০৩:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে আপন ঠিকানা

করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যটকশূন্য থাকায় কমেছে বর্জ্য। প্রাণ ফিরেছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যে। পর্যটননির্ভর এ নগরীর নাগরিক জীবনে কোভিড ১৯ মারাত্মক প্রভাব ফেললেও প্রকৃতির এ ভিন্ন সাজ নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ জাগিয়েছে অনেককেই। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, এবার মানুষের আনাগোনা কম ও সামুদ্রিক জাহাজ কম চলাচলের কারণে সামুদ্রিক কাছিমের বাচ্চা বেশি হয়েছে।

২০ জুন ১১ হাজার ৫৮২টি সামুদ্রিক কাছিমের বাচ্চা অবমুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে এবং পরিবেশ অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড কনসলিডেশন অব সিবিএ-ইসিএ প্রকল্প কর্তৃক কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্রসৈকত ইসিএ এবং সোনাদিয়া ইসিএ এলাকায় সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে পেঁচার দ্বীপ, উত্তর সোনারপাড়া, মাদারবনিয়া, সোনাদিয়া পূর্বপাড়া ও সোনাদিয়া পশ্চিমপাড়ায় সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ কেন্দ্র বা হ্যাচারি স্থাপন করা হয়। ওই হ্যাচারিগুলোতে জুন মাস পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৩৪০টি কাছিমের ডিম সংগ্রহ করা হয় এবং এ পর্যন্ত মোট ১১ হাজার ৫৬২টি সামুদ্রিক কাছিমের বাচ্চা সাগরে অবমুক্ত করা হয়।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘এবারে করোনাকালে মানুষের যাতায়াত কমেছে। মাছের চাহিদা কমে যাওয়ায় সামুদ্রিক যানের চলাচল কমেছে, তাতে সৈকতে কাছিমের আনাগোনা বেড়েছে। সৈকতে তারা ডিম পেড়েছেও আগের থেকে বেশি। সেই ডিম আমরা হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করেছি। কাছিম ডিম দিয়ে সমুদ্রে চলে যায়। সেগুলো আমাদের কর্মীরা সংগ্রহ করে। কৃত্রিম পরিবেশে তা রেখে বাচ্চা করা হয়। এবার এই পদ্ধতিতে প্রচুর বাচ্চা জন্মেছে, যা আগের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। গত বছর যেখানে সাত হাজারের মতো কাছিমের বাচ্চা পাওয়া গেছে, এবার তার দ্বিগুণ। এমন অবস্থা থাকলে আর এমন অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে কাছিমের সংখ্যা বাড়বে। তিনি আরো জানান, কাছিম সমুদ্রে বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো সমুদ্রের পরিবেশ ভালো আছে।

ডলফিনে আসছে সৈকতের কাছে : পর্যটকশূন্য কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের খুব কাছে দেখা গেছে বেশ কিছু ডলফিন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি ডলফিনের ছবিও ভিডিও দেখা গেছে। এর মধ্য কালো ডলফিনের পাশাপাশি দুর্লভ গোলাপি ডলফিনের দেখাও পেয়েছেন স্থানীয় লোকজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, তিনি ডলফিনের ভিডিওটি দেখেছেন। সেখানে যে গোলাপি ডলফিনটি দেখা গেছে, সেটি পূর্ণবয়স্ক। এরা সচরাচর উপকূলের কাছাকাছি থাকে। তবে সৈকতের এতটা কাছাকাছি তারা আসে না। এখন নিরিবিলি থাকায় হয়তো কাছে চলে এসেছিল। বাংলাদেশে যে কয়েক ধরনের ডলফিন আছে তার মধ্যে এটি অন্যগুলোর চেয়ে কম দেখা যায়।

ডলফিনের দেখা পাওয়ার খবরের পরপরই কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু মৃত ডলফিনের দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় সৈকতে। এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেন পরিবেশপ্রেমীরা। ডলফিন রক্ষার আদেশ আসে হাইকোর্ট থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘মৃত ডলফিন দেখেছি। এগুলো সৈকতের কাছাকাছি এসেছিল বলে মনে হচ্ছে। এরা অক্সিজেন বা শ্বাস নেয়ার জন্য পানির ওপর আসে। ধারণা করা হচ্ছে, মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে এরা শ্বাস নিতে না পেরে মারা গেছে। তবে এখন আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক আছি। ডলফিন যেন আর মারা না যায়, সে জন্য আমরা কাজ করছি ও নজরদারি বাড়িয়েছি।

