ডিএসসিসিতে আওয়াজ বেশি, কাজ কম গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২০ বছরের বেশি পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরুর ঘোষণা দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পাশাপাশি চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও যাচাই করার কথাও জানায়। গত বছরের ৫ মার্চ থেকে ঢাকা জেলা প্রশাসন, বিআরটিএ ও মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতায় মাসজুড়ে ওই অভিযান শুরু করে ডিএসসিসি। কিন্তু সংস্থাটি এমন উদ্যোগ নেওয়ার পরও সড়ক থেকে পুরনো গাড়ি অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। বরং বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলেছে, ঘটছে প্রাণহানিও।

যাত্রী অধিকার আন্দোলন ও যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, ডিএসসিসি কিছু উদ্যোগের কথা মিডিয়া কাভারেজের জন্য। কার্যত এগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না। আর মেয়র বলছেন, অভিযান একেবারেই সফল হয়নি বলা যাবে না। ইতোমধ্যেই অনেক চালক-মালিক সচেতন হয়েছেন। বিশৃঙ্খল গণপরিবহনের বিরুদ্ধে ওই অভিযান শুরুর ২০ দিন আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি নগরভবনে এক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে ওই কর্মসূচি ঘোষণা দেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এরপর তিনি গত ৫ মার্চ নগর ভবনের সামনে থেকে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। অভিযান চলে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। ডিএসসিসি, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ-এর পৃথক তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে পুরো মাসের অভিযানে মাত্র ৭২ চালককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-, এক হাজার ১৮৮টি মামলা, ২৬ লাখ এক হাজার ৫০ টাকা জরিমানা ও ৬৫টি বাস-মিনিবাস ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে রাজধানীর আজিমপুর, গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন ও পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। ৩১ মার্চের পর আর এই অভিযান অব্যাহত থাকেনি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও যাত্রী অধিকার আন্দোলনের অভিযোগÑসিটি করপোরেশন পরিচালিত এই অভিযানের সময়ও নগরবাসী সড়কে গণপরিবহনের ঠিক একটা শৃঙ্খলা দেখেনি। বরং দিন দিন আরও উল্টো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ বছরের মে মাসে রাজধানীর সড়কজুড়ে যে পরিবহন দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তা নগরবাসীকে আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মেয়র সাঈদ খোকনসহ সংশ্লিষ্টদের মুখে প্রায়ই সড়কে অভিযানের কথা শোনা যায়।

মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ধরার জন্য বিশেষ কোনও অভিযানের প্রযোজন হয় না। ডিএমপির যেসব ট্রাফিক সার্জেন্ট রয়েছেন, তারা কাজ করলেই হয়। তাদের সামনে দিয়েই এসব অবৈধ গাড়ি চলে। গণপরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযানের দায়িত্ব মেয়রের না। তবু তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছেন, তাকে সফল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু একমাস পরে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে আগের চিত্রেই। রাস্তায় চলছে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িনগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনও উদ্যোগ নিয়ে মিডিয়াকে ডেকে ঘোষণা দিয়ে দিলেই তা বাস্তবায়িত হয়ে যায় না। এ জন্য দরকার সঠিক কর্মপরিকল্পনা।
বিগত সময়ে সিটি করপোরেশন যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল সঠিক কর্মপরিকল্পনাহীন। যে কারণে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ জন্য সিটি করপোরেশনকে আরও যতœবান হতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহ-সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে, সংশ্লিষ্ট কেউ যদি কোনও উদ্যোগ নিতে চান, তা করতে পারবেন। কিন্তু তাকে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব অভিযান বা উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। যে কারণে কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
শুধু তাই নয়, বলা হয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নগরীতে ৩০টি ‘বাস বে’ নির্মাণ করা হবে। এরমধ্যে মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে আজিমপুর রুটে নির্মাণ করা হবে ছয়টি। জায়গাগুলো হলো মানিক মিয়া এভিনিউ মোড়ে ধানমন্ডি স্কুলের সামনে, মেট্রো শপিংমলের বিপরীতে, কলাবাগান সিগন্যালের দক্ষিণ পাশে, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের সামনে, নিউমার্কেট মোড় পার হয়ে পেট্রোল পাম্পের দক্ষিণ পাশে ও আজিমপুর চৌরাস্তার উত্তর পাশে। এরই মধ্যে আজিমপুর চৌরাস্তার উত্তর পাশের ‘বাস-বে’র নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। একই রুটের বিপরীত পাশে আরও ছয়টি বাস-বে নির্মাণ করা হবে। এগুলো হলো, আজিমপুর এতিমখানা ও স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে, নিউমার্কেট সংলগ্ন চৌরঙ্গী মার্কেটের সামনে, সিটি কলেজের উত্তরে ২ নম্বর রোডের পাশে, কলাবাগান সিগন্যাল পার হয়ে ধানমন্ডি মাঠের সামনে ও মেট্রো শপিংমলের উত্তর পাশে।
এদিকে, যাত্রাবাড়ী-ইত্তেফাক-শাপলা চত্বর-পল্টন-শাহবাগ-পান্থকুঞ্জ রুটে নির্মাণ হবে তিনটি ‘বাস-বে’। এরমধ্যে একটি ‘বাস-বে’ হবে যাত্রাবাড়ী মোড়ে শহীদ ফারুক সরণির মুখে, একটি সায়েদাবাদ পেট্রোল পাম্পের সামনে ও একটি হাটখোলা ক্রসিংয়ে। একই রুটের বিপরীত পাশে নির্মাণ হবে আরও তিনটি ‘বাস-বে’। জায়গাগুলো হলো, শাপলা চত্বরের উত্তরে জনতা ব্যাংক করপোরেট ভবনের সামনে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তরে ও যাত্রাবাড়ী থানার সামনে। বাস-বেগুলোর মধ্যে মগবাজার-মালিবাগ থেকে গুলিস্তান-বংশাল-সদরঘাট রুটে থাকবে ছয়টি। জায়গাগুলো হলো, মলিবাগ স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) অফিস ও কাকরাইল এইচ আর বিল্ডিংয়ের সামনে, জিপিও’র পশ্চিম পাশে, গোলাপ শাহ মাজারের সিগন্যাল ক্রস করে দক্ষিণ পাশে, তাঁতীবাজার মোড় থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক ।
এই রুটের বিপরীত পাশে ছয়টি বাস-বে’র জায়গাগুলো হলো, ভিক্টোরিয়া পার্ক মোড়, টিঅ্যান্ডটি অফিসের পূর্ব পাশে (ফুলবাড়িয়া), সচিবালয়ের পূর্বদিকে, কাকরাইল বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ভবনের পূর্বপাশ, মালিবাগ মোড় ও মগবাজার চৌরাস্তা ফ্লাইওভারের নিচে। বলা হয়েছেÑএসব ‘বাস-বে’ নির্মাণের ফলে নির্ধারিত স্থান থেকেই বাসে ওঠানামা করা যাবে, রোদ-বৃষ্টির মধ্যে যেখানে-সেখানে দাঁড়াতে হবে না। কমবে দুর্ঘটনাও। উন্নত দেশগুলোর ‘বাস-বে’র মতো এসব ‘বাস-বে’তে থাকবে উন্নত ফুটপাত, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, ওয়াইফাই, টি-স্টল, মোবাইল ফোন চার্জের ব্যবস্থা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সড়কের শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হওয়ার তিন বছর অতিবাহিত হলেও সেগুলোর মুখ আজও নগরবাসী দেখতে পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি’র ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাস-বে প্রকল্প সফল না, এটা বলা যাবে না। এরই মধ্যে আমরা কয়েকটির কাজ শুরু করেছি। এগুলোর নির্মাণের কাজ শেষ হলে গণপরিবহনে নগরবাসীকে আর হয়রানির শিকার হতে হবে না। রোদ-বৃষ্টিতে তারা এখানে আশ্রয় নিতে পারবেন। পরিবহন ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরবে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি মোবাশ্বর হোসেন বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘‘মেয়ররা যে উদ্যোগ নেন, সেগুলো অবশ্যই ভালো। কিন্তু পরিকল্পিত নয়। সড়কের যানজট নিরসনের জন্য ‘বাস-বে’ নির্মাণ করা হয়েছে, এতে যানজট বরং আরও বাড়াবে। এটা যানজটের সমাধান হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি ঢাকার শত শত কোম্পানিকে ৪-৫টি কোম্পানির আওতায় নিয়ে আসার।
তখন কোনও কোম্পানির মধ্যে আর প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি থাকবে না। সবাই মনে করবেন সড়কের সব বাসই তাদের। একজন যাত্রী একটি উঠতে না পারলে অন্যটিতে উঠবে। এতেই শৃঙ্খলা ফিরবে। ‘বাস-বে’ দিয়ে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। এ বিষয়ে যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল বিজনেস বাংলাদেশকে ‘গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে মেয়র যে উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন, আমরা তাতে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক দিন পর তার সে উদ্যোগ থেমে গেলো কেন? আমার মনে হচ্ছে তিনি কিছু সুন্দর কথা বলেন শুধু মিডিয়া কাভারেজের জন্য। জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘মেয়ররা অনেক কথা বলেন। কিন্তু কাজ করেন না। তারা যদি কথা অনুযায়ী কাজ করতেন, তাহলে পুরো নগরীর চেহারাই বদলে যেতো।
আমরা আর কোনও প্রতিশ্রুতি দেখতে চাই না। আমরা চাই বাস্তবায়ন।’ এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘যানজট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের নয়। তবু আমরা যেহেতু নগরবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধি, সে হিসেবে নাগরিকরা যেকোনও দুর্ভোগের জন্য আমাদেরই দায়ী করেন। আর সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ক হিসেবে আমরা ?নগরীতে মাসজুড়ে চলাচলকারী ২০ বছরের পুরানো যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। ওই অভিযানে অনেক চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তাদের জেল-জরিমানা করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অভিযান একেবারেই সফল হয়নি বলা যাবে না। এতে অনেক চালক ও মালিক সচেতন হয়েছেন।’
























