০২:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪

তিস্তার তীব্র ভাঙনে দিশাহারা তিস্তা পাড়ের বানভাসি মানুষ

তিস্তার তীব্র ভাঙনে দিশেহারা লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কাঁদছে তিস্তার বামতীরের মানুষ। জানা গেছে, তিস্তা আর ধরলা নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটে জুন থেকে থেমে থেমে বন্যা চলমান রয়েছে। টানা ৪/৫ দিন পানিবন্দি থেকে মুক্তি মিলতে না মিলতে আবারো পানিবন্দি হচ্ছে মানুষ। গত সপ্তাহে টানা ৫দিন ডুবে থেকে মুক্তিলে মিলে জেলার প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের। জন্ম থেকে খনন না করায় তিস্তা ও ধরলা নদীর তলদেশ পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে পড়েছে। ফলে উজানের পাহাড়ি ঢল ও সামান্য বৃষ্টিতে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে নদীর দুকুল উফছে বন্যায় প্লাবিত হয় লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা। প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারনে জেলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে এই দুই নদী। বন্যার পানি নেমে গেলে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে নদী গিলে খাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি ও স্থাপনা। ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতি বছর নিঃস্ব হচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ। ফলে ফসলহানীসহ দিন দিন চরম অর্থ কষ্টে পড়ছে এসব ছিন্নমুল মানুষ। একবার দুইবার নয়, জীবনে ২০/২৫ বার বসতভিটা সড়াতে হয়েছে নদীর কড়াল গ্রাস থেকে। সারা বছরের উপার্জনের সঞ্চিত অর্থে নতুন করেন বসতভিটা তৈরী করলেও তা এক বছরের মাথায় আবারো নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে। প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কেউ কেউ জমি ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে কোন রকম বসবাস করছেন। অনেকেই রাস্তার পাশে বা বাঁধের ধারে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যা এক বা দুই বছরের মাথায় আবারো নদীর কড়াল গ্রাসের মুখে পড়ছেন।
ভাঙন কবলিতদের পুনবাসনের জন্য সরকারী ভাবে ৭ হাজার টাকা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্থদের। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারী উপজেলার বাহাদুরপাড়া, চন্ডিমারী, কুটিরপাড়, কালীগঞ্জের আমিনগঞ্জ, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ি, সির্ন্দুনা ও সানিয়াজানে তিস্তা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারন করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ সকল বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ। মারাত্বক ঝুঁকিতে পড়েছে আদিতমারীর কুটিরপাড়া ও বাহাদুরপাড়া গ্রামের বালুর বাঁধ। আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় গ্রামে এক রাতেই তিস্তায় বিলিন হয়েছে ৭টি বসতভিটা। গ্রামবাসী রাতেই ঘরবাড়ি সড়িয়ে পাশে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। জায়গার অভাবে তারা ঘর উঠাতে পারছেন না। পাশের বাড়ির উঠানে পলিথিনের নিচে বসবাস করছেন তাদের একজন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, গ্রামবাসীর হাতে পায়ে ধরে ঘর দুইটা সড়িয়ে রাস্তায় রেখেছি। স্বামী মরণব্যাধী ক্যান্সারে শয্যাশায়ী। ভাড়া জমিতে করা বসতভিটাও তিস্তার পেটে। এখন বাড়ি করার কোন জায়গা নেই। ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাই?? ভাই।
একই গ্রামের অজিয়ার রহমান(৮৫) ভেঙে যাওয়া বসতভিটার পাশে বসে কাঁদছেন। তার কান্নায় বাতাস ভাড়ি হলেও তিস্তার হিংস্র স্রোত যেন শুনতেই পাচ্ছে না। প্রায় শতবর্ষি এ বৃদ্ধার কান্না পৌছে না দেশের নীতিনির্ধারনীর কাছে। তিনি বলেন, জীবনে সব কামাই(আয়) তিস্তার পেটে।২২/২৩ বার বাড়ি ভাঙ্গতে হয়েছে। তেরান (ত্রান) চাই না, নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ চাই। যেন ডেডা(ঝুপরী ঘর) পাতি থাকবার পাই। পুত্তিবছর(প্রতিবছর) সরকার বস্তা ফেলায় আর ভাসি যায়। তেরান দেয়। এগুলা না করে নদী খনন করে বাঁধ দেয়া হউক। তাইলে হামরা আবাদ সুবাদ করি খাবার পামো বাহে। নইলে মরা ছাড়া কোন উপায় নাই। ভাঙনের মুখে পড়া গ্রামটির বাসিন্দা হবিবুর রহমান, আসাদুল বলেন, কুটিরপাড় বালুর বাঁধ থেকে চন্ডিমারী স্প্যার বাঁধ পর্যন্ত এলাকার কিছু অংশে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। বাকী অংশ টুকুতেও জরুরী ভাবে জিও ব্যাগ ফেলা দরকার। নয়তো পুরো কুটিরপাড় গ্রাম ও বালুর বাঁধটি যেকোন সময় তিস্তায় বিলিন হবে। তিস্তা নদী খনন করে দুই তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মানে নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘ দিনের একটি দাবি। লালমনিরহাট ২ আসনের সংসদ সদস্য সমাজ কল্যানমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নির্বাচনের সময় তিস্তার স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে দীর্ঘ দিনের সেই দাবি পুরনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ।
জেলা ত্রাণ ও পুনবাস কার্যালয় জানিয়েছে জেলায় ২৩৬ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। যাদের প্রত্যেক পরিবারকে পুনবাসনের জন্য ৭ হাজার করে টাকা দেয়া হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের দাবি তিস্তা আর ধরলার ভাঙনের শিকার হয়েছে এক হাজারেরও বেশি পরিবার।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, ভাঙনের ঝুঁকিপুর্ন এলাকায় জিও ব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর প্রত্যেককে ৭ হাজার টাকা ও ২০ কেজি চাল দেয়া হচ্ছে। তবে তিস্তা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মানের একটি প্রকল্প দেয়া আছে।