নজর কাড়ছে সাগরলতা : কক্সবাজারে করোনার কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে পর্যটকদের থাকা নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। এতে সৈকতের পাড়ে বেড়ে উঠেছে সাগরলতা। সাগর পাড়ের সৌন্দর্য যেন বেড়ে গেছে এতে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলছিলেন, বলতে গেলে গত ১৮ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটকদের আসা-যাওয়া বন্ধ রয়েছে কক্সবাজারে। এ বিরল নির্জনতার সুযোগে সাগরপাড়ের পরিবেশের অন্যতম সদস্য সাগরলতা হয়েছে নবযৌবনা, মেলেছে গাঢ় সবুজ ডানা। এর ফুলগুলো বড় ও ফানেল আকৃতির, রং বেগুনি থেকে বেগুনি-গোলাপি। পাতাগুলো রসাল এবং বৃত্তাকার খাঁজকাটা টিপের মতো দেখতে। এই টিপ কিছুটা ‘ছাগলের পায়ের’ মতো দেখায় বলে ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছে ‘পেস ক্যাপ্রে।

জেলা প্রশাসক বললেন, ‘পড়ন্ত বিকেলে নির্জন সৈকতের দড়িয়ানগরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বালিয়াড়ির বুকে সৃজিত সবুজ কার্পেটের আদলে সাগরলতাগুলো। সাগরলতা স্থানীয়দের ভাষায় ডাউঙ্গালতা কিংবা গঙ্গালতা অথবা পিয়াজলতা। এটির অন্য সাধারণ নাম বিচ মর্নিং গ্লোরি। সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালুর পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির প্রধান কারিগর এই সাগরলতা। আর এ বালিয়াড়িই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ থেকে পরম মমতায় আগলে রাখে সমুদ্রসৈকত এবং সমুদ্রতীরের জনগোষ্ঠীকে।

সৈকতের বালুরাশির ওপর রেলপথের মতো বহমান লতার চারপাশে বিস্তৃত পুরু-ভারী সবুজ পাতা আর তার মাঝে বেগুনি কিংবা বেগুনি-গোলাপি ফুলের সমাহার দেখলেই জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শোভিত ফুল মৌমাছি, প্রজাপতি, পতঙ্গ, মাছি, পিঁপড়াকে আকর্ষণ করে। সাগরলতার গাঢ় সবুজ পাতা মাটিকে সূর্যের কিরণ থেকে এমনভাবে রক্ষা করে, যাতে সূর্যের তাপ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাষ্পীভূত করতে না পারে। এভাবেই মাটির নিচের স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াসহ প্রাণিকুলের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয় সাগরলতা। এ ছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের শরীর জেলিফিশের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে সাগরলতার পাতার রস ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে স্থানীয়ভাবে ক্ষত সারানোর জন্য।

তাই পরিবেশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাগরলতা ও বালিয়াড়ি না থাকলে বহু প্রাণী পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে। এই সাগরলতায় পাখিও বাসা বাঁধছে আর ডিম থেকে বাচ্চাও করছে। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে জনমানববিহীন ও কোলাহলমুক্ত সৈকতের পরিবেশে সাগরলতার সমাহারে বাসা বেঁধেছে লার্ক বার্ড বা ভরত পাখি আর এভাবেই প্রকৃতি ফিরে পাচ্ছে তার প্রাণচাঞ্চল্য ও হারানো বৈচিত্র্য।

তিনি বলেন, ‘আমি উত্তর সোনার পাড়ায় গিয়ে দেখি সাগরলতার মধ্যে পাখি বাসা বেঁধেছে আর ডিমও পেড়েছে। ওদের পর্যবেক্ষণের পর একদিন দেখি পাখির দুটি ছানা।’ পাখিবিশেষজ্ঞ শরিফ খান বললেন, ‘এই ভরত পাখি একটু উঁচু স্থানে ঘাসে বাসা করে। সাগরলতার নির্জন স্থানে এরা বাসা বাঁধতে পারে। এটি আমাদের জন্য সুখবর। পাখিদের বিরক্ত না করলে আরো অনেক পাখি এখানে বাসা বেঁধে বংশ বিস্তার করবে।

