন দেশের সাতটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে অর্থ পরিশোধ করেছিল, যাতে টিকা বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে টিকা পেয়ে যায়। কানাডার মোট জনসংখ্যা তিন কোটি ৭০ লাখ। তারা এত বেশি টিকার অর্ডার দিয়েছিল যে চুক্তিমতো সব টিকা পেলে মাথাপিছু ১০টি ডোজ হয়, অথচ প্রয়োজন মাত্র দুটি। ডিসেম্বরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তারা কিছু লোককে টিকা দিয়েছে, যা জনসংখ্যার মাত্র ২.৩ শতাংশ। কিন্তু এখন তাদের হাতে আর টিকা নেই। ফলে সারা দেশে সমালোচনার ঢেউ বইছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে আগামী মাসে অর্থাৎ মার্চে ফাইজার-বায়োএনটেক থেকে ৪০ লাখ ডোজ এবং মডার্না থেকে ২০ লাখ ডোজ পাবেন। তার পরের তিন মাসে পাবেন দুই কোটি ডোজ। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে নিজের দেশের লোকদের আগে টিকা না দিয়ে কোথাও টিকা রপ্তানি করা যাবে না। এর ফলে কানাডা পড়েছে নতুন সংকটে। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এটি সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার নানা রকম সহযোগিতা চুক্তির বরখেলাপ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলে দিয়েছে, আগে তারা প্রত্যেক মার্কিনের হাতে টিকা পুশ করবে, তারপর অন্য কথা।
বাধ্য হয়ে কানাডা এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগে ইউরোপের দেশগুলোকে টিকা দিতে হবে। ব্রিটেন বাদে এসব দেশের কারোরই টিকার অভাবে টিকা কর্মসূচি চলমান নেই। ইউরোপজুড়ে টিকার জন্য হাহাকার। ইইউ তাই ইউরোপ থেকে টিকা রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইইউ এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। কারণ তারা নিষেধাজ্ঞার অনেক আগেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করে দামও অগ্রিম পরিশোধ করেছে। এখন তারা জুনের আগে ১৯ লাখ ডোজের সঙ্গে প্রতিশ্রুত আরো দুই কোটি ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে চাইছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট কয়েক দিন আগে টিকা আবিষ্কারক কম্পানিগুলোকে দোষারোপ করে বলেছেন, তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত টিকার কোনো চালানই পাঠায়নি। ফলে তাঁরা সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও টিকাদান শুরু করতে পারছেন না।
উন্নত বিশ্বের আরেক মডেল জাপানের অবস্থাও টিকার ক্ষেত্রে উন্নত নয়। তারাও টিকা পাচ্ছে না। তারা যত দামই হোক, টিকা কেনার জন্য খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মেক্সিকো তাদের প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এত দিন টিকার জন্য নির্ভর করে বসে ছিল; কিন্তু পাচ্ছে না। ফাইজারের কাছ থেকে ১৫ লাখ ডোজ টিকা পাবে বলে এখনো তারা আশা করছে। এরই মধ্যে সেখানে কভিডে মারা গেছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। দিন দিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। এই মাসে তারা রাশিয়ার গামালিয়া রিসার্চ থেকে প্রায় ৯ লাখ ডোজ টিকা পাবে। কিন্তু এই নগণ্য পরিমাণ দিয়ে কী হবে? ফলে তারা অনন্যোপায় হয়ে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে ধরনা দিয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছেও টিকা নেই। তবে তারা মেক্সিকোর দুর্দশা দেখে বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন তারা ভারতের সেরাম ইন্ডিয়া থেকে আট লাখ ৭০ হাজার ডোজ টিকা এই ফেব্রুয়ারি মাসেই পাবে। সেই সঙ্গে তারা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভবিষ্যতের বিপুল চাহিদা মেটানোর জন্য মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনা মিলে সেখানে একটি কারখানা দেবে, যেখানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি হবে। এখান থেকে পুরো লাতিন আমেরিকায় টিকা সরবরাহ করা হবে, বড়লোক দেশগুলোর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে না।
