বাংলার ‘জোয়ান অব আর্ক’ শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন আজ। পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই হয়ত এবারও তার জন্মদিনটি নীরবে-নিভৃতে পার হয়ে যাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার আগের জীবনটা কাটিয়েছেন হয় কারাগারে নয়ত রাজপথে জনতার মাঝে। কোনদিন জন্মদিন উদযাপন করেননি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ যখন সে সুযোগটি এলো তখনও তিনি উদযাপন করলেন না। বললেন, যতদিন বাংলায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য থাকবে ততদিন কিসের জন্মদিন? আমার জন্মদিনে কোন উৎসব হবে না।
পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলেছেন শেখ হাসিনা। তিনিও কোন উৎসব আনন্দ করতে দিচ্ছেন না। তারপরও তার সুস্বাস্থ্য দীর্ঘ জীবন কামনা করে মিলাদ হবে, প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হবে। শেখ হাসিনার জন্ম টুঙ্গিপাড়ার বনেদি শেখ বাড়িতে। দক্ষিণ বাংলার এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। একদিকে মধুমতি আরেক দিকে বাইগার নদীর সংযোগ খালপাড়ে শেখ বাড়ি। বর্ষায় সারা এলাকা পানিতে ডুবে থাকে। এখানেই শৈশব কেটেছে শেখ হাসিনার। রাস্তাঘাট ছিল না বললেই চলে।
তখন বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল যেতে হতো ক্ষেতের আল দিয়ে। তারপর একদিন ঢাকায় চলে এলেন। এখানে এসেও আজ এ বাড়ি তো কাল ও বাড়ি। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেন এবং বেশির ভাগ সময়ই কারাগার এই তার আবাসস্থল। এসব কারণেই অনেকেই বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। তারপর ১৯৬১ সালে ধানমন্ডিতে (৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন) এসে স্থায়ী হন। আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল, ইডেন গার্লস কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি।
এখানে শেষবর্ষ অনার্সে অধ্যয়নকালে তার বিয়ে হয় পিএইচডি ডিগ্রীধারী এক মেধাবী তরুণ অণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়ার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এই ঘোষণার একমাত্র সাংবিধানিক এবং নৈতিক ও আইনি অধিকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই ছিল, আর কারও নয়। স্বাধীনতার ঘোষণার পরই পাকিস্তান সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটক রাখে। আর বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়াসহ পরিবারের সকলকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডি ১৮ নং সড়কের এক বাড়িতে সাব-জেলে আটক করে রাখে।
এই অন্ধকার স্থানে শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। এই সঙ্কটাপন্ন জীবন টানতে টানতে তার স্বাভাবিক লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। তারপরও বিজয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেন এবং এমএতে ভর্তি হন। কিন্তু ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির কারণে আর এমএ ফাইনাল পরীক্ষাটা দেয়ার সুযোগ হয়নি। এই আক্ষেপ তার রয়ে গেছে আজও। ঝুঁকিপূর্ণ জীবন এবং এরপরে দীর্ঘ ৬ বছর তাকে স্বামী-সন্তান ও ছোট বোন শেখ রেহানাসহ বিদেশের মাটিতে কাটাতে হয়েছে।
মাস্টার্স ডিগ্রী তার জন্য ছিল অসম্ভব ব্যাপার কেবল রাজনৈতিক কারণে, কারাভোগের কারণে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং জেদী সাহসী ছিলেন বলেই সঙ্কটের মধ্যেও গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন সম্ভব হয়েছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্কটের মধ্যে, ঝুঁকির মধ্যে থেকেও তিনি লক্ষচ্যুত হননি এতটুকু। এই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরো ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সংগঠনের অনেক বড় পদে যেতে পারতেন; কিন্তু তিনি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলে তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছেন।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চলছে, বিশেষ করে ১৯৬২ সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন চলছে। বটতলায় ছাত্র সমাবেশ ডাকা হয়েছে। তিনি তার আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলের একদল ছাত্রীকে অরগানাইজ করে মিছিল নিয়ে বটতলায় আসছিলেন। কাছাকাছি এসে দেখলেন পুলিশ সভাস্থলে আক্রমণ করেছে, লাঠিপেটা করছে। তিনি তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে রোকেয়া হলের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে হলের ভেতরে ঢুকে পড়লেন। এভাবে তার ছাত্রজীবন এগিয়ে চলছিল।
ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালে ইডেন ছাত্রী সংসদের নির্বাচন। ছাত্রলীগ থেকে তাকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুরোধ জানানো হলো। তখন বঙ্গবন্ধু কারাগারে, বেগম মুজিব তাকে ডিসকারেজ করলেন না, বরং উৎসাহ দিলেন। নির্বাচন হলো। তিনি বিপুল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে ভিপি নির্বাচিত হলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আইয়ুবের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে আটক। ক্যাম্পাস উত্তপ্ত। সকাল-দুপুর-বিকেল মিছিলে মিছিলে মুখরিত ক্যাম্পাস। স্লোগান উঠছে পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা, পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা ঢাকা, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব। এক পর্যায়ে স্লোগান উঠল জয় বাংলা বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি। শেখ হাসিনা মিছিলের অগ্রভাগে থাকতেন।
যারা বলেন রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে এসেছেন তারা ভুলে যান বাংলাদেশের এক নম্বর রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম অর্থাৎ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রেষ্ঠ সন্তান, যার ধমনীতে বইছে বঙ্গবন্ধুর রক্ত, তিনি জনগণের আন্দোলনের থাকবেন না এ কি হয়? তিনি ছিলেন এবং সংক্রিয়ভাবে ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৫ আগস্টের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে ভারতে অবস্থান করেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এর মধ্যেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য লন্ডনে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। অনেকেই সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হতাশ হননি। অবশেষে ক্ষমতায় গিয়ে সফল হলেন। ১৯৮১ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করলে তিনি ওই সালেই ১৭ মে সকল বাধা অতিক্রম করে দেশে ফিরেন।
তখনকার মিলিটারি শাসক জিয়া শেষ পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু ব্যর্থ হন। তারপর থেকে তার আরেক জীবন। ১৯৮১ থেকে ২০১৯ আটত্রিশ বছরের নেতৃত্ব। তার মধ্যে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি টানা তিনবার রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রনেতা। বাকি সময়টাও আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে বাঙালি জাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং গণআন্দোলনের মাধ্যমে মিলিটারি জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার পতন ঘটিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আজও ক্ষমতায় আছেন।
আর এই সময়ের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে আজকের চেহারা আরও দুই দশক আগেই জনগণ দেখতে পেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতীসহ বিশ্বের দুই ডজনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেছে। জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থা তাকে এসডিসি অগ্রগতি পুরস্কার, সেরেস পুরস্কার, সাউথ-সাউথ পুরস্কার, স্টার অব দ্য ইস্ট, মাদার অব হিউম্যানিটি, চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ এমনি ভূরি ভূরি এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে।
সৎ রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বিশ্বের তিনজনের মধ্যে দ্বিতীয় এবং সফল দক্ষ দূরদর্শী ব্যক্তির মধ্যে তৃতীয়। তাঁর নেতৃত্বে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আজ এক নম্বরে। এই বিশাল অর্জনের পথ মসৃণ ছিল না। ১৯ বার তার ওপর হামলা হয়েছে তাকে হত্যা করার জন্য। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা ছিল ভয়ঙ্কর। উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের (বর্তমানে যাবজ্জীবন কারাদন্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক) হাওয়া ভবন পরিচালিত এই গ্রেনেড হামলায় তিনি রক্ষা পেলেও এক কানের শ্রবণশক্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন অন দ্য স্পট এবং তিন শতাধিক আহত হন। তাছাড়া চট্টগ্রাম, ঢাকার জিরো পয়েন্ট, রাসেল স্কয়ার, তোপখানা রোড, বঙ্গবন্ধু ভবনে গুলি-বোমা হামলাও ছিল একেবারে তাকেই টার্গেট করে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি আজও বেঁচে আছেন এবং জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক


