বেড়েছে লাল কাঁকড়া : কক্সবাজারের সৈকতের বিভিন্ন স্থানে লাল কাঁকড়ার আনাগোনাও বেড়েছে। সৈকতের কাছে ছোট ছোট গর্ত থেকে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়। এখানে- সেখানে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের আসার শব্দ পেলেই গর্তে ঢুকে যায়। তবে এখন সৈকতে মানুষ না থাকায় এরা স্বাচ্ছন্দ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে জানালেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা ফজলুল হক। তিনি বললেন, সৈকতের বিভিন্ন স্থানে এখন লাল কাঁকড়া দেখা যাচ্ছে। তিনি জানালেন, মানুষের হাঁটাচলা নেই, তাই লাল কাঁকড়া ইচ্ছেমতো সৈকতে বেড়াচ্ছে। বাসা বাঁধছে সৈকতের পাশে। আগের বছরগুলোতে এত লাল কাঁকড়া একসঙ্গে দেখা যায়নি। এরা এখন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ মত : কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য ধরে রাখতে হলে মানুষের অত্যাচার কমিয়ে ফেলতে হবে বলে মত দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান। তিনি বলেন, মানুষের অত্যাচারে যেন ডলফিন, কাছিম, কাঁকড়া বিরক্ত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখন পর্যটকের অত্যাচার নেই বলে এদের বিচরণ বেড়েছে। লকডাউনের পর এসব এলাকায় পর্যটক নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাতে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আর আইনের মাধ্যমে এদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এদের বংশবিস্তার আরো ভালো হবে।

প্রকৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ : পর্যটক নেই এই সময়, তাতে প্রকৃতি বিরক্ত হচ্ছে না। আর এই সময়ে প্রকৃতি মেলে ধরেছে নিজেকে। এটি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। জানতে চাইলে, জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘করোনার সময় কক্সবাজার যেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে বসেছে। আর তাই আমরা এটি ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছি। যেসব জায়গাতে ডলফিন, কাছিম, লাল কাঁকড়া বিচরণ করে সেখানে যাতে পর্যটকের আনাগোনা না হয় সে জন্য আমরা সেসব এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করব। লকডাউনের পর আমরা নির্ধারণ করে দেব কোথায় পর্যটক যেতে পারবে, আর কোথায় যেতে পারবে না। সাগরলতা যাতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্য আমরা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করব।

বিজনেস বাংলাদেশ/এসএম

জনপ্রিয়

একজন ব্যবসায়ী বান্ধব নেতা ওয়াহিদুল হাসান দিপু

প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে আপন ঠিকানা

প্রকাশিত : ০৮:১৫:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ জুলাই ২০২০

করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যটকশূন্য থাকায় কমেছে বর্জ্য। প্রাণ ফিরেছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যে। পর্যটননির্ভর এ নগরীর নাগরিক জীবনে কোভিড ১৯ মারাত্মক প্রভাব ফেললেও প্রকৃতির এ ভিন্ন সাজ নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ জাগিয়েছে অনেককেই। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, এবার মানুষের আনাগোনা কম ও সামুদ্রিক জাহাজ কম চলাচলের কারণে সামুদ্রিক কাছিমের বাচ্চা বেশি হয়েছে।

২০ জুন ১১ হাজার ৫৮২টি সামুদ্রিক কাছিমের বাচ্চা অবমুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে এবং পরিবেশ অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড কনসলিডেশন অব সিবিএ-ইসিএ প্রকল্প কর্তৃক কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্রসৈকত ইসিএ এবং সোনাদিয়া ইসিএ এলাকায় সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে পেঁচার দ্বীপ, উত্তর সোনারপাড়া, মাদারবনিয়া, সোনাদিয়া পূর্বপাড়া ও সোনাদিয়া পশ্চিমপাড়ায় সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ কেন্দ্র বা হ্যাচারি স্থাপন করা হয়। ওই হ্যাচারিগুলোতে জুন মাস পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৩৪০টি কাছিমের ডিম সংগ্রহ করা হয় এবং এ পর্যন্ত মোট ১১ হাজার ৫৬২টি সামুদ্রিক কাছিমের বাচ্চা সাগরে অবমুক্ত করা হয়।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘এবারে করোনাকালে মানুষের যাতায়াত কমেছে। মাছের চাহিদা কমে যাওয়ায় সামুদ্রিক যানের চলাচল কমেছে, তাতে সৈকতে কাছিমের আনাগোনা বেড়েছে। সৈকতে তারা ডিম পেড়েছেও আগের থেকে বেশি। সেই ডিম আমরা হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করেছি। কাছিম ডিম দিয়ে সমুদ্রে চলে যায়। সেগুলো আমাদের কর্মীরা সংগ্রহ করে। কৃত্রিম পরিবেশে তা রেখে বাচ্চা করা হয়। এবার এই পদ্ধতিতে প্রচুর বাচ্চা জন্মেছে, যা আগের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। গত বছর যেখানে সাত হাজারের মতো কাছিমের বাচ্চা পাওয়া গেছে, এবার তার দ্বিগুণ। এমন অবস্থা থাকলে আর এমন অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে কাছিমের সংখ্যা বাড়বে। তিনি আরো জানান, কাছিম সমুদ্রে বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো সমুদ্রের পরিবেশ ভালো আছে।

