০৯:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

গ্লোব কনস্ট্রাকশনের প্রতারণায় সর্বস্বান্ত ভূমি মালিক, অনিশ্চয়তা ও ভোগান্তিতে দোকান মালিকরা

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে গ্লোব-জনকন্ঠ শিল্প পরিবার। তাদেরই অঙ্গ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব কনস্ট্রাকশন। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন দশক ধরে ভবন নির্মাণের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। একদিকে তারা সেসব ভবনকে ব্যাংকের কাছে
বন্ধক দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছে এবং জমির প্রকৃত মালিকদের নায্য হিস্যা না দিয়ে পথে বসিয়েছে। আবার বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে দোকান ও অফিস স্পেস বিক্রি করে তা তিন দশকেও রেজিষ্ট্রেশন করে দেয়নি।

ডেভেলপার কোম্পানি হিসাবে গ্লোব কনস্ট্রাকশন ১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরুর সময়ই ২৪ মিরপুর রোডে (ঢাকা কলেজের বিপরীতে) সাড়ে ১৯ কাঠা জমিতে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের চুক্তি করে।

২৬ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি ‘গ্লোব শপিং সেন্টার’ নামের ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ করেনি। ভূমি মালিককে তার নায্য হিস্যাও বুঝিয়ে দেয়নি। এমনকি নির্মাণ কাজ শেষ না করেই গ্লোব কনস্ট্রাকশন প্রতারণামূলকভাবে অসংখ্য দোকান বিক্রি করেছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করে দেয়নি। অন্যদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে এই ভবনট বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়ে পরিশোধও করেনি।

গ্লোব শপিং সেন্টারের জমির মালিক খ্যাতনামা ফটোসাংবাদিক প্রয়াত জহিরুল হক। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানেরা জমির মালিকানা পেয়েছেন। ১৯৯৯ সালে গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিমিটেডে সঙ্গে মার্কেট নির্মাণের চুক্তি হলেও আজও তারা নায্য পাওনা বুঝে পাননি। সর্বস্বান্ত হয়ে এই পরিবারটি এখন দোকান মালিকদের মতো পথে বসার উপক্রম।

চুক্তির ৯ বছর পরও গ্লোব কনস্ট্রাকশন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ভূমি মালিকরা বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত যাবতীয় ‘চুক্তি’ বাতিল করে। এদিকে ২০০৭ সালেই ঋণ প্রদানকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংকও গ্লোবের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপির মামলা করে। এরপর ২০১৪ সালে আদালত থেকে ওই বন্ধকী সম্পত্তি ভোগ দখলের রায় পেয়ে যায় ব্যাংক।

এই রায়ের ১১ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু কার্যকর করতে দেয়নি গ্লোব কনস্ট্রাকশন। বর্তমানেও আদালতের রায় অমান্য করেই চলেছেন গ্লোবের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন। জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়ীদের ঠকিয়ে একের পর এক নির্মিত দোকান বিক্রি করছেন। টাকা আত্মসাত করছেন দেদারসে। অথচ এটি ব্যাংকের বন্ধকী সম্পত্তি যা বিক্রির অযোগ্য। গ্লোব যে কয়টি দোকান বিক্রি করেছে তা রেজেস্ট্রিও দেয়নি। উল্টো জমির মালিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্লোব শপিং সেন্টারের লিফট, এক্সিলেটর, এয়ারকন্ডিশনসহ প্রায় সবধরনের সেবা অকার্যকর করে রেখেছে। তারা মার্কেটের বিদ্যুৎ, গ্যাস পানির বিলসহ যাবতীয় বকেয়া পরিশোধ করছে না। এতে করে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দোকানদার, ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। উপরন্ত গ্লোবের প্রতিনিধিরা গভীর রাতে মার্কেটে এসে হুমকিধামকি দিয়ে সার্ভিস চার্জ, জামানত ও ভাড়া কালেকশন করে নিয়ে যায়। এর নেতৃত্ব রয়েছেন গ্লোবের নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন এবং মেজর আফিজ। তাদের নির্দেশ ও তত্ত্ববধানে লুটপাট থেমে নেই। মার্কেটের নানা অসুবিধা কথা বললে তারা উর্ধ্বতনদের জানাবে বলে এড়িয়ে যান। মার্কেটের উন্নয়ন কাজ কিছুই হয় না।

 

