শহর উপ-শহরের মতো গ্রামেও এখন গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাড়ীতে চলছে নির্মাণ কাজ। ট্রাক বোঝাই হয়ে আসছে ইট, বালু। আর যারা এই সব ইট-বালুর ব্যবসা করছেন তবে তারা সে সব রাখছেন কোথায়? কেন? সড়ক-মহাসড়ক আছে না! আর এমন একটি মহাসড়ক যার নাম ঢাকা-চট্টগ্রাম। হাইওয়ে পুলিশ এবং সড়ক ও জনপথের নাকের ডগায় এই মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে সড়কের দুই পাশের জায়গা দখলে নিয়ে চলছে ইট-বালুর রমরমা ব্যবসা। দিনের পর দিন সড়কের উপর মালামাল, ইট ভাঙার মেশিন, বালু ও ইটের গাড়ী রেখে যান চলাচল এবং পথচারীদের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটিয়ে চলছে এসব ইট বালুর ব্যবসায়ীরা। সড়ক ও সড়কের ফুটপাত দখলে নেওয়ার কোন বৈধতা না থাকলেও আইনের তোয়াক্কা না করেই নির্ভিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন দখলদাররা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড পৌরসভার দেওয়ান দীঘির পশ্চিম পাড়ে, তারও দক্ষিণে আবুল হোসেন সওদাগরের বাড়ীর সামনে, ইদিলপুর, বায়তুশ শরফ, শেখপাড়া, উত্তর বাইপাস, ভূঁইয়ার বটতল, ছোট দারোগারহাট ও দক্ষিণে দোয়াজীপাড়া, উপজেলা, শুকলাল হাট ও সিরাজ ভূঁইয়া রাস্তার মাথা অংশে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ইট-বালুর ব্যবসা। শুধু পৌরসদরের ভিতরে মহাসড়কের দুই পাশ দখল করে চলছে অন্তত ৩০টি স্থানে এ ব্যবসা।
ব্যস্ত মহাসড়কটির বিপদজনক এই জোনে যেখানে পথচারীদের হাঁটা-চলা করার কথা, সেই স্থানে জমাট করে স্তুপ করা হচ্ছে ইট-বালু, রাস্তায় মেশিন বসিয়ে ভাঙা হচ্ছে ইটের কংক্রিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাক থামিয়ে লোড-আনলোড করা হচ্ছে ইট, বালু ও কংক্রিট। আর এসবের ফলে গাড়ী চলাচলে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি বাড়ছে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা।
সীতাকুণ্ড পৌরসভারসহ দারোগারোহাট হইতে কুমিরা পর্যন্ত অংশটিতে বড় ধরণের দুর্ঘটনার ভয়ঙ্কর ইতিহাস থাকলেও বছরের পর বছর বন্ধ করা যায়নি এসব বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বাণিজ্য। গত ১৯ মে সীতাকুণ্ড শেখপাড়া এলাকায় একটি মালবাহী ট্রাকের পিছনে অপর একটি কাভার্ডভ্যান ধাক্কা দিলে একজন নিহত হয়৷ এরপর গত ১৯ সেপ্টেম্বর বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের ছোট দারোগারহাট এলাকায় চট্টগ্রামমুখী একটি যাত্রীবাহী বাসের সাথে উল্টো দিক থেকে আসা অপর একটি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হয়। এ দুর্ঘটনায় বাসে থাকা আরও ৭ যাত্রী আহত হয়। সর্বশেষ ২৩ মার্চ মহাসড়কের পাশ দখল করে গড়ে ওঠা সীতাকুণ্ডের বাস স্ট্যান্ড এলাকায় একটি ট্রাক ইউনিক কাউন্টারে ঢুকে যায় এতে একজন গুরুতর আহত হয়।
সবমিলিয়ে সীতাকুণ্ডে গত ছয়মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরেছে অন্তত ২০ প্রাণ। একের পর এক দুর্ঘটনায় সড়কে মৃতের সারি দীর্ঘ হলেও তেমন কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