ডলফিনে আসছে সৈকতের কাছে : পর্যটকশূন্য কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের খুব কাছে দেখা গেছে বেশ কিছু ডলফিন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি ডলফিনের ছবিও ভিডিও দেখা গেছে। এর মধ্য কালো ডলফিনের পাশাপাশি দুর্লভ গোলাপি ডলফিনের দেখাও পেয়েছেন স্থানীয় লোকজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, তিনি ডলফিনের ভিডিওটি দেখেছেন। সেখানে যে গোলাপি ডলফিনটি দেখা গেছে, সেটি পূর্ণবয়স্ক। এরা সচরাচর উপকূলের কাছাকাছি থাকে। তবে সৈকতের এতটা কাছাকাছি তারা আসে না। এখন নিরিবিলি থাকায় হয়তো কাছে চলে এসেছিল। বাংলাদেশে যে কয়েক ধরনের ডলফিন আছে তার মধ্যে এটি অন্যগুলোর চেয়ে কম দেখা যায়।

ডলফিনের দেখা পাওয়ার খবরের পরপরই কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু মৃত ডলফিনের দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় সৈকতে। এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেন পরিবেশপ্রেমীরা। ডলফিন রক্ষার আদেশ আসে হাইকোর্ট থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘মৃত ডলফিন দেখেছি। এগুলো সৈকতের কাছাকাছি এসেছিল বলে মনে হচ্ছে। এরা অক্সিজেন বা শ্বাস নেয়ার জন্য পানির ওপর আসে। ধারণা করা হচ্ছে, মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে এরা শ্বাস নিতে না পেরে মারা গেছে। তবে এখন আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক আছি। ডলফিন যেন আর মারা না যায়, সে জন্য আমরা কাজ করছি ও নজরদারি বাড়িয়েছি।

নজর কাড়ছে সাগরলতা : কক্সবাজারে করোনার কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে পর্যটকদের থাকা নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। এতে সৈকতের পাড়ে বেড়ে উঠেছে সাগরলতা। সাগর পাড়ের সৌন্দর্য যেন বেড়ে গেছে এতে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলছিলেন, বলতে গেলে গত ১৮ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটকদের আসা-যাওয়া বন্ধ রয়েছে কক্সবাজারে। এ বিরল নির্জনতার সুযোগে সাগরপাড়ের পরিবেশের অন্যতম সদস্য সাগরলতা হয়েছে নবযৌবনা, মেলেছে গাঢ় সবুজ ডানা। এর ফুলগুলো বড় ও ফানেল আকৃতির, রং বেগুনি থেকে বেগুনি-গোলাপি। পাতাগুলো রসাল এবং বৃত্তাকার খাঁজকাটা টিপের মতো দেখতে। এই টিপ কিছুটা ‘ছাগলের পায়ের’ মতো দেখায় বলে ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছে ‘পেস ক্যাপ্রে।

জেলা প্রশাসক বললেন, ‘পড়ন্ত বিকেলে নির্জন সৈকতের দড়িয়ানগরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বালিয়াড়ির বুকে সৃজিত সবুজ কার্পেটের আদলে সাগরলতাগুলো। সাগরলতা স্থানীয়দের ভাষায় ডাউঙ্গালতা কিংবা গঙ্গালতা অথবা পিয়াজলতা। এটির অন্য সাধারণ নাম বিচ মর্নিং গ্লোরি। সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালুর পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির প্রধান কারিগর এই সাগরলতা। আর এ বালিয়াড়িই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ থেকে পরম মমতায় আগলে রাখে সমুদ্রসৈকত এবং সমুদ্রতীরের জনগোষ্ঠীকে।