তবে ইরান সংকট কাটিয়ে উঠছে। তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্র দূরের কথা, পশ্চিমা বিশ্ব থেকেই টিকা কিনতে পারছিল না। মানবিক সংকটের দোহাই দিয়েও না। অবশ্য বিশ্বজনমতের চাপে টিকার দাম পরিশোধ করার জন্য তাদের ব্যাংক তহবিল আংশিক অবমুক্ত হয়েছে। এখন তারা সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো কম্পানিকে দাম পরিশোধ করতে পারবে। এর মধ্যে তারা রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা কিনছে এবং তার প্রথম চালান এরই মধ্যে তেহরানে পৌঁছেছে। কিন্তু তাদের সাফল্যটি অন্য জায়গায়। তা হলো তারা শুরু থেকেই জানত যে পাশ্চাত্য তাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। তাই তারা গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই টিকা বের করার চেষ্টা শুরু করেছিল। তাদের বারাকাত নামের ওষুধ কম্পানি প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে এখন মানবদেহে প্রয়োগের মাধ্যমে ফেজ-১ শুরু করে টিকার নাম দিয়েছে ‘কভিরান বারাকাত’। পাশাপাশি তারা রাশিয়া থেকে স্পুটনিক-ভি শুধু আমদানিই করছে না, তারা যৌথভাবে এই টিকা ইরানে উৎপাদনও করবে।
তবে জবর খবর এসেছে পাকিস্তান থেকে। সেখানকার বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, পাকিস্তান এখন পর্যন্ত তার দেশে কাউকে কোনো টিকা দিতে পারেনি। চীনের ওপর সে নির্ভর করে অপেক্ষায় ছিল। চীনও বলেছিল, পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় সব টিকা তারা দেবে। কিন্তু এত দিন অপেক্ষায় রাখার পর সিনোভ্যাক মাত্র পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে। এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের ভাষ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের কর্মকর্তারা খেপে গিয়ে বলেছেন, দিস ইজ নাথিং। পাকিস্তানে করোনা টেস্টের অবকাঠামোগত সুবিধা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক দুর্বল। তার পরও দৈনিক পরীক্ষার অতি সীমিত হিসাবেও করোনার ক্রমাগত বিস্তার ও প্রতিদিনের প্রাণহানির সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই পাকিস্তানের বিশাল জনসংখ্যার মানুষকে আরো আগেই টিকা দেওয়ার জন্য তারা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু টিকা না পাওয়ায় তা তারা শুরু করতে পারেনি। এখন ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ এই বাগধারার মতো বিশাল জনসংখ্যার জন্য পাঁচ লাখ টিকা নিয়ে তারা কোথায় দাঁড়াবে? অবশেষে তাদের চিরবৈরী দেশ ভারতের কাছ থেকে সেরাম ইন্ডিয়ার তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা চেয়েছে পাকিস্তান। ভারত সরকারও সমূহ বিপদের দিনে মানুষের জীবন বাঁচাতে বৈরিতা ভুলে পারস্পরিক সহযোগিতার সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাবে এক কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনের নিরিখে এখন থেকেই নাকি এই টিকা সরবরাহ শুরু হবে এবং আগামী এপ্রিলের মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাকিস্তানে পৌঁছাবে।
করোনার টিকা যখন ছিল না, তখন বিশ্ববাসী মুখিয়ে ছিল কবে টিকা আসবে। টিকা আসার পর এখন বিশ্বময় টিকা নিয়ে শুরু হয়েছে এক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি, সোজা ভাষায় ‘বিতিকিচ্ছি কারবার’, ওপরের উদাহরণগুলোই এর প্রতিফলন। পৃথিবীর মাত্র এক-চতুর্থাংশ দেশে টিকা দেওয়া হচ্ছে। বাকি দেশগুলো টিকার অভাবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে, তাদের বলার কিছু ছিল না, এখনো নেই।
আমাদের সরকারকে ধন্যবাদ যে এই হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশে টিকার জন্য কোনো হাহাকার নেই। ৭ তারিখে টিকা নেওয়ার পর আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সংবাদ কর্মীদের বলেছেন, ‘আমার স্ত্রী ও আমি টিকা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। …দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের আমিসহ সাতজন এবং হাইকোর্ট বিভাগের ৪০ জন বিচারপতি টিকা নিয়েছেন। আমি দেশবাসীকে বলব, ‘সবাই যেন তাড়াতাড়ি নিবন্ধন করে টিকা নিয়ে নেন। …স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবার আগে টিকা দেওয়া হয়েছে, এটা প্রধানমন্ত্রীর বিশাল কৃতিত্ব।’ অন্য ভিআইপি যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের কথার মধ্যেও ছিল এই একই সুর। এর সঙ্গে আমরাও একমত।
