০২:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

তাড়াশে বোরো মৌসুমে কাঁচতে তৈরীতে ব্যস্ত কামার শিল্পীরা

মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব আর সারা বছর মন্দা ভাব গেলেও বছরের দু’টো সময় যেন চোখের ঘুম কেড়ে নেয় কামার পাড়ার কামার শিল্পীদের। টুং টাং শব্দ তখন যেন নিত্য শোনা যায়। কোরবানির ঈদ আর মৌসুমী ধান কাটার সময় আসলেই টুং-টাং শব্দে মুখরিত থাকে কামার পাড়া। সে সময়ে পরিবারের সবাই যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি তৈরীর কাজে। বছরের বেশীর ভাগ সময় তেমন কাজ না থাকায় তাদের অলস সময় টাকা হয়। ফলে ওই সময় পরিবার নিয়ে কষ্টে কাটে তাদের দিন। তারপরও যেন কোরবানির ঈদ আর ধান কাটার মৌসুমে বাড়তি আয় হবে সে আশায় বুক বেঁধে থাকে তারা।
চলনবিল জুড়ে এখন শুধুই ধান আর ধান। ইতি মধ্যে দু’ একটা জমিতে ধান কাটা শুরু হলেও পুরোপুরি কাটা শুরু হতে আর হয়তো এক সপ্তাহ লাগবে। তারপরই পুরোদমে শুরু হবে বোরো ধান কাটা। আর ওই ধান কাটার এক মাত্র হাতিয়ার হলো কাঁচতে।
শস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার কামার শিল্পীরা চলতি মৌসুমে বোরো ধান কাটাকে সামনে রেখে কাঁচতে তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। কামার শিল্পীরা দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম করে নানা ধরণের কাঁচতে তৈরী করছেন। কাঁচতে তৈরীর ফাঁকে ফাঁকে অন্যান যন্ত্রপাতিও তৈরী করছে তারা। সারা বছর তেমনটা কাজ না থাকায় এই সময় কাটে তাদের ব্যস্ততার মধ্যে। এ সময় বাড়তি শ্রমের মাধ্যমে বাড়তি আয় করে সারা বছরের ঘাটতি কিছুটা হলেও মেটানোর চেষ্টা করে তারা।
তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের কুমাল্লু গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে যেতেই কানে ভেঁসে আসল টুং টাং শব্দ। যেয়েই চোখে পরলো কামার শিল্পীদের কর্মকান্ড ও কর্ম ব্যস্ততা। তারা লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে হাতুরি দ্বারা পিটিয়ে তৈরী করছে কাঁচতে। ঘাম ঝড়ে ভিজে গেছে পড়নের কাপড়। জিরানোর সময় যেন নেই। উপজেলার রানীর হাট বাজার, বারুহাস বাজার,নওগাঁ হাট, গুড়পিপুঁল, দেশীগ্রাম ও চার মাথা ভোগলমান বাজারে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। কামারদের তৈরী যন্ত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে কাঁচতে, দা, বটি, ছুঁড়ি, চাপাতি, কোদাল, কুড়ালসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও কথা হয় ওই গ্রামের আহম্মেদ আলীর ছেলে সাইদুল ইসলামের সাথে। তিনি পেশায় একজন কামার শিল্পী। বিগত বিশ বছর ধরে কামারের কাজ করছে। তার বাবাও এই পেশায় ছিলেন। বলা যায় বাবার পেশাকে ধরে রাখতে তিনি এই ব্যবসা ধরে রেখেছেন। পরিবারের পাঁচটি মুখে দু’বেলা আহার জোটে এ ব্যবসার রোজগার থেকে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, এখন এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধান কাটার একমাত্র হাতিয়ার এই কাঁচতে। দুই- এক জায়গায় ধান কাটার (হার বেষ্ট) মেশিন দ্বারা ধান কাটলেও অধিকাংশ ধান কাটা হয় কাঁচতে দ্বারা। তাই শ্রমিকদের কাছে কাঁচতের চাহিদা বেশী। তিনি আরো বলেন, একটা কাঁচতে ১’শ ২০ টাকা থেকে ১’শ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। তাছাড়া লোহার উপর ভিত্তি করেও দাম কম-বেশী হয়। একটি পুরাতন কাঁচতে ধাঁর কাটাতে ৭০- ৮০ টাকা নেয়া হয়। ধান কাটার মৌসুমে মোটা-মুটি ভালই কামাই হয়ে থাকে।
উপজেলার বিনসাড়া গ্রামের আব্দুল গফুর বলেন, বছরের বেশির ভাগ সময়ই আমাদের কাজ না থাকায় অলস সময় কাটাতে হয়। কিন্তু ধান কাটা শুরু হলে কাঁচতের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাই এ সময় কাঁচতের দামও বেশী। তিনি আরো বলেন, লোহার দাম বৃদ্ধি, শ্রমের তুলনায় মজুরী কম হওয়ায় সঙ্গত কারনেই বছরের বেশীর ভাগ সময়ই কামার শিল্পীদের কর্মহীন জীবন চালাতে হয়। এ অবস্থায় অনেকেই এই পৈতিক ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। তারপরও বোরো মৌসুমে ও কোরবানির ঈদে গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা কিছুটা হলেও বেড়ে যায়।
আধুনিক প্রযুক্তি দাপটে কামার শিল্পী এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। তাই সরকারী-বেসরকারী ভাবে সাহায্য সহযোগীতার মাধ্যমে কামার শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।

ট্যাগ :

বরিশালে পেশাদার সাংবাদিকদের ৩৫ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে জেলা প্রশাসকের মতবিনিময়