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ

ট্যাগ :

তিস্তার তীব্র ভাঙনে দিশাহারা তিস্তা পাড়ের বানভাসি মানুষ

প্রকাশিত : ০১:৫৯:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই ২০২০

তিস্তার তীব্র ভাঙনে দিশেহারা লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কাঁদছে তিস্তার বামতীরের মানুষ। জানা গেছে, তিস্তা আর ধরলা নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটে জুন থেকে থেমে থেমে বন্যা চলমান রয়েছে। টানা ৪/৫ দিন পানিবন্দি থেকে মুক্তি মিলতে না মিলতে আবারো পানিবন্দি হচ্ছে মানুষ। গত সপ্তাহে টানা ৫দিন ডুবে থেকে মুক্তিলে মিলে জেলার প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের। জন্ম থেকে খনন না করায় তিস্তা ও ধরলা নদীর তলদেশ পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে পড়েছে। ফলে উজানের পাহাড়ি ঢল ও সামান্য বৃষ্টিতে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে নদীর দুকুল উফছে বন্যায় প্লাবিত হয় লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা। প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারনে জেলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে এই দুই নদী। বন্যার পানি নেমে গেলে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে নদী গিলে খাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি ও স্থাপনা। ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতি বছর নিঃস্ব হচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ। ফলে ফসলহানীসহ দিন দিন চরম অর্থ কষ্টে পড়ছে এসব ছিন্নমুল মানুষ। একবার দুইবার নয়, জীবনে ২০/২৫ বার বসতভিটা সড়াতে হয়েছে নদীর কড়াল গ্রাস থেকে। সারা বছরের উপার্জনের সঞ্চিত অর্থে নতুন করেন বসতভিটা তৈরী করলেও তা এক বছরের মাথায় আবারো নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে। প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কেউ কেউ জমি ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে কোন রকম বসবাস করছেন। অনেকেই রাস্তার পাশে বা বাঁধের ধারে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যা এক বা দুই বছরের মাথায় আবারো নদীর কড়াল গ্রাসের মুখে পড়ছেন।
ভাঙন কবলিতদের পুনবাসনের জন্য সরকারী ভাবে ৭ হাজার টাকা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্থদের। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারী উপজেলার বাহাদুরপাড়া, চন্ডিমারী, কুটিরপাড়, কালীগঞ্জের আমিনগঞ্জ, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ি, সির্ন্দুনা ও সানিয়াজানে তিস্তা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারন করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ সকল বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ। মারাত্বক ঝুঁকিতে পড়েছে আদিতমারীর কুটিরপাড়া ও বাহাদুরপাড়া গ্রামের বালুর