সেদিন বাংলাদেশের নির্বাচিত এক হাজার পাঁচটি হাসপাতাল থেকে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়। সম্মুখসারির যোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রমুখের সঙ্গে বয়স্ক ও প্রবীণ সর্বস্তরের অগুনতি সাধারণ মানুষও টিকা নিয়েছে। তারাও মাননীয় প্রধান বিচারপতির মতোই অভিন্ন কথা বলেছে। তারা কেউ টিকা নেওয়ার পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা সমস্যা হয়েছে বলে বলেনি। যদিও এই ভয়টি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি মহল থেকে ইন্টারনেটে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল; কিন্তু তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই অপপ্রচারের কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভাবছিলাম হয়তো প্রথম দিন বেশি মানুষ টিকা নিতে আসবে না। কিন্তু আমার আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে টিকা নিতে এসেছে। বয়স্কদের টিকা নিলে অসুবিধা হতে পারে, এই প্রমাণিত অসত্য প্রচারটিও হালে পানি পায়নি। সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে যে পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে তার জনগণের জন্য টিকা দেওয়ার এই কাজ শুরু করেছে। গণমাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে উৎফুল্ল এসব সাধারণ মানুষ এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।
সারা বিশ্বে মানুষ যেখানে টিকার জন্য ব্যাকুল, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো যখন হন্যে হয়ে সর্বত্র টিকা খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ সরকার শুধু প্রথম দিনের জন্যই তার টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সাড়ে পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়ে রেখেছিল। কিন্তু টিকা প্রশ্নে সরকারের এত সাফল্যকেও যাঁরা স্বীকার করতে চান না, তাঁরা সাধারণ মানুষকে টিকা না নেওয়ার জন্য বলেছিলেন, ‘এই টিকা অক্সফোর্ডের নয়, ভারতের তৈরি’, ‘ভারত এই টিকার বদলে পানি দিয়ে দেবে’, ‘এটা মানুষের টিকা না মুরগির টিকা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে’ ইত্যাকার আরো কিছু কথা। বিশ্বের পরিস্থিতি এবং গত ৭ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত টিকার মোবাইল অ্যাপ কাজ না করার পরেও টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে এসব অপপ্রচার মানুষ আর বিশ্বাস করছে না। এমনকি অপপ্রচারকারীদের নেতারাও এখন এই টিকা নিচ্ছেন। টিকার অপপ্রচারকারীদের ‘জান পেহেচান মুরব্বি’ পাকিস্তানও যখন ভারতের এই টিকাটিই কিনছে, তখন তারা মানুষের কাছে আর মুখ দেখাবে কিভাবে? তারা এখন মুখ লুকাতে বাধ্য। তবে তাদের কদর্য মুখ লুকানোর আগে এই ‘পেয়ারা পাকিস্তানওয়ালা’দেরও যথাশীঘ্র সম্ভব এই টিকা নিয়ে নিতে অনুরোধ করছি।
লেখক : অধ্যাপক পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগ :

৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দিতে হবে 

টিকা নিতে কোনো দ্বিধা নয়

প্রকাশিত : ১২:০০:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন থেকে শুরু হলো বাংলাদেশে গণমানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার জাতীয় কর্মসূচি। এদিন সম্মুখসারির যোদ্ধাসহ সারা দেশে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ টিকা নিয়েছে, যাদের মধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারাও ছিলেন। তাঁরা নিজেরা টিকা নিয়ে অন্যদেরও টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এটি খুবই ভালো একটি উদ্যোগ এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা দ্বিধান্বিত, তারা ভরসা পাবে যে সরকারের উচ্চ কর্মকর্তারাও টিকা নিতে যখন এগিয়ে এসেছেন, তখন ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন। পৃথিবীর প্রায় ২০০ দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৪টি দেশে করোনার টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে, যদিও এদের সবার কাছে এটি চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত টিকা নেই। আমাদের আছে। কারণ বাংলাদেশের হাতে এই মুহূর্তেই আছে ৭০ লাখ টিকা, যা জার্মানি, কানাডার মতো উন্নত দেশেও নেই।