তাড়াশে বোরো মৌসুমে কাঁচতে তৈরীতে ব্যস্ত কামার শিল্পীরা

প্রকাশিত : ১২:০১:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১

মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব আর সারা বছর মন্দা ভাব গেলেও বছরের দু’টো সময় যেন চোখের ঘুম কেড়ে নেয় কামার পাড়ার কামার শিল্পীদের। টুং টাং শব্দ তখন যেন নিত্য শোনা যায়। কোরবানির ঈদ আর মৌসুমী ধান কাটার সময় আসলেই টুং-টাং শব্দে মুখরিত থাকে কামার পাড়া। সে সময়ে পরিবারের সবাই যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি তৈরীর কাজে। বছরের বেশীর ভাগ সময় তেমন কাজ না থাকায় তাদের অলস সময় টাকা হয়। ফলে ওই সময় পরিবার নিয়ে কষ্টে কাটে তাদের দিন। তারপরও যেন কোরবানির ঈদ আর ধান কাটার মৌসুমে বাড়তি আয় হবে সে আশায় বুক বেঁধে থাকে তারা।
চলনবিল জুড়ে এখন শুধুই ধান আর ধান। ইতি মধ্যে দু’ একটা জমিতে ধান কাটা শুরু হলেও পুরোপুরি কাটা শুরু হতে আর হয়তো এক সপ্তাহ লাগবে। তারপরই পুরোদমে শুরু হবে বোরো ধান কাটা। আর ওই ধান কাটার এক মাত্র হাতিয়ার হলো কাঁচতে।
শস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার কামার শিল্পীরা চলতি মৌসুমে বোরো ধান কাটাকে সামনে রেখে কাঁচতে তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। কামার শিল্পীরা দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম করে নানা ধরণের কাঁচতে তৈরী করছেন। কাঁচতে তৈরীর ফাঁকে ফাঁকে অন্যান যন্ত্রপাতিও তৈরী করছে তারা। সারা বছর তেমনটা কাজ না থাকায় এই সময় কাটে তাদের ব্যস্ততার মধ্যে। এ সময় বাড়তি শ্রমের মাধ্যমে বাড়তি আয় করে সারা বছরের ঘাটতি কিছুটা হলেও মেটানোর চেষ্টা করে তারা।
তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের কুমাল্লু গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে যেতেই কানে ভেঁসে আসল টুং টাং শব্দ। যেয়েই চোখে পরলো কামার শিল্পীদের কর্মকান্ড ও কর্ম ব্যস্ততা। তারা লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে হাতুরি দ্বারা পিটিয়ে তৈরী করছে কাঁচতে। ঘাম ঝড়ে ভিজে গেছে পড়নের কাপড়। জিরানোর সময় যেন নেই। উপজেলার রানীর হাট বাজার, বারুহাস বাজার,নওগাঁ হাট, গুড়পিপুঁল, দেশীগ্রাম ও চার মাথা ভোগলমান বাজারে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। কামারদের তৈরী যন্ত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে কাঁচতে, দা, বটি, ছুঁড়ি, চাপাতি, কোদাল, কুড়ালসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও কথা হয় ওই গ্রামের আহম্মেদ আলীর ছেলে সাইদুল ইসলামের সাথে। তিনি পেশায় একজন কামার শিল্পী। বিগত বিশ বছর ধরে কামারের কাজ করছে। তার বাবাও এই পেশায় ছিলেন। বলা যায় বাবার পেশাকে ধরে রাখতে তিনি এই ব্যবসা ধরে রেখেছেন। পরিবারের পাঁচটি মুখে দু’বেলা আহার জোটে এ ব্যবসার রোজগার থেকে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, এখন এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধান কাটার একমাত্র হাতিয়ার এই কাঁচতে। দুই- এক জায়গায় ধান কাটার (হার বেষ্ট) মেশিন দ্বারা ধান কাটলেও অধিকাংশ ধান কাটা হয় কাঁচতে দ্বারা। তাই শ্রমিকদের কাছে কাঁচতের চাহিদা বেশী। তিনি আরো বলেন, একটা কাঁচতে ১’শ ২০ টাকা থেকে ১’শ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। তাছাড়া লোহার উপর ভিত্তি করেও দাম কম-বেশী হয়। একটি পুরাতন কাঁচতে ধাঁর কাটাতে ৭০- ৮০ টাকা নেয়া হয়। ধান কাটার মৌসুমে মোটা-মুটি ভালই কামাই হয়ে থাকে।
উপজেলার বিনসাড়া গ্রামের আব্দুল গফুর বলেন, বছরের বেশির ভাগ সময়ই আমাদের কাজ না থাকায় অলস সময় কাটাতে হয়। কিন্তু ধান কাটা শুরু হলে কাঁচতের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাই এ সময় কাঁচতের দামও বেশী। তিনি আরো বলেন, লোহার দাম বৃদ্ধি, শ্রমের তুলনায় মজুরী কম হওয়ায় সঙ্গত কারনেই বছরের বেশীর ভাগ সময়ই কামার শিল্পীদের কর্মহীন জীবন চালাতে হয়। এ অবস্থায় অনেকেই এই পৈতিক ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। তারপরও বোরো মৌসুমে ও কোরবানির ঈদে গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা কিছুটা হলেও বেড়ে যায়।
আধুনিক প্রযুক্তি দাপটে কামার শিল্পী এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। তাই সরকারী-বেসরকারী ভাবে সাহায্য সহযোগীতার মাধ্যমে কামার শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।