সবাই এর মধ্যে জেনে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে গত ৬ এপ্রিল দিবাগত রাতে মিরপুর সাড়ে ১১ থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ২৩ বছর ধরে পলাতক ছিল এই ঠান্ডা মাথার খুনী। কলকাতায় আত্মগোপনে ছিল মাজেদ। আর আত্মগোপনের ছকটা এতোই নিখুঁত ছিল ছিল যে সরকার আর আইনশৃংখলা বাহিনীর কেউ টেরই পায়নি। কেবল আত্মগোপনই নয়, ভুয়া পরিচয়ে সেখানে দিব্যি সংসার পেতে বসবাস করছিল মাজেদ। সম্প্রতি কলকাতার একটি দৈনিকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সেই গোপন তথ্য। সেই গোপন তথ্য জানার আগে চলুন জেনে নিই এই খুনীকে নিয়ে কিছু তথ্য।
দেখুন সেই ভিডিওটি
https://youtube.com/watch?v=iXqX1_T2RAw
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার অন্যতম ঘাতক বরখাস্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের মরহুম আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, আবদুল মাজেদের পরিবার বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসের ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকায় বসবাস করছে। আবদুল মাজেদ ৪ কন্যা সন্তান ও এক পুত্র সন্তানের জনক। এদিকে কলকাতার সংসারের খবর মাত্রই হাতে এসেছে। সে আলাপে যাচ্ছি একটু পর।
আবদুল মাজেদ হলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় পলাতক ছয় খুনির মধ্যে একজন। পলাতক বাকি পাঁচ খুনি হলেন আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নং রোডে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ অন্য আসামিদের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। হত্যাকাান্ড শেষে মাজেদ অপর আসামি মেজর শাহরিয়ার ও হত্যাকান্ডে অংগ্রহণকারী অন্য সেনা সদস্যদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে দায়িত্ব পালন করে। এ ছাড়াও মাজেদ ক্যু করা অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গভবনে দেশত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। মাজেদ হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের সঙ্গে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের আদেশে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় যান। সেখানে সে ক্যু করা অফিসারদের সঙ্গে প্রায় ৩ মাস থাকে। সে সময়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্যু করা অফিসারদের হত্যাকান্ডের পুরস্কার স্বরূপ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে বৈদেশিক বদলি প্রদান করা হয়, তারই অংশ হিসেবে ক্যাপ্টেন মাজেদকে পুরস্কার হিসেবে সেনেগাল দূতাবাসে বদলির আদেশ দেন।
পরে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান সরকার ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে চাকরি দেন এবং উপসচিব পদে যোগদানের সুবিধার্থে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করে। পরে তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর মাজেদ মিনিস্ট্রি অব ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টে ডাইরেক্টর ইয়ুুথ ডেভেলপমেন্ট পদের জন্য আবেদন করে এবং ওই পদে যোগদান করে। সেখান থেকে মাজেদ ডাইরেক্টর অব হেড অব ন্যাশনাল সেভিংস ডিপার্টমেন্টে বদলি হয়। এ ছাড়া জেলে জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ডে অংশ নেয় এই আবদুল মাজেদ। জেলহত্যা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারকার্য শুরু করলে মাজেদ আটক হওয়ার ভয়ে আত্মগোপন করে। সেই যে পালানো আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কীভাবে যাবে? কলকাতায় মাস্টারমশাই সেজে সংসার পেতে বসেছিল এই মাজেদ।
সেখানকার দৈনিক বর্তমানের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে এর আদ্যোপান্ত।
ভারতের কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের ভাড়া বাড়িতে থাকতেন বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদ। তাঁকে কখনও উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেনি কেউ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন নিয়ম করে। সেই ‘মাস্টারমশাই’ নাকি বঙ্গবন্ধুর খুনি!
গত ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মিরপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি আবদুল মাজেদ গ্রেফতারের পর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে রীতিমতো অবাক বেডফোর্ড লেনের বাসিন্দারা!
কিন্তু আবদুল মাজেদ নয়! পার্ক স্ট্রিট তাঁকে চেনে আলি আহমেদ ওরফে ইংরেজির মাস্টারমশাই হিসেবে। এলাকার লোকে জানত, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে থেকে পাশ করেছেন মাস্টারমশাই। টিউশন পড়িয়ে সংসার চালাতেন তিনি। প্রথমে তালতলার ভাড়া বাড়িতে একাই থাকতেন মাজেদ। পরে পার্ক স্ট্রিটে চলে আসেন।
২০১১ সালে তাঁর থেকে ৩২ বছরের ছোট উলুবেড়িয়ার সেলিনা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। তাঁদের ৬ বছরের এক মেয়ে রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই ৭২ বছর বয়সী মাজেদের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পিজি হাসপাতালে একপ্রস্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি পিজি হাসপাতাল থেকে সেই রিপোর্ট আনতে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। সেটাই শেষ, আর বাড়ি ফেরা হয়নি মাজেদের। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন স্ত্রী রাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় নিঁখোজের ডায়েরি করেন। তদন্তে শুরু করে পার্ক স্ট্রিট থানা। পিজি হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ঘাটলেও হদিশ মেলে না মাজেদের।
এরপর পুলিশ মাজেদের ভাড়া বাড়ি থেকে একটি ব্যাগ পায়। সেই ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে সিম কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার আইডি, ভারতীয় পাসপোর্ট এবং এক মহিলাসহ তিনজন শিশুর ছবি পাওয়া যায়। স্ত্রী সেলিনা পুলিশকে জানায়, ব্যাগের মতো তাঁর অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসে কাউকে হাত দিতে দিতেন না মাজেদ।
মহল্লায় খুব একটা মেলামেশা করতেন না তিনি। টিউশনির পাশাপাশি বড়জোর এলাকার এক চায়ের দোকান, রেশন দোকান এবং এক বিল্ডার্সের দোকানে আড্ডা দিতেন মাজেদ। বাড়ির দরজায় সব সময় তালা লাগানো থাকত। বাইরের কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হতো না। এক আধ বছর নয়, এভাবেই প্রায় ২৩ বছর কলকাতায় আত্মগোপন করেছিলেন আবদুল মাজেদ।
এদিকে ৬ এপ্রিল আটকের পরপরই মাজেদের সাজা কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও সে আবেদন নাকচ হয়ে যায়। এরপর ১১ এপ্রল মধ্যরাত ১২টা ০১ মিনিটে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। প্রথমে তার জন্মস্থান ভোলায় লাশ দাফনের কথা শোনা গেলেও সেখান থেকে বাধা আসে। এরপর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের পর কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে মরদেহ সোনারগাঁয়ে দাফন করা হয়েছে। উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকায় মরদেহ দাফন করা হয়। এদিকে লাশ তুলে না নিলে এলাকার মানুষ লাশ মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। হোসেনপুর এলাকায় মাজেদের মরদেহ দাফনের খবর ছড়িয়ে পড়লে তার মরদেহ সেখান থেকে অপসারণের দাবিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেন তারা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব , ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টের নির্মম ও ন্যাক্কারজনক হত্যাযজ্ঞের অন্যতম আসামি সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত ক্যাপ্টেন মাজেদ মৃত্যুর পরও রয়ে গেছে ঘৃণীত।
বিজনেস বাংলাদেশ/ ই করিম
ভিডিও লিংক:
https://youtube.com/watch?v=iXqX1_T2RAw