সৈকতের বালুরাশির ওপর রেলপথের মতো বহমান লতার চারপাশে বিস্তৃত পুরু-ভারী সবুজ পাতা আর তার মাঝে বেগুনি কিংবা বেগুনি-গোলাপি ফুলের সমাহার দেখলেই জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শোভিত ফুল মৌমাছি, প্রজাপতি, পতঙ্গ, মাছি, পিঁপড়াকে আকর্ষণ করে। সাগরলতার গাঢ় সবুজ পাতা মাটিকে সূর্যের কিরণ থেকে এমনভাবে রক্ষা করে, যাতে সূর্যের তাপ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাষ্পীভূত করতে না পারে। এভাবেই মাটির নিচের স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াসহ প্রাণিকুলের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয় সাগরলতা। এ ছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের শরীর জেলিফিশের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে সাগরলতার পাতার রস ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে স্থানীয়ভাবে ক্ষত সারানোর জন্য।

তাই পরিবেশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাগরলতা ও বালিয়াড়ি না থাকলে বহু প্রাণী পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে। এই সাগরলতায় পাখিও বাসা বাঁধছে আর ডিম থেকে বাচ্চাও করছে। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে জনমানববিহীন ও কোলাহলমুক্ত সৈকতের পরিবেশে সাগরলতার সমাহারে বাসা বেঁধেছে লার্ক বার্ড বা ভরত পাখি আর এভাবেই প্রকৃতি ফিরে পাচ্ছে তার প্রাণচাঞ্চল্য ও হারানো বৈচিত্র্য।

তিনি বলেন, ‘আমি উত্তর সোনার পাড়ায় গিয়ে দেখি সাগরলতার মধ্যে পাখি বাসা বেঁধেছে আর ডিমও পেড়েছে। ওদের পর্যবেক্ষণের পর একদিন দেখি পাখির দুটি ছানা।’ পাখিবিশেষজ্ঞ শরিফ খান বললেন, ‘এই ভরত পাখি একটু উঁচু স্থানে ঘাসে বাসা করে। সাগরলতার নির্জন স্থানে এরা বাসা বাঁধতে পারে। এটি আমাদের জন্য সুখবর। পাখিদের বিরক্ত না করলে আরো অনেক পাখি এখানে বাসা বেঁধে বংশ বিস্তার করবে।

বেড়েছে লাল কাঁকড়া : কক্সবাজারের সৈকতের বিভিন্ন স্থানে লাল কাঁকড়ার আনাগোনাও বেড়েছে। সৈকতের কাছে ছোট ছোট গর্ত থেকে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়। এখানে- সেখানে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের আসার শব্দ পেলেই গর্তে ঢুকে যায়। তবে এখন সৈকতে মানুষ না থাকায় এরা স্বাচ্ছন্দ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে জানালেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা ফজলুল হক। তিনি বললেন, সৈকতের বিভিন্ন স্থানে এখন লাল কাঁকড়া দেখা যাচ্ছে। তিনি জানালেন, মানুষের হাঁটাচলা নেই, তাই লাল কাঁকড়া ইচ্ছেমতো সৈকতে বেড়াচ্ছে। বাসা বাঁধছে সৈকতের পাশে। আগের বছরগুলোতে এত লাল কাঁকড়া একসঙ্গে দেখা যায়নি। এরা এখন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ মত : কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য ধরে রাখতে হলে মানুষের অত্যাচার কমিয়ে ফেলতে হবে বলে মত দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান। তিনি বলেন, মানুষের অত্যাচারে যেন ডলফিন, কাছিম, কাঁকড়া বিরক্ত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখন পর্যটকের অত্যাচার নেই বলে এদের বিচরণ বেড়েছে। লকডাউনের পর এসব এলাকায় পর্যটক নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাতে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আর আইনের মাধ্যমে এদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এদের বংশবিস্তার আরো ভালো হবে।

প্রকৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ : পর্যটক নেই এই সময়, তাতে প্রকৃতি বিরক্ত হচ্ছে না। আর এই সময়ে প্রকৃতি মেলে ধরেছে নিজেকে। এটি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। জানতে চাইলে, জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘করোনার সময় কক্সবাজার যেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে বসেছে। আর তাই আমরা এটি ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছি। যেসব জায়গাতে ডলফিন, কাছিম, লাল কাঁকড়া বিচরণ করে সেখানে যাতে পর্যটকের আনাগোনা না হয় সে জন্য আমরা সেসব এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করব। লকডাউনের পর আমরা নির্ধারণ করে দেব কোথায় পর্যটক যেতে পারবে, আর কোথায় যেতে পারবে না। সাগরলতা যাতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্য আমরা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করব।

বিজনেস বাংলাদেশ/এসএম