০২:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

দূষিত পানিতে মরছে মাছ, কমছে ফসল!

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বেলাই বিলকে বলা হয় জেলার দেশী মাছের ভান্ডার। শুষ্ক মৌসুমে এ বিলের পানি দিয়ে চাষাবাদ করেন জেলার ৪ উপজেলার কৃষক। তবে কল-কারখানার কেমিক্যালের বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে বিশাল ওই বিল। রংবেরংয়ের পানিতে দূষিত হয়ে গেছে বিলের পানি। এতে মাছের উৎপাদন কমেছে আশংকাজনকভাবে।

জানা গেছে, গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলাসহ জেলার ৪ উপজেলার লাগোয়া বেলাই বিলের অবস্থান। এক সময় এ বিলের পানি ছিল স্বচ্ছ টলটলে। প্রাকৃতিক ভাবেই পাওয়া যেত রুই-কাতল ছাড়াও কৈ, শিং, মাগুড়, পুঁটি, মিনি, টাকি, শোল, ট্যাংরা, গুলশা, গুতুম, বেলে, মলা, ছোট বাইমসহ হরেক রকম দেশি মাছ। ১০ বছর আগেও গাজীপুর জেলার মাছের চাহিদার ৫০ ভাগ খাল-বিল, নদী নালা থেকে আসত। তার মধ্যে ৩০ ভাগই পাওয়া যেত এই বেলাই বিল থেকে। এক সময় বিলের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো বেলাই বিল পাড়ের হাজারও জেলে। গাজীপুর জেলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী ও আশেপাশের জেলায় সরবরাহ করা হত বেলাই বিলের মাছ। দেশী মাছের জন্য বেলাই বিল ছিল জেলার ঐতিহ্য। কিন্তু কল-কারখানার শিল্প-বর্জ্যে ধ্বংস হতে চলেছে বেলাই বিল।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে চিলাই, পারুলী, তুরাগ ও বালু নদী এবং মোগরখাল, হায়দারাবাদ খাল, জয়রামবের খালসহ ১০-১২টি নদ-নদী ও খাল জেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেলাই বিলে গিয়ে মিশেছে। এসব নদী ও খাল দিয়ে ¯্রােতের মত কারখানার কেমিক্যাল বর্জ্য বেলাই বিলে গিয়ে পড়ছে। আর এতে দূষিত হচ্ছে বিলের পানি।

তিতারকূল এলাকায় বিলে খর জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন সুধন্য দাস। তিনি জানান, ৩-৪ বছর আগেও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এক ঘন্টায় যে মাছ পাওয়া যেত এখন সারাদিনেও তার অর্ধেক পাওয়া যায় না। কারখানার পানিতে বিষ আছে। ওই বিষ, বিল শেষ করে দিছে। বিষাক্ত পানিতে পোনা মাছ মরে যাওয়ায় মাছের বৃদ্ধি হচ্ছে না বলেও পানিতে ভাসতে থাকা মরা মাছ দেখিয়ে জানান সুধন্য দাস।

কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়িয়া গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়া বলেন, শুধু মাছ নয়, দূষিত পানির কারণে ধান উৎপাদনও কমে গেছে। আগে বিলের পানিতে গোসল, গৃহস্থালীসহ কৃষি জমিতে চাষাবাদ করা হত। এখন বিলের পানিতে নামা যায় না। পানি লাগলে শরীর চুলকায়, ঘা হয়। কৃষকের সর্বনাশ করছে কারখানার মালিকরা।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কল-কারখানার বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা কোন ভাবেই প্রাকৃতিক জলাধারকে ধ্বংস করে নয়। কারখানার বর্জ্যে গাজীপুর জেলার সকল নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় দূষিত হয়ে পড়ছে। একই ভাবে দূষিত হচ্ছে বেলাই বিল। কারখানাগুলো ইটিপি ব্যবহার না করার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নদীর মতই প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষা করতে না পারলে আমাদের প্রাকৃতিক দেশীয় মাছ এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত ঘটবে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসন এবং কল-কারখানা অধিদপ্তরকে আরো সচেষ্ট হতে হবে।

বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক মো. আনোয়ার সাদত বলেন, বেলাই বিল গাজীপুর জেলার গর্ব। দেশীয় মাছ, ধান এবং চাষাবাদে এ বিলের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। দূষণের কবলে পড়ে শুধু মাছের উৎপাদন কমেছে তা নয়। উৎপাদন কমেছে ধানেরও। তাই বিলের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য দূষণ বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

গাজীপুর জেলা মৎস কর্মকর্তা ড. কায়সার মুহাম্মদ মঈনুল হাসান জানান, গাজীপুর জেলায় দেশীয় মাছের সবচেয়ে বড় ভান্ডার বেলাই বিল। কয়েক বছর আগেও এ বিল থেকে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। দূষণের কারণে এবং ভরাট হয়ে যাওয়ায় আগের মত এখন আর মাছ পাওয়া যায়না। দূষণ বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিষয়টি অবহিত করেছেন বলেও তিনি জানান।

বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব

জনপ্রিয়

মুরাদনগরের সাবেক ৫বারের এমপি কায়কোবাদের অপেক্ষায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ

দূষিত পানিতে মরছে মাছ, কমছে ফসল!