২০০১ থেকে ২০২৫ সালে সীতাকুণ্ডের পন্থিছিলা-ফকিরহাট এলাকায় ঘটেছে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা। এক জরিপে জানা যায়, সীতাকুণ্ডের শুধুমাত্র এই অংশে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪০ জন। আর সম্প্রতি ফুটপাত দখল হওয়ায় এই অংশটি আরো বিপজ্জনক হয়ে ওঠেছে। দখল করা হয়েছে সড়কের দুই পাশ। রাখা হয়নি পথচারী চলাচলের কোন জায়গা। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরাও চলাচল করছে মহাসড়কের উপরে ওঠে। শুধু তাই নয় সীতাকুণ্ড বাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া সিএনজি, অটোরিকশা, পিকআপসহ সবগুলো গাড়ী উল্টো পথে আসে। তার উপর রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামগামী বাসের ওভারট্রেকিং প্রতিযোগীতা। এমন দৃশ্য সীতাকুণ্ডের শেখপাড়া-বায়তুশ শরফ, উত্তর বাইপাস ও সীতাকুণ্ড বাস স্ট্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিম পাশের দেওয়ান দীঘি অংশে গেলেই চোখে পড়বে। এখানে জমাকৃত এসব বালু গড়িয়ে সড়কে এসে জমা হয়। ফলে কিছু কিছু গাড়ী বালুতে উল্টে যায়। কিছুদিন আগেও এই পয়েন্টে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গত ৫ ডিসেম্বর সুলতানা মন্দির জিপিএইচ কারখানা গেইটের সামনে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন কোন না কোন মোটরসাইকেল আরোহী বড় গাড়ীর চাপে পড়ে বালুতে চাকা তুলে দিতে বাধ্য হয়। ফলে বালুতে উল্টে দুর্ঘটনা ঘটে। যার জন্য দায়ী এসব অবৈধ দখলদার। মহাসড়কের পাশে পথচারী যাতায়াতের স্থান দখল করে দীর্ঘদিন ইট-বালুর ব্যবসা চললেও এই বিষয়ে নির্বাক সংশ্লিষ্টরা।
দখলদারেরা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পাওয়ায় ভয়ে কেউ প্রতিবাদও করেন না। প্রভাবশালীদের জাঁতাকলে সবাই নীরব। শুধু ইট বালুর ব্যবসায়ীরা নয় হোটেল, চা-দোকান মালিকসহ যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে দখলে নিয়েছে মহাসড়ক। নিজেদের অব্যবহৃত গাড়ী, ক্রেন, স্কেবেটর, হোন্ডা, মালামাল ইত্যাদি ফেলে রেখে বছরান্তিকাল ধরে দখলে রেখেছে নিজের সম্মুখের সড়ক অংশটি।
এলাকাবাসীর দাবী-সড়কের পাশে ইট, বালু, কংক্রিট রাখার কারণে হাঁটতে গিয়ে মহাসড়কে উঠে যেতে হয়। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি সব সময়ই থাকে। তাছাড়া স্তুপ করা এই বালু দ্রুতগতির গাড়ীর বাতাসে উড়ে চালক-পথচারীর চোখে পড়ে বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিবেন বলে আশাবাদী এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশ দেখভালের দায়িত্ব কুমিরা, বারআউলিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের। কিন্তু সড়কটি তদারকিতে তাদেরও আছে অবহেলা ও গাফিলতি।
অভিযোগ করে লরি চালক মোঃ জাবেদ হোসেন বলেন, অনেক সময় হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়ক তদারকির চাইতে গাড়ী থেকে চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকেন। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে নির্বিঘ্নে এ ব্যবসা চালিয়ে গেলেও হাইওয়ে পুলিশ কিংবা থানা পুলিশের এই অবৈধভাবে ইট-বালুর ব্যবসা কি তাদের চোখে পড়ে না? এটি তাদের ব্যবসা হলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফুটপাত দখল করে এই ব্যবসা একেবারেই বে-আইনী।
এবিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সীতাকুণ্ডের দায়িত্বরত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (সওজ) মোহাম্মদ ফারহান আহমেদ বলেন, আমরা তো নোটিশ দিয়েছি। এটাতো হাইওয়ে পুলিশের দেখার বিষয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিরা হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম এই প্রতিবেদকে বলেন, মহাসড়কের দুই পাশ দখল করে ইট-বালুর ব্যবসা চলতেছে এটা আমার জানা নাই।
ডিএস.