এ বিষয়ে গ্লোব শপিং সেন্টারের ব্যবসায়ী ও মার্কেট কমিটির সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান আজাদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি। আমরা যে সম্পদটা ক্রয় করেছি দীর্ঘ ২৫ বছরেও তার মালিকানা পাচ্ছিনা। গ্লোব-জনকন্ঠ আমাদের দোকান রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছে না। আমরা আমাদেরটা পাবো আর ভূমি মালিক তারটা পাবে। এটাই আমাদের চাওয়া। একই সঙ্গে চাই মার্কেটের উন্নয়ন। যাতে স্বাচ্ছন্দে ক্রেতারা কেনাকাটা করতে পারেন।

এদিকে গত ২১ এপ্রিল ভূমি মালিক মার্কেটে ব্যাংকের দেওয়া নোটিশ টানিয়ে দেন। কিন্তু ওইদিনই দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কোম্পানির প্রতিনিধি ইনচার্জ মিজান মার্কেটে বহিরাগতদের নিয়ে অনুপ্রবেশ করে। নিরাপত্তকর্মীদের হুমকিধুমকি দিয়ে নোটিশটি ছিঁড়ে ফেলে। এছাড়াও ভূমি মালিকের অফিস ভাঙচুর করে, সাইনবোর্ড খুলে ফেলে এবং তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদে মিজান স্বীকার করে, গ্লোব জনকণ্ঠ পরিবারের নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির ও মেজর আফিজের নির্দেশে এসব কাজ করতে সে বাধ্য হয়েছে।

গ্লোব শপিং সেন্টারের ভূমি মালিক হাফিজা জহির বলেন, বিভিন্ন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বিগত ২৫ বছর ধরে এরকম অত্যাচার আর অবৈধ কর্মকাণ্ড করে চলেছে। আমরা সুবিচার পাইনি। দোকান মালিকরা তাদের রেজিষ্ট্রেশন বুঝে পায়নি। এদিকে বকেয়া পরিশোধ না করায় আজও পানির লাইন কাটার জন্য লোক এসেছে। গ্লোব-জনকণ্ঠ পরিবারের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডে আমরা সবাই ভুক্তভোগি। ভবন নির্মাণের জন্য তাদের নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকটি মার্কেটে নোটিশ টানিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এখন কোথায় যাবো?

এসব বিষয়ে জানার জন্য গ্লোব-জনকণ্ঠ পরিবারের নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনো কর্মকর্তাই এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

গ্লোব কনস্ট্রাকশনের প্রতারণায় সর্বস্বান্ত ভূমি মালিক, অনিশ্চয়তা ও ভোগান্তিতে দোকান মালিকরা

প্রকাশিত : ০৮:২৭:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে গ্লোব-জনকন্ঠ শিল্প পরিবার। তাদেরই অঙ্গ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব কনস্ট্রাকশন। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন দশক ধরে ভবন নির্মাণের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। একদিকে তারা সেসব ভবনকে ব্যাংকের কাছে
বন্ধক দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছে এবং জমির প্রকৃত মালিকদের নায্য হিস্যা না দিয়ে পথে বসিয়েছে। আবার বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে দোকান ও অফিস স্পেস বিক্রি করে তা তিন দশকেও রেজিষ্ট্রেশন করে দেয়নি।

ডেভেলপার কোম্পানি হিসাবে গ্লোব কনস্ট্রাকশন ১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরুর সময়ই ২৪ মিরপুর রোডে (ঢাকা কলেজের বিপরীতে) সাড়ে ১৯ কাঠা জমিতে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের চুক্তি করে।

২৬ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি ‘গ্লোব শপিং সেন্টার’ নামের ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ করেনি। ভূমি মালিককে তার নায্য হিস্যাও বুঝিয়ে দেয়নি। এমনকি নির্মাণ কাজ শেষ না করেই গ্লোব কনস্ট্রাকশন প্রতারণামূলকভাবে অসংখ্য দোকান বিক্রি করেছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করে দেয়নি। অন্যদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে এই ভবনট বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়ে পরিশোধও করেনি।

গ্লোব শপিং সেন্টারের জমির মালিক খ্যাতনামা ফটোসাংবাদিক প্রয়াত জহিরুল হক। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানেরা জমির মালিকানা পেয়েছেন। ১৯৯৯ সালে গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিমিটেডে সঙ্গে মার্কেট নির্মাণের চুক্তি হলেও আজও তারা নায্য পাওনা বুঝে পাননি। সর্বস্বান্ত হয়ে এই পরিবারটি এখন দোকান মালিকদের মতো পথে বসার উপক্রম।