প্রকাশিত : ১২:০২:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২২

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বেলাই বিলকে বলা হয় জেলার দেশী মাছের ভান্ডার। শুষ্ক মৌসুমে এ বিলের পানি দিয়ে চাষাবাদ করেন জেলার ৪ উপজেলার কৃষক। তবে কল-কারখানার কেমিক্যালের বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে বিশাল ওই বিল। রংবেরংয়ের পানিতে দূষিত হয়ে গেছে বিলের পানি। এতে মাছের উৎপাদন কমেছে আশংকাজনকভাবে।

জানা গেছে, গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলাসহ জেলার ৪ উপজেলার লাগোয়া বেলাই বিলের অবস্থান। এক সময় এ বিলের পানি ছিল স্বচ্ছ টলটলে। প্রাকৃতিক ভাবেই পাওয়া যেত রুই-কাতল ছাড়াও কৈ, শিং, মাগুড়, পুঁটি, মিনি, টাকি, শোল, ট্যাংরা, গুলশা, গুতুম, বেলে, মলা, ছোট বাইমসহ হরেক রকম দেশি মাছ। ১০ বছর আগেও গাজীপুর জেলার মাছের চাহিদার ৫০ ভাগ খাল-বিল, নদী নালা থেকে আসত। তার মধ্যে ৩০ ভাগই পাওয়া যেত এই বেলাই বিল থেকে। এক সময় বিলের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো বেলাই বিল পাড়ের হাজারও জেলে। গাজীপুর জেলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী ও আশেপাশের জেলায় সরবরাহ করা হত বেলাই বিলের মাছ। দেশী মাছের জন্য বেলাই বিল ছিল জেলার ঐতিহ্য। কিন্তু কল-কারখানার শিল্প-বর্জ্যে ধ্বংস হতে চলেছে বেলাই বিল।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে চিলাই, পারুলী, তুরাগ ও বালু নদী এবং মোগরখাল, হায়দারাবাদ খাল, জয়রামবের খালসহ ১০-১২টি নদ-নদী ও খাল জেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেলাই বিলে গিয়ে মিশেছে। এসব নদী ও খাল দিয়ে ¯্রােতের মত কারখানার কেমিক্যাল বর্জ্য বেলাই বিলে গিয়ে পড়ছে। আর এতে দূষিত হচ্ছে বিলের পানি।

তিতারকূল এলাকায় বিলে খর জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন সুধন্য দাস। তিনি জানান, ৩-৪ বছর আগেও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এক ঘন্টায় যে মাছ পাওয়া যেত এখন সারাদিনেও তার অর্ধেক পাওয়া যায় না। কারখানার পানিতে বিষ আছে। ওই বিষ, বিল শেষ করে দিছে। বিষাক্ত পানিতে পোনা মাছ মরে যাওয়ায় মাছের বৃদ্ধি হচ্ছে না বলেও পানিতে ভাসতে থাকা মরা মাছ দেখিয়ে জানান সুধন্য দাস।

কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়িয়া গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়া বলেন, শুধু মাছ নয়, দূষিত পানির কারণে ধান উৎপাদনও কমে গেছে। আগে বিলের পানিতে গোসল, গৃহস্থালীসহ কৃষি জমিতে চাষাবাদ করা হত। এখন বিলের পানিতে নামা যায় না। পানি লাগলে শরীর চুলকায়, ঘা হয়। কৃষকের সর্বনাশ করছে কারখানার মালিকরা।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কল-কারখানার বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা কোন ভাবেই প্রাকৃতিক জলাধারকে ধ্বংস করে নয়। কারখানার বর্জ্যে গাজীপুর জেলার সকল নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় দূষিত হয়ে পড়ছে। একই ভাবে দূষিত হচ্ছে বেলাই বিল। কারখানাগুলো ইটিপি ব্যবহার না করার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নদীর মতই প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষা করতে না পারলে আমাদের প্রাকৃতিক দেশীয় মাছ এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত ঘটবে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসন এবং কল-কারখানা অধিদপ্তরকে আরো সচেষ্ট হতে হবে।

বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক মো. আনোয়ার সাদত বলেন, বেলাই বিল গাজীপুর জেলার গর্ব। দেশীয় মাছ, ধান এবং চাষাবাদে এ বিলের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। দূষণের কবলে পড়ে শুধু মাছের উৎপাদন কমেছে তা নয়। উৎপাদন কমেছে ধানেরও। তাই বিলের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য দূষণ বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

গাজীপুর জেলা মৎস কর্মকর্তা ড. কায়সার মুহাম্মদ মঈনুল হাসান জানান, গাজীপুর জেলায় দেশীয় মাছের সবচেয়ে বড় ভান্ডার বেলাই বিল। কয়েক বছর আগেও এ বিল থেকে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। দূষণের কারণে এবং ভরাট হয়ে যাওয়ায় আগের মত এখন আর মাছ পাওয়া যায়না। দূষণ বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিষয়টি অবহিত করেছেন বলেও তিনি জানান।

বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব