শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি বাংলাদেশের শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এই ব্যাংকটি ২০০১ সালে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। গ্রাহকদের অবিচল আস্থা ও সুনামের কারণে এই ব্যাংকের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই ধারা অদূর ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। ব্যাংকটির নিট মুনাফা, আমানত, রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগ এবং খেলাপি ঋণ আদায়সহ বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে বলে বলছেন ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা, আগামীর পদক্ষেপ জানতে বিশেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিজনেস বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক নাজমুল ইসলাম।
বিজনেস বাংলাদেশ: বর্তমানে ব্যাংকে গ্রাহকদের জন্য কী ধরণের সেবা প্রদান করছেন ?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি একটি শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। শরিয়াহ মোতাবেক সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সেবার দেয়ার জন্য চালু রয়েছে ১৪০টি শাখা, ৪টি উপশাখা, ১১৫টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও ১২০টি এটিএম বুথ। তবে বিশেষ কিছু সেবাও রয়েছে। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ইসলামী শরীয়া’র ওয়াকালাহ্ ধারণা অনুসরণ করে চালু করেছে ইসলামী ক্রেডিট কার্ড। এছাড়া রয়েছে টোয়েন্টি ফোর আওয়ার এটিএম সার্ভিস ও রিয়েল টাইম অন-লাইন ব্যাংকিং। আমাদের রয়েছে এসএমএস পুশ-পুল সার্ভিস, যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহক তাদের লেনদেনের তথ্য ও ব্যালেন্স জানতে পারেন। বৈদেশিক রেমিটেন্স সেবা প্রদানের জন্য বিশ্বের বিখ্যাত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রেমিট্যান্স কোম্পানীর সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে। তাছাড়া আমাদের সকল শাখায় রয়েছে অন-লাইন ভিত্তিক ইউটিলিটি বিল পেমেন্ট করার সুবিধা। একজন গ্রাহক তিতাস গ্যাস, পিডিবি, পল্লী বিদ্যুৎ, ওয়াসা, ডিপিসিডি, ডেসকো এবং বিটিসিএল এর সকল ধরণের ফি ও ট্যাক্স শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের যেকোন শাখার মাধ্যমে জমা দিতে পারেন। এছাড়া ব্যবসায়ীদের জন্য শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের সকল শাখায় রয়েছে ই-জিপি সার্ভিস। যার মাধ্যমে সকল প্রকার সরকারী টেন্ডার অনলাইনে দাখিল করা যায়। এই ই-জিপি’র সাথে সংশ্লিষ্ট পে-অর্ডারের জন্য কোন প্রকার চার্জ আরোপ করা হয় না। শুধু তাই নয়, ই-জিপি সার্ভিসের সাথে প্রয়োজনীয় আর্নেস্ট মানি সংস্থানের জন্য অত্যন্ত সহজ শর্তে আর্নেস্ট মানি অথবা পে-অর্ডার ফাইন্যান্স স্কীম, যার মাধ্যমে দরদাতাগণ সহজেই টেন্ডার-ডকুমেন্ট দাখিল করতে পারে।
বিজনেস বাংলাদেশ: আপনি যোগদানের পর কি কি পরিবর্তন এনেছেন?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: নানা সংকটের পরেও ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে। বর্তমান ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ সাড়ে ২৫ হাজার কোটি মত। যা গত বছরছিল ২৪ হাজার কোটি টাকার মত। কর্তমানে বছরে রপ্তানির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি উপরে। এছাড়া আমদানিতে রয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা মত। গড়ে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স আসছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশে দাড়িয়েছে। যা গত বছরও ছিল ৪ শতাংশ। দেশের শীর্ষস্থানীয় আর্থিকভাবে শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক অন্যতম এবং এই ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানত ও বিনিয়োগ দুটো-ই অধিকতর নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। কারণ ইমার্জিং ক্রেডিট লিমিটেড (ইসিআরএল) এর রেটিং এ শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং লং টার্মে এএ+ এবং শর্ট টার্মে এসটি-২। এই রেটিং দ্বারা প্রমাণিত হয় যে শাজজালাল ব্যাংক শক্তিশালী একটি ব্যাংক।
বিজনেস বাংলাদেশ: ব্যাংকটির পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাবেন কী ?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: ব্যাংকের ভালো ও নির্ভরযোগ্য বোর্ড অফ ডিরেক্টরস রয়েছেন। বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে স্বচ্ছতা আছে। তাই অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমত দেশের তিনটি ব্যাংকের মধ্যে থাকা। একটি ভালো ব্যাংক তৈরি করতে যা যা পরিকল্পনা দরকার সব ধরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আমাদের ব্যাংকিং সেবাকে ‘গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড’-এ উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি, পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চল ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা ব্যাংকিং সেবাকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিস্তৃত করতে চাই, যাতে করে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো ব্যাংকিং-সেবা-প্রাপ্তি প্রতিটি ব্যক্তির আরেকটি মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। তাহলেই সর্বত্র একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন পরিলক্ষিত হবে।
বিজনেস বাংলাদেশ: কোন কোন খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছেন?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: শুরু থেকেই একটি ব্যাংকটি করপোরেট ব্যাংকিং করে আসছে। তবে এখন করপোরেটের দিকে যাচ্ছি না। শিল্প ঋণের পাশাপাশি কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি রপ্তানি ও শিল্প খাতে ঋণ দিচ্ছি। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রধিকার দেয়া হচ্ছে। গ্রামের মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে অবদান রাখতে কাজ করছে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া প্রান্তিক মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দেয়ার জন্য এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমাদের অবদান থাকবে, এটা আমরা চাই। নিচের দিকের লোকজনকে ক্ষুদ্রঋণ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে আমরা চাই বেশি বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আমরা মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে বেশি জড়িত হতে চাই। এটাই হলো আমাদের মূল উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য। তারই ধারাবাহিকতায় সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা শাখা ও উপশাখা সম্প্রসারণ করে যাচ্ছি। আমাদের এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আমাদের এই ব্যাংকের ব্যাংকিং সেবাকে ধীরে ধীরে আমরা দেশের প্রত্যেকটি শহর, উপশহর এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও পৌঁছে দিতে চাই। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক প্রদত্ত ব্যাংকিং সেবায় গ্রাহকগণ অত্যন্ত সন্তুুষ্ট। তাই প্রতিনিয়ত ব্যাংকটির সুনাম ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর্থিক ভিত মজবুত হচ্ছে, শাখা সম্প্রসারিত হচ্ছে, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকটি অংশগ্রহণ করতে পারছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের উপরও আমরা সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করে আসছি। সমাজের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবাভুক্ত করার কৌশলগত পরিকল্পনাই আমাদের এই আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম জেলায় কার্যরত সকল তফশিলী ব্যাংকের সহযোগিতায় লীড ব্যাংক হিসেবে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি “স্কুল ব্যাংকিং কনফারেন্স-২০২৪” এর আয়োজন করে। আমাদের এই আয়োজন মূলত স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, সঞ্চয়ের মনোভাব বৃদ্ধি ও অভ্যাস গড়ে তোলা। যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের, সমাজের ও দেশের অগ্রগতিতে সমানভাবে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিজনেস বাংলাদেশ: ব্যাংকিং খাতে কোন চ্যালেঞ্জ দেখছেন কী?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমানত ধরে রাখা। এছাড়া রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা একটি চ্যালেঞ্জ। আমাদনি গ্রাহকের চাহিদা মতো এলসি খোলাই চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও বর্তমানে ব্যাংক খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।