জার্মানির বায়োএনটেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজারের সঙ্গে মিলে করোনার টিকা আবিষ্কার করলেও নিজের দেশের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে তারা টিকা দেওয়া শুরু করলেও এখন জার্মান সরকারের হাতে কোনো মজুদ না থাকায় তাদের টিকা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। জার্মান সরকার বাধ্য হয়ে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভরসায় বসে না থেকে এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বারস্থ হয়েছে। এদের সঙ্গে জার্মানির আগে থেকেই টিকা সরবরাহের একটি চুক্তি ছিল। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনেকা চুক্তির মাত্র শতকরা চার ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করতে পেরেছে। এর বেশি তারা পারবে না বলে জানিয়েছেও। জার্মান সরকার এখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে হুমকি দিয়েছে।
উন্নত বিশ্বের আরেকটি অন্যতম দেশ কানাডার অবস্থা আরো করুণ। তারা প্রথম দিকেই অর্থাৎ টিকার গবেষণা চলার সময়ই বিভিন্ন দেশের সাতটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে অর্থ পরিশোধ করেছিল, যাতে টিকা বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে টিকা পেয়ে যায়। কানাডার মোট জনসংখ্যা তিন কোটি ৭০ লাখ। তারা এত বেশি টিকার অর্ডার দিয়েছিল যে চুক্তিমতো সব টিকা পেলে মাথাপিছু ১০টি ডোজ হয়, অথচ প্রয়োজন মাত্র দুটি। ডিসেম্বরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তারা কিছু লোককে টিকা দিয়েছে, যা জনসংখ্যার মাত্র ২.৩ শতাংশ। কিন্তু এখন তাদের হাতে আর টিকা নেই। ফলে সারা দেশে সমালোচনার ঢেউ বইছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে আগামী মাসে অর্থাৎ মার্চে ফাইজার-বায়োএনটেক থেকে ৪০ লাখ ডোজ এবং মডার্না থেকে ২০ লাখ ডোজ পাবেন। তার পরের তিন মাসে পাবেন দুই কোটি ডোজ। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে নিজের দেশের লোকদের আগে টিকা না দিয়ে কোথাও টিকা রপ্তানি করা যাবে না। এর ফলে কানাডা পড়েছে নতুন সংকটে। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এটি সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার নানা রকম সহযোগিতা চুক্তির বরখেলাপ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলে দিয়েছে, আগে তারা প্রত্যেক মার্কিনের হাতে টিকা পুশ করবে, তারপর অন্য কথা।
বাধ্য হয়ে কানাডা এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগে ইউরোপের দেশগুলোকে টিকা দিতে হবে। ব্রিটেন বাদে এসব দেশের কারোরই টিকার অভাবে টিকা কর্মসূচি চলমান নেই। ইউরোপজুড়ে টিকার জন্য হাহাকার। ইইউ তাই ইউরোপ থেকে টিকা রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইইউ এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। কারণ তারা নিষেধাজ্ঞার অনেক আগেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করে দামও অগ্রিম পরিশোধ করেছে। এখন তারা জুনের আগে ১৯ লাখ ডোজের সঙ্গে প্রতিশ্রুত আরো দুই কোটি ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে চাইছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট কয়েক দিন আগে টিকা আবিষ্কারক কম্পানিগুলোকে দোষারোপ করে বলেছেন, তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত টিকার কোনো চালানই পাঠায়নি। ফলে তাঁরা সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও টিকাদান শুরু করতে পারছেন না।
উন্নত বিশ্বের আরেক মডেল জাপানের অবস্থাও টিকার ক্ষেত্রে উন্নত নয়। তারাও টিকা পাচ্ছে না। তারা যত দামই হোক, টিকা কেনার জন্য খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মেক্সিকো তাদের প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এত দিন টিকার জন্য নির্ভর করে বসে ছিল; কিন্তু পাচ্ছে না। ফাইজারের কাছ থেকে ১৫ লাখ ডোজ টিকা পাবে বলে এখনো তারা আশা করছে। এরই মধ্যে সেখানে কভিডে মারা গেছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। দিন দিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। এই মাসে তারা রাশিয়ার গামালিয়া রিসার্চ থেকে প্রায় ৯ লাখ ডোজ টিকা পাবে। কিন্তু এই নগণ্য পরিমাণ দিয়ে কী হবে? ফলে তারা অনন্যোপায় হয়ে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে ধরনা দিয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছেও টিকা নেই। তবে তারা মেক্সিকোর দুর্দশা দেখে বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন তারা ভারতের সেরাম ইন্ডিয়া থেকে আট লাখ ৭০ হাজার ডোজ টিকা এই ফেব্রুয়ারি মাসেই পাবে। সেই সঙ্গে তারা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভবিষ্যতের বিপুল চাহিদা মেটানোর জন্য মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনা মিলে সেখানে একটি কারখানা দেবে, যেখানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি হবে। এখান থেকে পুরো লাতিন আমেরিকায় টিকা সরবরাহ করা হবে, বড়লোক দেশগুলোর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে না।
তবে ইরান সংকট কাটিয়ে উঠছে। তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্র দূরের কথা, পশ্চিমা বিশ্ব থেকেই টিকা কিনতে পারছিল না। মানবিক সংকটের দোহাই দিয়েও না। অবশ্য বিশ্বজনমতের চাপে টিকার দাম পরিশোধ করার জন্য তাদের ব্যাংক তহবিল আংশিক অবমুক্ত হয়েছে। এখন তারা সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো কম্পানিকে দাম পরিশোধ করতে পারবে। এর মধ্যে তারা রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা কিনছে এবং তার প্রথম চালান এরই মধ্যে তেহরানে পৌঁছেছে। কিন্তু তাদের সাফল্যটি অন্য জায়গায়। তা হলো তারা শুরু থেকেই জানত যে পাশ্চাত্য তাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। তাই তারা গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই টিকা বের করার চেষ্টা শুরু করেছিল। তাদের বারাকাত নামের ওষুধ কম্পানি প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে এখন মানবদেহে প্রয়োগের মাধ্যমে ফেজ-১ শুরু করে টিকার নাম দিয়েছে ‘কভিরান বারাকাত’। পাশাপাশি তারা রাশিয়া থেকে স্পুটনিক-ভি শুধু আমদানিই করছে না, তারা যৌথভাবে এই টিকা ইরানে উৎপাদনও করবে।
তবে জবর খবর এসেছে পাকিস্তান থেকে। সেখানকার বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, পাকিস্তান এখন পর্যন্ত তার দেশে কাউকে কোনো টিকা দিতে পারেনি। চীনের ওপর সে নির্ভর করে অপেক্ষায় ছিল। চীনও বলেছিল, পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় সব টিকা তারা দেবে। কিন্তু এত দিন অপেক্ষায় রাখার পর সিনোভ্যাক মাত্র পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে। এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের ভাষ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের কর্মকর্তারা খেপে গিয়ে বলেছেন, দিস ইজ নাথিং। পাকিস্তানে করোনা টেস্টের অবকাঠামোগত সুবিধা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক দুর্বল। তার পরও দৈনিক পরীক্ষার অতি সীমিত হিসাবেও করোনার ক্রমাগত বিস্তার ও প্রতিদিনের প্রাণহানির সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই পাকিস্তানের বিশাল জনসংখ্যার মানুষকে আরো আগেই টিকা দেওয়ার জন্য তারা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু টিকা না পাওয়ায় তা তারা শুরু করতে পারেনি। এখন ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ এই বাগধারার মতো বিশাল জনসংখ্যার জন্য পাঁচ লাখ টিকা নিয়ে তারা কোথায় দাঁড়াবে? অবশেষে তাদের চিরবৈরী দেশ ভারতের কাছ থেকে সেরাম ইন্ডিয়ার তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা চেয়েছে পাকিস্তান। ভারত সরকারও সমূহ বিপদের দিনে মানুষের জীবন বাঁচাতে বৈরিতা ভুলে পারস্পরিক সহযোগিতার সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাবে এক কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনের নিরিখে এখন থেকেই নাকি এই টিকা সরবরাহ শুরু হবে এবং আগামী এপ্রিলের মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাকিস্তানে পৌঁছাবে।