বাঁধ। আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় গ্রামে এক রাতেই তিস্তায় বিলিন হয়েছে ৭টি বসতভিটা। গ্রামবাসী রাতেই ঘরবাড়ি সড়িয়ে পাশে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। জায়গার অভাবে তারা ঘর উঠাতে পারছেন না। পাশের বাড়ির উঠানে পলিথিনের নিচে বসবাস করছেন তাদের একজন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, গ্রামবাসীর হাতে পায়ে ধরে ঘর দুইটা সড়িয়ে রাস্তায় রেখেছি। স্বামী মরণব্যাধী ক্যান্সারে শয্যাশায়ী। ভাড়া জমিতে করা বসতভিটাও তিস্তার পেটে। এখন বাড়ি করার কোন জায়গা নেই। ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাই?? ভাই।
একই গ্রামের অজিয়ার রহমান(৮৫) ভেঙে যাওয়া বসতভিটার পাশে বসে কাঁদছেন। তার কান্নায় বাতাস ভাড়ি হলেও তিস্তার হিংস্র স্রোত যেন শুনতেই পাচ্ছে না। প্রায় শতবর্ষি এ বৃদ্ধার কান্না পৌছে না দেশের নীতিনির্ধারনীর কাছে। তিনি বলেন, জীবনে সব কামাই(আয়) তিস্তার পেটে।২২/২৩ বার বাড়ি ভাঙ্গতে হয়েছে। তেরান (ত্রান) চাই না, নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ চাই। যেন ডেডা(ঝুপরী ঘর) পাতি থাকবার পাই। পুত্তিবছর(প্রতিবছর) সরকার বস্তা ফেলায় আর ভাসি যায়। তেরান দেয়। এগুলা না করে নদী খনন করে বাঁধ দেয়া হউক। তাইলে হামরা আবাদ সুবাদ করি খাবার পামো বাহে। নইলে মরা ছাড়া কোন উপায় নাই। ভাঙনের মুখে পড়া গ্রামটির বাসিন্দা হবিবুর রহমান, আসাদুল বলেন, কুটিরপাড় বালুর বাঁধ থেকে চন্ডিমারী স্প্যার বাঁধ পর্যন্ত এলাকার কিছু অংশে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। বাকী অংশ টুকুতেও জরুরী ভাবে জিও ব্যাগ ফেলা দরকার। নয়তো পুরো কুটিরপাড় গ্রাম ও বালুর বাঁধটি যেকোন সময় তিস্তায় বিলিন হবে। তিস্তা নদী খনন করে দুই তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মানে নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘ দিনের একটি দাবি। লালমনিরহাট ২ আসনের সংসদ সদস্য সমাজ কল্যানমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নির্বাচনের সময় তিস্তার স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে দীর্ঘ দিনের সেই দাবি পুরনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ।
জেলা ত্রাণ ও পুনবাস কার্যালয় জানিয়েছে জেলায় ২৩৬ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। যাদের প্রত্যেক পরিবারকে পুনবাসনের জন্য ৭ হাজার করে টাকা দেয়া হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের দাবি তিস্তা আর ধরলার ভাঙনের শিকার হয়েছে এক হাজারেরও বেশি পরিবার।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, ভাঙনের ঝুঁকিপুর্ন এলাকায় জিও ব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর প্রত্যেককে ৭ হাজার টাকা ও ২০ কেজি চাল দেয়া হচ্ছে। তবে তিস্তা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মানের একটি প্রকল্প দেয়া আছে।

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