চুক্তির ৯ বছর পরও গ্লোব কনস্ট্রাকশন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ভূমি মালিকরা বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত যাবতীয় ‘চুক্তি’ বাতিল করে। এদিকে ২০০৭ সালেই ঋণ প্রদানকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংকও গ্লোবের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপির মামলা করে। এরপর ২০১৪ সালে আদালত থেকে ওই বন্ধকী সম্পত্তি ভোগ দখলের রায় পেয়ে যায় ব্যাংক।

এই রায়ের ১১ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু কার্যকর করতে দেয়নি গ্লোব কনস্ট্রাকশন। বর্তমানেও আদালতের রায় অমান্য করেই চলেছেন গ্লোবের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন। জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়ীদের ঠকিয়ে একের পর এক নির্মিত দোকান বিক্রি করছেন। টাকা আত্মসাত করছেন দেদারসে। অথচ এটি ব্যাংকের বন্ধকী সম্পত্তি যা বিক্রির অযোগ্য। গ্লোব যে কয়টি দোকান বিক্রি করেছে তা রেজেস্ট্রিও দেয়নি। উল্টো জমির মালিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্লোব শপিং সেন্টারের লিফট, এক্সিলেটর, এয়ারকন্ডিশনসহ প্রায় সবধরনের সেবা অকার্যকর করে রেখেছে। তারা মার্কেটের বিদ্যুৎ, গ্যাস পানির বিলসহ যাবতীয় বকেয়া পরিশোধ করছে না। এতে করে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দোকানদার, ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। উপরন্ত গ্লোবের প্রতিনিধিরা গভীর রাতে মার্কেটে এসে হুমকিধামকি দিয়ে সার্ভিস চার্জ, জামানত ও ভাড়া কালেকশন করে নিয়ে যায়। এর নেতৃত্ব রয়েছেন গ্লোবের নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন এবং মেজর আফিজ। তাদের নির্দেশ ও তত্ত্ববধানে লুটপাট থেমে নেই। মার্কেটের নানা অসুবিধা কথা বললে তারা উর্ধ্বতনদের জানাবে বলে এড়িয়ে যান। মার্কেটের উন্নয়ন কাজ কিছুই হয় না।

 

এ বিষয়ে গ্লোব শপিং সেন্টারের ব্যবসায়ী ও মার্কেট কমিটির সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান আজাদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি। আমরা যে সম্পদটা ক্রয় করেছি দীর্ঘ ২৫ বছরেও তার মালিকানা পাচ্ছিনা। গ্লোব-জনকন্ঠ আমাদের দোকান রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছে না। আমরা আমাদেরটা পাবো আর ভূমি মালিক তারটা পাবে। এটাই আমাদের চাওয়া। একই সঙ্গে চাই মার্কেটের উন্নয়ন। যাতে স্বাচ্ছন্দে ক্রেতারা কেনাকাটা করতে পারেন।

এদিকে গত ২১ এপ্রিল ভূমি মালিক মার্কেটে ব্যাংকের দেওয়া নোটিশ টানিয়ে দেন। কিন্তু ওইদিনই দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কোম্পানির প্রতিনিধি ইনচার্জ মিজান মার্কেটে বহিরাগতদের নিয়ে অনুপ্রবেশ করে। নিরাপত্তকর্মীদের হুমকিধুমকি দিয়ে নোটিশটি ছিঁড়ে ফেলে। এছাড়াও ভূমি মালিকের অফিস ভাঙচুর করে, সাইনবোর্ড খুলে ফেলে এবং তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদে মিজান স্বীকার করে, গ্লোব জনকণ্ঠ পরিবারের নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির ও মেজর আফিজের নির্দেশে এসব কাজ করতে সে বাধ্য হয়েছে।

গ্লোব শপিং সেন্টারের ভূমি মালিক হাফিজা জহির বলেন, বিভিন্ন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বিগত ২৫ বছর ধরে এরকম অত্যাচার আর অবৈধ কর্মকাণ্ড করে চলেছে। আমরা সুবিচার পাইনি। দোকান মালিকরা তাদের রেজিষ্ট্রেশন বুঝে পায়নি। এদিকে বকেয়া পরিশোধ না করায় আজও পানির লাইন কাটার জন্য লোক এসেছে। গ্লোব-জনকণ্ঠ পরিবারের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডে আমরা সবাই ভুক্তভোগি। ভবন নির্মাণের জন্য তাদের নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকটি মার্কেটে নোটিশ টানিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এখন কোথায় যাবো?

এসব বিষয়ে জানার জন্য গ্লোব-জনকণ্ঠ পরিবারের নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনো কর্মকর্তাই এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।