করোনার টিকা যখন ছিল না, তখন বিশ্ববাসী মুখিয়ে ছিল কবে টিকা আসবে। টিকা আসার পর এখন বিশ্বময় টিকা নিয়ে শুরু হয়েছে এক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি, সোজা ভাষায় ‘বিতিকিচ্ছি কারবার’, ওপরের উদাহরণগুলোই এর প্রতিফলন। পৃথিবীর মাত্র এক-চতুর্থাংশ দেশে টিকা দেওয়া হচ্ছে। বাকি দেশগুলো টিকার অভাবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে, তাদের বলার কিছু ছিল না, এখনো নেই।
আমাদের সরকারকে ধন্যবাদ যে এই হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশে টিকার জন্য কোনো হাহাকার নেই। ৭ তারিখে টিকা নেওয়ার পর আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সংবাদ কর্মীদের বলেছেন, ‘আমার স্ত্রী ও আমি টিকা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। …দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের আমিসহ সাতজন এবং হাইকোর্ট বিভাগের ৪০ জন বিচারপতি টিকা নিয়েছেন। আমি দেশবাসীকে বলব, ‘সবাই যেন তাড়াতাড়ি নিবন্ধন করে টিকা নিয়ে নেন। …স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবার আগে টিকা দেওয়া হয়েছে, এটা প্রধানমন্ত্রীর বিশাল কৃতিত্ব।’ অন্য ভিআইপি যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের কথার মধ্যেও ছিল এই একই সুর। এর সঙ্গে আমরাও একমত।
সেদিন বাংলাদেশের নির্বাচিত এক হাজার পাঁচটি হাসপাতাল থেকে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়। সম্মুখসারির যোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রমুখের সঙ্গে বয়স্ক ও প্রবীণ সর্বস্তরের অগুনতি সাধারণ মানুষও টিকা নিয়েছে। তারাও মাননীয় প্রধান বিচারপতির মতোই অভিন্ন কথা বলেছে। তারা কেউ টিকা নেওয়ার পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা সমস্যা হয়েছে বলে বলেনি। যদিও এই ভয়টি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি মহল থেকে ইন্টারনেটে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল; কিন্তু তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই অপপ্রচারের কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভাবছিলাম হয়তো প্রথম দিন বেশি মানুষ টিকা নিতে আসবে না। কিন্তু আমার আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে টিকা নিতে এসেছে। বয়স্কদের টিকা নিলে অসুবিধা হতে পারে, এই প্রমাণিত অসত্য প্রচারটিও হালে পানি পায়নি। সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে যে পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে তার জনগণের জন্য টিকা দেওয়ার এই কাজ শুরু করেছে। গণমাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে উৎফুল্ল এসব সাধারণ মানুষ এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।
সারা বিশ্বে মানুষ যেখানে টিকার জন্য ব্যাকুল, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো যখন হন্যে হয়ে সর্বত্র টিকা খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ সরকার শুধু প্রথম দিনের জন্যই তার টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সাড়ে পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়ে রেখেছিল। কিন্তু টিকা প্রশ্নে সরকারের এত সাফল্যকেও যাঁরা স্বীকার করতে চান না, তাঁরা সাধারণ মানুষকে টিকা না নেওয়ার জন্য বলেছিলেন, ‘এই টিকা অক্সফোর্ডের নয়, ভারতের তৈরি’, ‘ভারত এই টিকার বদলে পানি দিয়ে দেবে’, ‘এটা মানুষের টিকা না মুরগির টিকা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে’ ইত্যাকার আরো কিছু কথা। বিশ্বের পরিস্থিতি এবং গত ৭ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত টিকার মোবাইল অ্যাপ কাজ না করার পরেও টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে এসব অপপ্রচার মানুষ আর বিশ্বাস করছে না। এমনকি অপপ্রচারকারীদের নেতারাও এখন এই টিকা নিচ্ছেন। টিকার অপপ্রচারকারীদের ‘জান পেহেচান মুরব্বি’ পাকিস্তানও যখন ভারতের এই টিকাটিই কিনছে, তখন তারা মানুষের কাছে আর মুখ দেখাবে কিভাবে? তারা এখন মুখ লুকাতে বাধ্য। তবে তাদের কদর্য মুখ লুকানোর আগে এই ‘পেয়ারা পাকিস্তানওয়ালা’দেরও যথাশীঘ্র সম্ভব এই টিকা নিয়ে নিতে অনুরোধ করছি।
লেখক : অধ্যাপক পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়